বিনির্মাণ
একেবারে মেঠো মানুষের সরলতায় লোকটা পার্থকে বলল, ‘হাত দিলেই অমনি আরম্ভ হয়ে
যাবে মুহূর্তে মুহূর্তে পোশাক পালটিয়ে নাচ, একেবারে হিন্দি সিনেমার মতো’।
পার্থ চুপ করে। একটা ভার্টিকালনেসকে
খর্ব করতে গিয়ে আর একটা ভার্টিকালনেসকে দাঁড়
করানো কতখানি গোলমেলে সিদ্ধান্ত, তাই ভাবছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। করিডোরটায় পা রাখার জায়গা নেই।
‘ভেবে দেখুন স্যর, জায়গা দখলের খেলা এটা নয়। আপনি জোর জবরদস্তি করবেন তো, অশান্তি কাজিয়া বেধে যাবে। আপনি হিন্দু আমি মুসলমান আপনি পরিষদ আমি বজরঙ্গী...
ভেবে দেখুন, এই রকম ধ্বংসের মনোভাব ঠিক নয়’।
পার্থ ভাবছে তার আলোকপ্রাপ্তির খেলা এইখানেই শেষ। লোকটা ছ’ ছ’খানা লাগেজ নিয়ে পার্থর কো-প্যাসেনজার। পার্থর
লাগেজ মাত্র একটাই। রাখার জায়গা নেই।
‘হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার? লাগেজগুলো সরিয়ে নিন জলদি!’ বিরক্তি জমানো এক জোড়া
চোখ ধমক লাগায় পার্থকে।
কোনোদিন কোনো অচেনা লোক এভাবে পার্থর সঙ্গে কথা বলেনি। তার সীট লোয়ার বার্থ। ধমক লাগানো চোখ জোড়ার আপার বার্থ। চলন্ত ট্রেনে যে যার লাগেজ সামলাচ্ছে। নিজেকে সম্পূর্ণ অকেজো বোধ করল পার্থ। ছ’টা লাগেজের মালিক মোবাইলে কথা বলতে বলতে নিজেকে
ততক্ষণে একঘরে করে ফেলছে দ্রুত।
‘কী হলো দাদা! তখন থেকে বলছি লাগেজগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে নিন! আপনি একাই এতগুলো মালপত্র দিয়ে জায়গা জুড়ে রাখলে
বাকিরা কোথায় দাঁড়াবে?’
এই মুহূর্তে পার্থ বিক্ষুব্ধ সাংসদ। সংসদীয় গণতন্ত্রে তার কোনো প্রতিনিধি
নেই। পার্থর হয়ে কেউ কোনো কথা বলারও নেই।
ওদিকে মোবাইলে আরব্য রজনীর লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। ...একবার হাত দিয়েই দেখুক,
অমনি হিন্দি স্টাইলে নাচ লেগে যাবে। তোমরা যতই করো, আমার পার্টি বনধ্ সফল করবেই...
হেঃ হেঃ!
ভালো লাগছে না পার্থর কিচ্ছু। চরম গতি নিয়ে ছুটে চলা ট্রেনটাকে মনে হচ্ছে ভূমিকম্পের
দোলন। হা ঈশ্বর,
যেন ভূমিকম্পই বেধে যায় শেষ পর্যন্ত! তখনই আসল খেল শুরু হয়ে যাবে। এই যা কিছু পার্থ রোজ দেখছে সব তখন আপনা হতেই থেমে যাবে। ভাবতেই গা
শিরিশির করে উঠল। ধাতব উদাসীনতায় বুঁদ
সবজান্তা নাগরিক দল। নিজের নিজের বুদ্ধিবৃত্তির মাপকাঠি নাড়িয়ে প্রগতির পথে
এগিয়ে চলেছে। এইসব ক্ষয়ক্ষতি অথবা লাভের বখরার হিসাব কে করবে? ভগবান? বিপদে পড়লে কারো কারো চোখমুখ আরো
চোর চোর হয়ে যায়। তখন এ টু জেড সবই নিয়ন্ত্রণের
বাইরে। চারিদিকে ফতোয়া। প্রত্যেকটা শব্দ তখন অকেজো আর
নির্মম। কাফের নিগার কালা নেটিভ বেইমান বদতমিজ এসসেটরা এসসেটরা... একদিন নিশ্চয়ই চারিদিকের প্রত্যেকটা মানুষ এক
একটা দেশ হয়ে যাবে। তখন দেশে দেশে
পার্থক্য ঘুচোনোর জন্য সবার আগে দেশভাগের জঞ্জালগুলোকে সরাতে হবে। দেশভাগের
জঞ্জাল? ...আপন মনেই কুলকুল করে হাসল পার্থ।
এই মুহূর্তে সে নিজেও একজন স্বাধীন দেশ। এমন দেশ যেখানে কোনো ভাগাভাগিও নেই, দলাদলিও নেই। নিজের লাগেজটা পার্থ কাঁধে তুলে নিল। তার স্বাধীন দেশে নিজস্ব বাকস্বাধীনতা।
‘...আপনি বসুন এদিকটায়। এই এতগুলো লাগেজ সবই ওনার’,
মোবাইলধারীর দিকে তর্জনী তুলে দ্যাখায় পার্থ।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত গোছের প্রশ্ন উড়ে আসে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আরামসে বসে পড়ুন।
ব্যাগে বোমা টোমা নেই, সব সিকিউরিটি দিয়ে
চেক করানো আমার আগেভাগেই... আরাম সে... কতদূর যাবেন আপনারা?’
উল্টোদিক থেকে সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন সহাস্য মন্তব্য ছুঁড়ে মারল, ‘আমার
ব্রীফকেশটায় কেউ বোমা বেঁধে দিয়ে গেছে স্যর! দেখবেন একটু?’
ভাড়া করা আবহাওয়ায় পার্থর আর চোখ তুলে চাইতেই ইচ্ছে করল না। নিজের সীটে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। স্বাধীনতা স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা শব্দগুলো ক্রমেই
চলে যাচ্ছে সন্দেহর তালিকায়। সত্যিই যদি কোনো ব্যাগের ভেতরে ভয়ঙ্কর কিছু
লুকোনো থাকে! তখন উল্টোনো ট্রেন কাটামুন্ডু রক্তাক্ত শরীর... প্রতিবাদী দেশের কন্ঠস্বর কোনোদিন কোনো সংলাপে
থাকে কি? কে জানে!
প্রতি মুহূর্তে অপরকে বিচার্য করে তোলা তার বদ
অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমে। সর্বাঙ্গে অতৃপ্তির ঘন ছাপ নিয়ে চুপ করে বসে থাকে
পার্থ।
বেশ সুবিন্যস্ত ভাবে পরিবেশন ভাবনার জটিল প্রসার
উত্তরমুছুন