শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪০


সম্পাদকীয়তে একই বিষয়ে বারবার আলোচনা করতে ভালো লাগে না। পাঠক-পাঠিকাদেরও একই আলোচনা বারবার পড়তে বিরক্তি লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, বারবার একই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেও সমস্যাটা যখন সেই সমস্যার গভীরেই থেকে যায়, তখন বাধ্য হয়েই আবার একই আলোচনায় ফিরে আসতে হয়। বলা বাহুল্য, এর আগে সম্পাদকীয় কলমে ঝুরোগল্প সম্পর্কে বেশ কয়েকবার আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু ‘কালিমাটি অনলাইনে’ প্রচলিত ধারার গল্প প্রকাশ করা হয় না,  বরং বাংলা কথাসাহিত্যে গল্পের এক নতুন ‘ফরম্যাট’ বা আঙ্গিকের সূচনা করে ‘ঝুরোগল্প’ প্রতিটি সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে। বস্তুতপক্ষে ঝুরোগল্প সম্পর্কে যেমন পাঠক-পাঠিকাদের কোনো পূর্বধারণা ছিল না, অনুরূপে লেখক-লেখিকাদেরও কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। বিশেষত অনেকেই ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেন অণুগল্পের সঙ্গে। আমরা আগেও বারবার উল্লেখ করেছি, আবার উল্লেখ করছি, অণুগল্প ও ঝুরোগল্প কখনই একই ‘ফরম্যাটে’র গল্প নয়। প্রত্যেক ‘ফরম্যাটে’র গল্পের আলাদা আলাদা  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, আলাদা আলাদা গল্পভাবনা আছে। আর তাই অণুগল্প লিখে তাকে ঝুরোগল্প নামে প্রকাশ করাও অত্যন্ত আপত্তিজনক। আমাদের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, অনেক গল্পকার বিষয়টা ঠিকমতো অনুধাবন করতে না পেরে ‘কালিমাটি অনলাইনে’র জন্য যে ঝুরোগল্পগুলি পাঠান, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি ঝুরোগল্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয় না, বরং তা অণুগল্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। সম্প্রতি ‘কালিমাটি’র নিয়মিত ঝুরোগল্পকার সোনালি বেগম আমাকে জানালেন যে, লেখক ও পাঠকমহলে ঝুরোগল্প সম্পর্কে যেহেতু কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তাই আমাদের আরও উদ্যোগী হয়ে ঝুরোগল্পের প্রচার করা খুবই জরুরি। প্রসঙ্গত জানাই যে, ইন্টারনেটে ইতিমধ্যে ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ শিরোনামে ৪৭টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। বিগত ২০১৫ কলকাতা বইমেলায় ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা’ থেকে প্রথম ঝুরোগল্পের সংকলন ‘ঝুরোগল্প ১’ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংকলনে ২৪ জন ঝুরোগল্পকারের মোট ২৪০টি ঝুরোগল্প আছে। আবার আগামী ২০১৭ কলকাতা বইমেলায় ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা’ থেকে প্রকাশিত হবে ২২ জন ঝুরোগল্পকারের মোট ২২০টি ঝুরোগল্পের সংকলন ‘ঝুরোগল্প ২’। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকা এবং লেখক-লেখিকাদের এই দুটি ঝুরোগল্পের সংকলন ও ‘কালিমাটি অনলাইন’এর ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ বিভাগটি পড়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। এই প্রসঙ্গে আরও জানাই, ‘ঝুরোগল্প ১’এর ভূমিকা লিখেছিলেন প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সমীর রায়চৌধুরী এবং প্রকাশিতব্য ‘ঝুরোগল্প ২’এর ভূমিকা লিখেছেন ড. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়। ঝুরোগল্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করার জন্য এই দুটি ভূমিকা অবশ্যই পড়া প্রয়োজন। আর পরিশেষে খুব অল্প কথায় ঝুরোগল্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানাই, ঝুরোগল্প সব সময় ‘ওপেন এন্ডেড’ হয়, কখনই ‘ক্লোজড এন্ডেড’ নয়। গল্প যে কোনো বাক্য থেকে হঠাৎই শুরু হয় এবং হঠাৎই শেষও হয়ে যায়। গল্পের কোনো নির্দিষ্ট পরিণতি থাকে না। গল্পের মধ্যে নিটোল কোনো গল্প বলারও আদৌ প্রয়োজন নেই। আর গল্পটি ৫০০ থেকে ৬০০ শব্দ সংখ্যার  মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয়।  

গত অক্টোবর মাসে ‘কালিমাটি অনলাইন’ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি কিছু অসুবিধের কারণে। নভেম্বর সংখ্যা যথাসময়ে প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত। তবে এই সংখ্যায় একটি অসম্পূর্ণতা থেকে গেল। নিয়মিত বিভাগ ‘চারানা আটানা’র লেখক অমিতাভ প্রামাণিক সম্প্রতি চোখের অসুস্থতার জন্য লেখালেখি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন ডাক্তারবাবুর নির্দেশে। অমিতাভ জানিয়েছেন, নভেম্বর সংখ্যাতে লেখা তাঁর পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, এমনকি ডিসেম্বর সংখ্যাতেও হয়তো সম্ভব হবে না। আমরা কামনা করছি, অমিতাভ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন এবং জানুয়ারী সংখ্যায় আবার  লেখা পাঠিয়ে তাঁর অনুরাগী পাঠক-পাঠিকাদের প্রসন্ন করুন।

ইতিমধ্যে শীত এসে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপনারা সবাই সাবধানে  থাকবেন। কেননা শীতের অত্যন্ত প্রিয় সঙ্গীসাথী সর্দি-কাশি-হাঁচি অহেতুক আপনার পেছনে  লাগতেই পারে। সেদিন হোয়াটস অ্যাপে একটা মজার চুটকি পড়ে মুগ্ধ হলাম এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিতরণ করলাম। চুটকিতে লেখা ছিল – ‘জীবনে চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্য অনেককে পাবেন, কিন্তু নাকের জল মুছে দেওয়ার জন্য কাউকে পাবেন না। তাই বলছি... শীত আসছে, সাবধানে থাকুন, ঠান্ডা লাগাবেন না!’

সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। খুশিতে থাকুন। 
        
     
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

      

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

শ্যামাসঙ্গীত বিষয়ে দু-চার কথা, সঙ্গে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ




কালীপুজো
চলে গেলো। সাথে নিয়ে গেলো শ্যামাপোকাদের সঙ্গে প্যান্ড্যালে মন্ডপে কচি মেয়েলি গলায় লঘুসঙ্গীতের ঢঙে গাওয়া শ্যামাসঙ্গীতের ঢল। ভবানীদাস, মৃণালকান্তি ঘোষ, হীরালাল সরখেল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জ্ঞান গোঁসাই তথা জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, নজরুল ইসলাম, বিশেষতঃ পান্নালাল ভট্টাচার্যর গলায় শ্যামাসঙ্গীত শোনা কানে বেশ ধাক্কা লাগায় অনুরাধা পড়োয়ালের এই শ্যামাসঙ্গীত!সঙ্গে ‘ধুনোর গন্ধ’ কুমার শানুর হেঁড়ে গলার শ্যামাগীতি একটু আরো ভালো গাইছেন আসরফ উদাস। সল্টলেকের কৃত্রিম নির্মাণ ছেড়ে ক’গজ পা চালালেই এই আধুনিকায়িত শ্যামাসঙ্গীতের পোয়া বারো! স্লুইস গেট পার হয়ে কয়েকশো ফুট হাঁটলেই, নয়াপট্টিতে, কেষ্টপুরে, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের মহাসমারোহের সাক্ষ্য দেয় অজস্র খাওয়ার দোকান— জিলিপি-বিরিয়ানি-চপ-কাটলেট ছাড়াও যাবতীয় দৈনন্দিন সামগ্রীর। আর এই ‘quotidian’ বা প্রাত্যহিকতায় ভরা জীবনানন্দের সঙ্গত করে বা সঙ্গী থাকে অ-প্রথানুগ, গায়কীবিহীন কালীগান! অনেক দিন ভেবেছি শ্যামাসঙ্গীতের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী! সুর মোটামুটি তিন চার রকমের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যদিও গায়ক বা গায়িকারা নিজের নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী তানকারি, কালোয়াতি, গলার ‘কাজ’ ইত্যাদির মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনায় মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু অন্যদের কথা থাক, আমি আমার নিশ্ছিদ্র নাস্তিকতার মধ্যে কালীপুজোর আগে পরে তো বটেই, সারা বছর ভবানীচরণ, মৃণালকান্তি, হীরালাল, ধনঞ্জয়ের, বিশেষ করে পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীতে মজে থাকি কেন, যার ফলে আমার এক দেশবিশ্রুত, পরমপ্রিয় অধ্যাপক আমার নিশ্ছিদ্র নাস্তিকতার মধ্যে বড় ছিদ্র আবিষ্কার করেছিলেন? কী এমন আছে শ্যামাসঙ্গীতে? একটা কি এই যে অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনী অন্নপূর্ণার কাছ থেকে প্রার্থিত বর চাইতে গিয়ে যে সামান্য আশ্বাসের দাবি করেছিল নিজের সন্তানের ‘দুধেভাতে’ রাখতে পারার, সেটাই শ্যামাসঙ্গীতের গানে গানে পল্লবিত হয়েছে? হয়ে উঠেছে আপামর বাঙালির জীবনের থেকে মোটাভাত, মোটাকাপড়ের এক নিশ্চিন্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, যে আকাঙ্ক্ষা কার্ষ সমাজের জীবনবীক্ষা থেকে উৎসারিত?বাঙালি চিরকাল তার জীবনে কী চায় আর চায় না মা কালীর কাছ থেকে, তার সঙ্গে তা কেন চায়না মা কালীর কাছ থেকে, সে বিষয়ে অনুযোগ/ অভিযোগের বহর এত বেশি যে যে কোনো ধরনের ভক্তিমূলক গানের থেকে শ্যামাসঙ্গীত একেবারে স্বতন্ত্র রয়ে গেছে। কীর্তনের ভবোন্মাদনার থেকে এ সম্পূর্ণ আলাদা জাতের, যতই তাতে দাস্যভাব, সখ্যভাব থাকুককীর্তন কখনোই এত ‘পার্সোন্যাল’ ছিল না বা হয়নি। শ্যামাসঙ্গীত মানেই কালীর সঙ্গে বাঙালির ‘নখড়া’। আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে হাওড়া-হুগলি তথা রাঢ়বঙ্গের কোনো কোনো জায়গায় একে বলা হতো ‘ন্যাংরামো’। এক দিকে কালীকে নিয়ে মাতামাতির, তাঁরপ্রতি ভক্তি-অনুরাগের বাহুল্য (হাওড়া-হুগলি তথা রাঢ়বঙ্গের গ্রামীণ বাংলায় ‘বাহাল্লুতি’), আরেক দিকে কালীর কাছে অনুযোগ, কালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সব মিলে শ্যামাসঙ্গীতের সঙ্গে একমাত্র সাদৃশ্য আছে পৃথিবীতে কেবল একধরনের ভক্তিমূলক গানের, ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-এর সঙ্গে কালীগানের মধ্যে  জন্মমৃত্যুর যে চক্র, সংসারের যাপনের যে অলাতচক্র, তার সঙ্গে নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের যে মিল আছে তার কথা আমি প্রথম জানি বার্ট্রাণ্ড রাসেলের থেকে, যদিও রাসেল জানতেন না পশ্চিমী দর্শনের ইতিহাস বইতে রাসেল ‘অর্ফিক’ গানের প্রসঙ্গে যখন ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-কেআনেন এই প্রসঙ্গে যে অর্ফিক-দের কাছে এই পৃথিবী কেবল যন্ত্রণা ও ক্লান্তি, কারণ আমরা একটা চাকার সঙ্গে বাঁধা যেটা জন্মমৃত্যুর অনন্ত ঘুরণপথে ঘুরছে। কেবল শুদ্ধীকরণের ও বৈরাগ্যের এক কৃচ্ছ্রসাধনের জীবনই এর থেকে মুক্তি দিতে পারে। যে জীবন এই গানের জন্ম দেয় সেটা যে স্বচ্ছন্দ আর সুখপ্রদ নয় সেটা বোঝাতেই রাসেল এনেছিলেন ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-এরএকটিগান, ‘যখনবাড়ি যাবো সব দুঃখের কথা বলে দেবো ভগবানকে’ (‘I’m going to tell God of all my troubles/ When I get home’

পৃথিবীর দুঃখের যন্ত্রণার সম্পর্কে এরকম অনুযোগ, ‘বাবাকে বলে দেবো’ ঢঙে  ঈশ্বরকে বলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পল রবসনের যাদুস্বরেছাড়াও আছে বেয়াত্রিচে রিপির গলায় আর ক্যারল হলিস্টারের পিয়ানো সঙ্গতে একই গানে; যেমন আছে আরো অনেক গানে, যেমন ‘All I do, the church keep a-grumbling;অথবা ‘Sweep it clean/Ain’t going to tarry here; When you see me on m knees/ Come here, Jesus, if you please;Where to go I did not know/ Come along home to Jesus Lord’, কিম্বা মাহালিয়া জ্যাকসনের এই অমর গান

'I’ve been 'buked
… …
Children,
I've been 'buked and I've been scorned
Tryin' to make this journey all alone
You may talk about me sure as you please
… …
Children, talk about me sure as you please
Your talk will never drive me down to my knees
Jesus died to set me free
… … Children Jesus died to set me free
Nailed to that cross on Calvary’.

যদিও এই গানটিরও অনেক অন্য রূপ আছে, যেমন অ্যালভিন অ্যালির গানে, আবার নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের অফিসিয়াল সাইটে আছে এরকম আরেকটা গান, ‘I’ve been ‘buked and I’ve been scorned/ And I’ve been talked ‘bout as sure as you’re born/ And my soul looked back and wondered/ How I got over, my Lord Dere's room enough … / Room enough in de heaven, my Lord … / I can't stay behind


কিন্তু তবুও ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল-এর থেকে শ্যামাসঙ্গীতে বৈচিত্র্য অনেক বেশিনিগ্রো স্পিরিচুয়াল-এ আমরা দেখি দাসজীবনের অজস্র যন্ত্রণার মধ্যেও অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান ক্রীতদাসের তরফে ঈশ্বরের তথা যীশুর প্রতি অটল অনুরাগ, ভক্তি, প্রেম, আর সমর্পণই ফুটে ওঠেশ্যামাসঙ্গীতে কিন্তু এই সমর্পণ একমাত্র সুর নয়। কালীকে নিয়ে বাহাল্লুতি, কালীর কোলে ওঠার, তাঁর সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রায় জরায়ুজ আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি আছে তাঁর প্রতি তীব্র অভিযোগ, এমনকে তাঁর স্নেহাশ্রয়কে বর্জন করার ইচ্ছা, যদিও সবের পিছনেই আছে শেষে তাঁরই শরণ নেওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প। 




শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন অনেক প্রসিদ্ধ ভক্ত গায়ককবি— রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়), কৃষ্ণচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরুঠাকুর, রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), কালী মীর্জা, দাশরথি রায় (দাশু রায়),ছাড়াও কিছু মুসলিম কবি! কিন্তু যে অনুযোগ, অভিযোগ, আবদার, কটূক্তি শ্যামাসঙ্গীতের এই বহুস্তরীয় বৈচিত্র্যকে নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের থেকে অনেক উপরের স্তরে নিয়ে গেছে তার সুলুক সন্ধানসব রচয়িতার গানে নেই, যে কারণে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা সাধক কমলাকান্ত-কেরামপ্রসাদের অনেক উপরে রাখলেও আমি রাখি না! অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কমলাকান্তের ভণিতায় প্রায় তিনশ পদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি ... রামপ্রসাদের চেয়েও কাব্যাংশে উৎকৃষ্ট।’ হতে পারে। কিন্তু উমার গান শাক্তপদাবলীর মধ্যে পড়লেও কোনোভাবেই শ্যামাসঙ্গীতের গোত্রে পড়ে না। কমলাকান্তের শ্যামাসঙ্গীতের গানগুলি নিঃসন্দেহে কালীর প্রতি ভক্তিময়তার সুন্দর প্রকাশ। যেমন অসিতকুমারেরই উদ্ধৃতিতে ‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমোহিনী গো মা/ তুমি আপন সুখে আপনি নাচ আপনি দাও মা করতালি’, কিম্বা ‘শুকনো তরু মঞ্জুরে না ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে।/ তরু পবনতলে সদাই দোলে প্রাণ কাঁপে মা থাকতে গাছে’, অথবা ‘মজিল মনভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে।/ যত বিষয়মধু তুচ্ছ হৈল কামাদি কুসুম সকলে’। কিন্তু কালীর প্রতি অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগ, আবদার,কটুকাটব্যের যে বান ডেকেছে রামপ্রসাদের গানে, কমলাকান্তে তা কোথায়? অসিতকুমার তো নিজেই লিখেছেন, রামপ্রসাদের ‘নিরাভরণ প্রেমের বাণী ... সাদা কথায় ধরা পড়েছে। শ্যামার সঙ্গে তাঁর মা-ছেলের সম্পর্ক, মান-অভিমানের সম্পর্ক— এমনকি কটু কথার সম্পর্ক। ... তাঁর পদ আশাহীন মানুষের সান্ত্বনাস্থল, বাস্তব দুঃখের একমাত্র প্রতিষেধক। তত্ত্বসাধনার সঙ্গে বাস্তব জীবন ও সুখদুঃখের এমন নিবিড় সংযোগ অন্য কবির খুব অল্প পদেই পাওয়া যায়। ... রামপ্রসাদের গান বৈকুণ্ঠের গান নয়, তার সঙ্গে ধূলি ও ধরিত্রীর নিবিড় যোগ আছে বলে আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়েও তার কাব্যরস উপলব্ধি করা যায় — যে কাব্যরস বাস্তব জীবনকে অবধারণ করে আছে’ কিন্তু অন্য কবি বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন অসিতকুমার? কেবল বাংলায়? ভারতবর্ষে? না পৃথিবীতে? নিগ্রো স্পিরিচুয়ালে এ সম্পদ নেই, আর আমার সীমিত জ্ঞানে ল্যাটিন আমেরিকায় বা আমাদের এই ভারতবর্ষেও ‘লিবারেশন থিয়লজি’র গানেও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অভিযোগের এই সম্পদ নেই। আর রামপ্রসাদের বলতে কাকে বোঝচ্ছি আমরা? অসিতকুমার জানিয়েছেন, কিন্তু তিনি বলার আগেই আমরা তো জানি যে হালিশহরের রামপ্রসাদ (আঃ ১৭২০/২১-১৭৮১) ছাড়াও দ্বিজ রামপ্রসাদ নামে পূর্ববঙ্গের এক সমসাময়িক পদকার অনেকগুলি চমৎকার গান লিখেছিলেন। অসিতকুমার জানাচ্ছেন ‘এখন রামপ্রসাদের পদাবলী বলে যে সঙ্গীতসংগ্রহ ছাপা হয়ে থাকে, তাতে দ্বিজ রামপ্রসাদ ভণিতাযুক্ত যে সমস্ত পদ স্থান পেয়েছে তা অবিকল রামপ্রসাদ সেনের গানের মতোই। কাজেই শুধু ভাষা দেখে কোন্‌টি রামপ্রসাদ সেনের আর কোন্‌টি দ্বিজ রামপ্রসাদের তা নির্ণয় করা যায় না।’ উপরন্তু ‘রামপ্রসাদ চক্রবর্তী নামে আর এক জন আধুনিক কালের কবিওয়ালাও অনেক পদ লিখেছিলেন এবং শুধুই “রামপ্রসাদ” ভণিতা ব্যবহার করেছিলেন। ... এতে গোলমালের কারণ বেড়েই গেছে’২ যেটা এক্ষেত্রে ভাবার কথা সেটা হলো রামপ্রসাদ চক্রবর্তীকে নয় ছেড়েই দিলাম, সেই সময় বাংলাদেশের দুই প্রান্তে একই রামপ্রসাদ নামধারী দুই কবি কী করে মা কালীকে নিয়ে একই রকমের মান-অভিমানের, অভিযোগ-অনুযোগের কবিতা লিখলেন? উৎসের বিভিন্নতাই তো ব্যক্তিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার বিরোধিতা করছে! সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির কোন গহন গোপন থেকে উঠে এলো এই গলাচেরা আবেগ? তবে কি ১৭৩৯-এর বিশাল প্লাবন/বন্যা, ১৭৪২-৫২-র বর্গী আক্রমণ, ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানির বিজয়ের থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, ১৭৬৯-এর মন্বন্তর এই সবের ফলে বাঙালির কার্ষ সংস্কৃতির যে টালমাটাল আর তার থেকে আসা বিপন্নতা সেটাই রামপ্রসাদদের কলমে উঠে এলো? হতেই পারে! ভবানীচরণ দাসের গাওয়া ‘অন্নদে অন্নদে গো,/ অন্ন দেঅন্নদে,/ অন্ন দাও।/ জানি মায়ে দেয় ক্ষুধায় অন্ন,/ অপদা বিপদিলে পদে পদে,/ অন্ন দে।/ মোক্ষপ্রসাদ দাও অম্বে,/ এ সূতে অবিলম্বে মা/ জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা/ কাতরা হয়ো না প্রসাদে।’ এই অসাধারণ গানে রামপ্রসাদ যেভাবে দৈহিক ক্ষুধা আর আধ্যাত্মিক অশনায়াকে মিলিয়ে দিয়েছেন তার পিছনে পটভূমি যে মন্বন্তর ছিল না বিশ্বাস করতে মন চায় না। শারীরিক ক্ষুধাকেই উত্তীর্ণ করতে চেয়েছেন রামপ্রসাদ আধ্যাত্মিক নিবৃত্তিতে।  



কিন্তু কারুর, এমনকি  অসিতকুমারের মুখেও, ঝাল না খেয়ে আমরা রামপ্রসাদের গানগুলির দিকেই তাকাই না! ঈশ্বরী পাটনীর সেই ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’  আকাঙ্ক্ষা আরেক শাক্ত কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের হাত থেকে যে অন্নদামঙ্গলেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো একথা যে জানে না সে তো বাঙালিই নয়! সেই কথাই কত না পল্লবিত হয়ে কতকোটি বাঙালির অধ্যাত্মসাধনার কিম্বা অনধ্যাত্মসাধনার মর্মবাণী হয়ে উঠেছিলো! পান্নালালের গলায় এই গানটির ভিতরের কথা কত গভীর? তল মেলে না।


চাই নাগো মাগো রাজা হতে
রাজা হবার সাধ নাই মা গো
দুবেলা যেন পাই মা খেতে
চাই নাগো মাগো রাজা হতে

আমারমাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
পাই যেন তায় খড় যোগাতে মা
মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
পাই যেন তায় খড় যোগাতে
আমার মাটির ঘর যে সোনার ঘর মা (২)
ও মা কী হবে দালানেতে
যদি দালান কোঠায় রাখো মা
পারবো না আর মা বলিতে
চাই নাগো মাগো রাজা হতে

যদি দ্বারেতে অতিথি আসে মা
না হয় যেন মুখ লুকাতে
ঘরে কাঁসার থালা কাঁসার বাটি মা
পায় যেন তায় দুটো খেতে। 
তোর সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা
তাই পারি না ছেড়ে যেতে
কেবল কেবল রামপ্রসাদের এই বাসনা
পাই যেন স্থান ঐ পদেতে।।

এই গানের ক্লাইম্যাক্স ‘তোর সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা/ তাই পারি না ছেড়ে যেতে’ আমাকে কেন যেন চিরকাল মনে করিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই গান ‘আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি’। নিজের সংসারের অনেক ঝড় ঝাপটায় মন যখন ডানাভাঙা পাখির মত অবসাদে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে তখন এই গান আর তার এই তুঙ্গভাব যেমন অনেক বাঙালিকে  আবার প্রেরণা যুগিয়েছে তেমন আমাকেও। কিন্তু কেবল এই স্বচ্ছন্দ দিনযাপনের কথা বলে চুপ যাওয়ার বান্দা রামপ্রসাদ নন, তা তিনি সেনই হোন আর দ্বিজই হোন। পৃথিবীতে আর কোথায় সাধক তাঁর ঈশ্বরকে বলতে পেরেছেন ‘দে মা আমায় তবিলদারী।/ আমি নিমকহারাম নই শংকরী/ দে মা আমায় তবিলদারী।/ পদরত্ন সবাই লুটে মা ইহা আমি সইতে নারি।/ তবে ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা সে যে ভোলা ত্রিপুরারি’, তাঁর দৌড় তো আবেদন নিবেদনে শেষ হবার নয়, যতই কেন শেষে তবিলের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা এসে যাক। কখনও কবি দুঃখের দায় চাপিয়ে দিয়েছেন শ্যামার উপরই — ‘মন-গরীবের কি দোষ আছে।/ তুমি বাজিকরের মেয়ে শ্যামা, যেম্নি নাচাও তেম্নি নাচে’।


ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক জননী যদি দুঃখ দেন তবে সন্তানও তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে না কেন! প্রসাদ তাই সগর্বে বলছেন, ‘আমি কি দুঃখেতে ডরাই/ ভবে দাও মা দুঃখ আর কত চাই।।/ আগে পাছে দুখ চলে মা যদি কোনখানেতে যাই/ তখন দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে দুখ দিয়ে মা বাজার মিলাই।।’ কালী একটু জিরোতে হবে, দুঃখের বোঝা তুলে নিতে হবে না। ‘প্রসাদ বলে ব্রহ্মময়ী বোঝা নামাও ক্ষণেক জিরাই।/ দেখ সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে আমি করি দুখের বড়াই।।’কিন্তু সন্তান দুঃখ নিতে শিখে গেছে বলেই মায়ের দোষ কমে যায় না।ঈশ্বর কারুণিক হলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, অন্যায় কেন এ নিয়ে খৃষ্টধর্মের যে চর্চা তারই তাত্ত্বিক নাম  theodicy এই পদাংশটিতে রামপ্রসাদ সোজাসুজি অভিযোগ করছেন বিশ্বনিয়ন্তার বিরুদ্ধে। ‘মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো।/ ওমা মিঠার লোভে তিত মুখে সারা দিনটা গেল।।’

সংসারের দিনযাপনের গ্লানিতে বিপর্যস্ত রামপ্রসাদ যখন বলে ওঠেন, ‘মা আমায় ঘুরাবি কত?/ কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত।।/ ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত।/ তুমি কি দোষে করিলে আমায় ছ’টা কলুর অনুগত।’, তখন কী কৌশলে জন্মমৃত্যুর নিশ্ছিদ্র অলাতচক্রের ডিস্কোর্সকে রামপ্রসাদ জুড়ে দেন তাঁর সামাজিক প্রতিষ্ঠার দৈন্যের গপ্পোর সঙ্গে!

কিন্তু এই সব কথা কি কেবল রামপ্রসাদ সেনই বলেছেন? দ্বিজ রামপ্রসাদের এই পদটিও কম কিসে?

করুণাময়ী! কে বলে তোরে দয়াময়ী।
কারো দুগ্ধেতে বাতাসা (গো তারা)
আমার এম্নি দশা শাকে অন্ন মেলে কৈ?
কারো দিলে ধন জন মা, হস্তী অশ্ব রথচয়।
ওগো তারা কি তোর বাপের ঠাকুর,
আমি কি তোর কেহ নই?
কেহ থাকে অট্টালিকায় মনে কই তেম্নি হই।
মাগো আমি তোর পাকা ক্ষেতে দিয়াছিলাম মই?
দ্বিজ রামপ্রসাদ বলে আমার কপাল বুঝি অম্নি অই।
ওমা, আমার দশা দেখে বুঝি শ্যামা হলে পাষাণময়ী

কিম্বা সব ভোগার শেষে শ্যামার নিজের প্রতি ছদ্ম হতাশার কবিরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ছবিতে একটা গান শুনেছিলাম, সেটা ধনঞ্জয়ের গলায়ও আছে একটু অন্য সুরে, মা মা বলে আর ডাকবো না/ দিয়েছ দিতেছ কতই যন্ত্রণা।/ ...  দ্বারে দ্বারে যাব ভিক্ষা মেগে খাবো,/ মা বলিয়ে আর কোলে যাবো না।’ এই গান নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের অন্য মেরুর। যেমন রাজা নরচন্দ্র রায়ের একটি গান —

যে ভালো করেছ কালী আর ভালতে কাজ নাই।
এখন ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই।
মা তোমার করুণা কত বুঝিলাম অবিরত।
জানিলাম শতশত কপাল ছাড়া পথ নাই।
জঠরে দিয়েছো স্থান করো না অপমান।
এখন কিসে হবে পরিত্রাণ নরচন্দ্র ভাবে তাই। 

আসলে বাংলায় কোনো এক সময়ে রাজা থেকে ভিখারী গেয়েছে এই গান। মায়ের কোলে শুয়েই মাকে কটুবাক্য শোনাবার গান। স্লুইস গেট পার হয়ে কয়েকশো ফুট হাঁটলেই, নয়াপট্টিতে, কেষ্টপুরে, সারা বাংলায় খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের সাথীও এই গান। নয়া উদারনীতিবাদের জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত মানুষ গাইছে। তাদের এই ভালোবাসা টের পেয়েই মুম্বইএর গায়ক/গায়িকারাও রেকর্ড করছেন এই গান। মূলতঃ রামপ্রসাদের কিন্তু অন্যদের রচিত পদেও এই অভিযোগের গানের সমাজ চিন্তাকে তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো বারান্তরে, যদি কাজলবাবু অনুমতি দেন।

গ্রন্থসূত্র
Bertrand Russell, History of Western Philosophy(New York: Simon and Schuster, 1972), p. 21.
https://www.youtube.com/watch?v=- eQWkJej1xs, ২৫শে নভেম্বর ২০১৬ প্রবিষ্ট।
৩। https://www.youtube.com/watch?v=YZJT2wcv9iI, ২৫শে নভেম্বর ২০১৬ প্রবিষ্ট।
৪।অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত  (কলকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সী, ১৯৬৬/১৯৯৮-৯৯), পৃঃ  ২৪০-৪৮







শিবাংশু দে

কখন কী রঙ্গে থাকো মা




বিষয় হিসেবে দেবী কালী বেশ অভিনিবেশ আকর্ষণ করেন। নানা কারণে দেবতাকুলে তাঁর প্রতাপ প্রশ্নহীন। ভক্তসংখ্যার বিচারেও তিনি বঙ্গদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আসলে এই দেবীকল্পনাটি এদেশে অপ্রতিহতভাবে পুনর্জীবিত হয়ে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন যুগধর্মকে আত্মস্থ করে। ফলত বারবার তাঁর রূপান্তর ঘটলেও ‘মহাদেবী’ হিসেবে তাঁর মর্যাদার ক্ষয় হয়নি কখনও। শক্তিপূজার ঐতিহাসিক পরম্পরাকে তিনি প্রায় একাই ধরে রেখেছেন। তাঁরা আগে বা পরে কল্পিত দেবীমহিমাগুলি কালের নিয়মে হয়তো ম্লান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাকি সব দেবীসত্ত্বাকে দেবী কালী নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিতে  পেরেছিলেন অনায়াসে। আমাদের সমন্বয়ের সংস্কৃতিতে এটা একটা আবশ্যিক শর্ত। সিন্ধুসভ্যতা থেকে আজকের আন্তর্জাল যুগ পর্যন্ত তাঁর ক্রমবিকাশের ধারা যদি অনুসরণ করি, তবে নানা কৌতুহল জাগানো তথ্য উঠে আসে।

হরপ্পার বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব উপাস্যা দেবীর মূর্তি দেখে তাদের বিভিন্নতা অনুমান করা যায়। কল্লি উপজাতির দেবী (২৫০০-২০০০ খ্রী পূ), ঝব উপজাতির দেবী(২৫০০-২০০০ খ্রী পূ) বা সামগ্রিকভাবে হরপ্পা সংস্কৃতির দেবী (২০০০ খ্রী পূ), এঁদের মূর্তি প্রজননতন্ত্রী মাতৃদেবীর লক্ষণাক্রান্ত লক্ষ্যনীয়, এই সব প্রাকৃতিক প্রজননশীলতার প্রতীক দেবীমূর্তি শুধু অনার্য জনগোষ্ঠীর উপনিবেশ থেকেই পাওয়া গেছেঅবশ্য ঝব সংস্কৃতিতে লিঙ্গপ্রতীকের উপস্থিতিও রয়েছেএই সব দেবীমূর্তির সঙ্গে পৌরুষের প্রতীক হিসেবে শুধু বৃষভ অবয়বের সংযোজন করা হয়েছিল, নতুবা এঁদের কোনো পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা করা হয়নিঅস্তিত্বের বিচারে  তাঁরা সম্পূর্ণা ও স্বাধীনাআর্য প্যান্থিয়নে কিন্তু এমনটি ভাবা যায় না


অনার্যদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থাকলেও সেটাই যে মাতৃপূজা বা শক্তিপূজার প্রধান কারণ, তা নয়। অনেক পিতৃতান্ত্রিক সমাজেও শক্তিপূজার প্রচলন  দেখা যায়। যেমন আমাদের দেশের মহিষমর্দিনী দেবীর পূজা প্রচলিত হবার বহু আগে ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপে, বিশেষতঃ ক্রিট দ্বীপে এক সিংহবাহিনী পর্বতবাসী (পার্বতী) দেবীর পূজা প্রচলিত ছিলরপ্পাযুগ থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত ভারতীয় কুলীন সমাজে মাতৃদেবীরা পাত্তা পান'নি। সরস্বতী ব্যতিরেকে (অবশ্যই অন্য কারণে) সমস্ত দেবীমূর্তিই অনেক পরের সংযোজন, আর সবাই এসেছেন বিভিন্ন পুরুষ দেবতার  সঙ্গিনী হিসেবেউল্লেখযোগ্য, আর্যচিন্তায় যেসব দেবী কল্পনায় মাতৃভাবের অনুষঙ্গ রয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃতির প্রজয়িতাসত্ত্বা যে সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছে, সেই সব দেবীই মূলতঃ অনার্য কল্পনার ফসল। নারীর প্রজনন ক্ষমতাকেই ‘শক্তি’ আখ্যা দিয়ে  দেবীরূপে কল্পনা করা হতো। কিন্তু আর্য দেবতাদের সঙ্গিনী দেবীরা নিজ পরিচয়ে স্বনির্ভর ছিলেন নাতাঁরা সবাই সঙ্গী পুরুষ দেবতার শক্তিরূপিণী হয়ে পূজিতা হতেন মূলতঃ অনার্য দেবতা, পরে আর্যস্বীকৃত, শিবের সঙ্গিনী হিসেবে যে সব দেবী কল্পিত হয়েছিলেন তাঁরা পার্বতী, মহাদেবী, সতী, গৌরী, অন্নপূর্ণা, দুর্গা, কালী এবং চন্ডীঅর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থায় স্বাধীনা অনার্য দেবীদের ক্ষমতা খর্ব করে তাঁদের শুধু পুরুষ দেবতাদের শক্তির আধার হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। অবশ্য শুধু ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাতে কেন, মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালযান, সহজযান এ সব বৌদ্ধ ব্যবস্থাতেও দেবীরা সমান্তরালভাবে পুরুষদেবতার ‘সঙ্গিনী’ হিসেবেই পর্যবসিত হয়ে ছিলেন।  


ঘটনাক্রমের এমত বিকাশে শেষ পর্যন্ত সমস্ত শাক্ত শাস্ত্রেই দেখি শক্তির কোনও একক গরিমা নেই। তিনি ‘শিব’রহিত হতে পারেন না, তাঁর যাবতীয় মহিমা শিবসহিত।  আবার শুধু শিব নয়, বহু স্থানে দেখা যাচ্ছে তিনি বিষ্ণুরও সঙ্গিনী। অর্থাৎ কোনও  পুরুষমাত্রা ছাড়া শক্তি পূর্ণ মর্যাদা লাভ করতে পারছেন না। আসলে প্রকৃতিবাদী প্রাক ও মূল বৈদিক ধর্মে যাবতীয় ঐশীশক্তি (অর্থাৎ ভৌত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি, যেমন অগ্নি, মরুৎ, বরুণ প্রভৃতি) পুরুষ দেবতা হিসেবেই কল্পিত হয়েছিলকিন্তু অনার্য সংস্কৃতিতে শক্তিকে ‘ভগবতী’ অর্থাৎ ‘ভগবানে’র নারী সংস্করণ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে আর্যরা যখন উপলব্ধি করেছিল এদেশে ‘অনার্য’দের, অর্থাৎ মূল  কৌম অধিবাসীদের অধ্যাত্ম ঐতিহ্য তাদের থেকে কোনও অংশে ন্যূন তো নয়ই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার প্রভূত ব্যপ্তি রয়েছে, তখন চতুর আর্যব্যব্স্থা সঙ্গতভাবেই ‘অবহেলিত’ ও ‘উপেক্ষিত’ অনার্যমননের সঙ্গে অধ্যাত্মস্তরে সমন্বয়ের প্রয়োজনের প্রতি  মনোযোগী হয়আর্য দেবতার প্যান্থিয়নে রুদ্রের পরিবর্তে শিবের অভিষেক এবং তাঁর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে বিভিন্ন প্রচলিত ও নতুন শক্তি দেবীরা আর্য মূলস্রোতের মধ্যে এভাবেই আত্তীকৃত হয়েছিলেনএই সময় ভারতভূখন্ডে যে যে সামাজিক তোলপাড় ঘটেছিল, সেখানে কৌম জনতার ভিতরে বৈদিক ভাবধারা এবং ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের দুর্গে মাতৃতান্ত্রিক অনার্য উপাসনা পদ্ধতি, মসৃণভাবে প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী স্রোতের সঙ্গম থেকে উঠে এসেছিল একটি অধ্যাত্মব্যবস্থা, যাকে সামগ্রিকভাবে সংক্ষেপে তন্ত্রসাধনা বলা হয়।

দেবী কালী অন্য সব দেবতাদের থেকে যে লক্ষণে প্রকটভাবে পৃথক হয়ে যান, তা হলো তাঁর সামগ্রিক রূপকল্পনা


সব সভ্যতাতেই মানুষ দেববিগ্রহের রূপরেখা নিজের আদলেই নির্মাণ করেবিভিন্ন অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয়ে বহু পার্থক্য থাকলেও ত্বকের বর্ণ অনুযায়ী তাঁরা সবাই ছিলেন মেঘবর্ণ। তাই তাঁদের কল্পিত দেবদেবীরাও তাঁদের নিজেদের মতো শ্যামলবর্ণ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। অসংখ্য অকুলীন বা অমুখ্য ইতরযানী দেবদেবীদের কথা যদি ছেড়েও দিই, নীলাচলের নিষাদজাতির আরাধ্য দেবতা জগন্নাথ এবং মূলতঃ বাংলা ও অসমের কৌমজনতার আরাধ্যা দেবী কালী তাঁর নানা অবতারে বিবিধ রূপে থাকলেও বর্ণবিচারে ঘোর কৃষ্ণই থেকে গিয়েছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে বেদের রাত্রিসূক্তকে কেন্দ্র করে যে রাত্রিদেবীর কল্পনা পরবর্তীকালে দেখা যায়, তিনিই এই  কালিকারূপিণী দেবীর পূর্বসূরি। শতপথ ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কৃষ্ণা ভয়ঙ্করী যে নৈঋতি দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের কালী দেবীর সঙ্গে তার বিশেষ মিল রয়েছে। শতপথ ও ঐতরেয়তে এই দেবীকে কৃষ্ণা, ঘোরা ও পাশহস্তা বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকের প্রথমভাগে সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’তে ভাসোক নামে এক কবি  কালীর বর্ণনায় লিখেছেন,

‘ক্ষুৎক্ষামহকান্ডচন্ডী চিরমবতুতরাং ভৈরবী কালরাত্রি’।।

সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে (এই সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে) বাঙালি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীধারণার যে রূপ ও প্রকৃতিকে লিপিবদ্ধ করেন, সেটাই  বাংলাদেশে কালীদেবীর স্বীকৃত মডেল। এই দেবীই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের তন্ত্রসাধনা ও মাতৃপূজার আরাধ্যা হয়ে যান। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুন্ডমালাবিভূষিতা। অধো বাম-হস্তে সদ্যচ্ছিন্ন শির ও ঊর্দ্ধহস্তে খড়্গ। অধো দক্ষিণহস্তে অভয় ও ঊর্দ্ধহস্তে বর। দেবী মহামেঘের মতো শ্যামবর্ণা। তাই বাংলাদেশে এই দেবীর নাম ‘কালী’ নয়, ‘শ্যামা’ ইনি দিগম্বরী, ঘোরদ্রংষ্টা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা, ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী, শ্মশানগৃহবাসিনী। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা, শিবাকূল দ্বারা চতুর্দিকে সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সঙ্গে বিপরীতরতাতুরা, সুখপ্রসন্নবদনা ও স্মেরাননসরোরূহা।


মহানির্বানতন্ত্রে দেবী কালীর (বা শ্যামার) উল্লেখিত রূপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ‘ব্রহ্মযামলে’র আদ্যাস্তোত্রে আদ্যাদেবী কোন কোন দেশে কী রূপে পূজিতা হন তার  বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী  কালিকারূপেই পূজিতা হন। যদিও তন্ত্র আরাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক গুহ্যসাধনপদ্ধতি ছিল, কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এই শ্যামামূর্তির, প্রকাশ্যে, অর্থাৎ জনগণের সমক্ষে মন্দিরে ও ব্যক্তিগত গৃহস্থ পরিসরে নিত্যপূজা প্রচলিত হয়েছে। এই নিত্যপূজা ছাড়াও বাৎসরিক দীপাবলী উৎসবের রাত্রে যে শ্যামাপূজা আজ আমরা দেখতে পাই, তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৬৮ সালে  রচিত কাশীনাথের ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিতে বাংলাদেশে কালীপূজা করার  পক্ষে মানুষকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরিত করা হয়েছিলএর থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের আগে এদেশে কালীপূজা তেমন প্রচলিত ছিল না। আর একটি কিম্বদন্তী আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বাধ্যতামূলকভাবে প্রজাদের কালীপূজা করতে আদেশ করেছিলেন। এর ফলেই বাংলাদেশে কার্তিকের কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতে শ্যামা ও মাঘের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে রটন্তী নামে কালীপূজার প্রচলন হয়েছিল


এভাবেই ক্রমপর্যায়ে অনার্য রমণীর রূপকল্পে নির্মিত শক্তিরূপা মাতৃদেবী নিশ্ছিদ্র ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মদুর্গে নিজের স্থান শুধু করে নিলেন তাই নয়, এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে ব্রাহ্মণ্য পুরুষ দেবতাদের প্রভাব খর্ব করে নিজের রাজত্বও স্থাপন করলেন। মহানির্বাণতন্ত্র ও ব্রহ্মযামলে দেবীর কৃষ্ণবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা দার্শনিক রূপকের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বর্ণ কৃষ্ণা অনার্যমাতৃকার স্বীকৃতিমাত্র।

ইতিহাসের কোন সময়কাল থেকে দেবী কালী শক্তি আরাধনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করলেন, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। যদি দেবীপুরাণ (সপ্তম-অষ্টম শতক) মানি, তবে জানা যাচ্ছে, রাঢ়া-বরেন্দ্র-কামরূপ-কামাখ্যা-ভোট্ট দেশে (তিব্বত) বামাচারী শাক্তমতে দেবীর পুজো হতো। তাহলে এর সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, সপ্তম-অষ্টম শতকের আগেই বাংলাদেশে শক্তিপূজার প্রচলন হয়ে গেছিল। এর  কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তোত্তর যুগে উজ্জয়িনী কেন্দ্রিক মধ্য-ভারতের ইতিহাসে। যেখানে জয়দ্রথ-যামল গ্রন্থে ঈশান-কালী, রক্ষা-কালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী প্রভৃতি নানা রূপের কালীর বর্ণনা আছে। এছাড়া ঘোরতারা, যোগিনীচক্র, চক্রেশ্বরী প্রভৃতিরও উল্লেখ আছে। অতএব বোঝা যাচ্ছে আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শাক্ত আরাধনার উৎসভূমি শুধুমাত্র বাংলা নয়। তা গুপ্ত বা গুপ্তোত্তর যুগে পশ্চিম ও মধ্য ভারত থেকে এসেছিল যার প্রমাণ, আগম ও যামল গ্রন্থগুলি। তবে এটা স্বীকৃত ঐ আগম বা যামল গ্রন্থের ধ্যান ও অন্যান্য কল্পনার থেকেই বাংলা দেশে বিস্তৃত তন্ত্রসাহিত্য ও ধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলযদিও দ্বাদশ শতকের আগে কোনও তন্ত্র-গ্রন্থের প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পাল-চন্দ্র-কাম্বোজ লিপিমালা বা সেন-বর্মণ লিপিমালাতে গুহ্য তন্ত্র সাধনার স্পষ্ট উল্লেখ যদিও নেই, কিন্তু তৎকালীন শাক্ত ধ্যান  ধারণায় তান্ত্রিক ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। পালযুগের অসংখ্য শক্তিরূপা দেবীমূর্তি কিন্তু তন্ত্রোক্ত দেবী নয়, সেগুলি শৈবধর্মের আগম ও যামল অনুসারে কল্পিত শিবশক্তি মূর্তি। শৈব ধর্মের শক্তি ও শাক্তধর্মের দেবী পাল যুগ থেকেই পৃথক। বঙ্গদেশে পরবর্তীকালের কালীধারণা কিন্তু অতীতের বিচ্ছিন্ন দেবীকল্পনার বিবিধতাকে সমন্বিত করে এক ‘মহাদেবী’ রূপকল্পকে স্পষ্ট করে তোলার প্রচেষ্টায় প্রয়াসী হয়েছিল


তাঁকে মানুষ নানারূপে কল্পনা করেছে নিজস্ব মনের মাধুরী মিশিয়ে। সাধক কমলাকান্ত বলেছিলেন, “তুমি কখন কী রঙ্গে থাকো মা, শ্যামাসুধাতরঙ্গিনী / এই রঙ্গভঙ্গে অনঙ্গ অপাঙ্গে ভঙ্গ দাও মা জননী”।। যাবতীয় বিচিত্রমুখী ক্রমবিকাশকে আত্মস্থ করে ‘মহাদেবী’ হিসেবে এই মুহূর্তে দেবী কালীর স্বীকৃতি শুধু যে সর্বসম্মত তাই নয়,  প্রকৃতিপূজার সর্বাধিক প্রভাবী বিগ্রহ হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি আজ এদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।


শাপলা সপর্যিতা

লখিন্দরের গান আর অশ্রু পার্বণের সাথে কিছুদিন




মরণ চির প্রিয়তরের মতো জীবনের গভীরে ব্যাপ্ত হয়ে বসেছিল আমার প্রাণের ঠাকুরের কাছে তাই তাঁর কাব্য রচনার ধারে কাছে মরণের ছিল অবিরত বাস ঠেকাতে পারেন নি তিনি তারে কিংবা ঠেকাতে চাননি আজ আমিও লিখতে বসলে কীভাবে যেন সেই মরণ এসে গড়াগড়ি যায় পায়ের কাছে আমি নিত্যই ভাবি, আসলে কি আমার আজীবন ঠাকুর পাঠের সজ্ঞান? নাকি জীবনের অনেক বেলা পার হয়ে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি যেদিকে তার প্রতি গভীর দৃকপাত! নিশ্চিত হয়ে গেছে যার অবস্থান অবিরত জীবনের পরতে পরতে তারেই আদরে সাদরে সম্ভাষণে জীবনের আনন্দে বিষাদের সাথে লয়ে এক অদ্ভুত রস আস্বাদনের অপচেষ্টা! অপচেষ্টা এজন্য যে, তাঁরই মতো করে এমন ভাষায় বর্ণমালায় কে পারে, গভীরে বোধে কে আর পারে, মরণরে জীবনেরও আরো আরো উঁচুতে দিতে সঠিক অবস্থান তবু পড়ি। শুরু করি এক নতুন বই, নতুন কবিতা। নিঃশেষে আগাই আরও এক অসাধারণ পাঠের দিকে তার শুরুই হলো সেই চির পরিচিত মরণরে সাথে লয়ে। মুগ্ধ বিস্ময়ে  অসাধারণ সব শব্দ উপমা আর দারু মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দুর্দান্ত কম্পোজিশনে দেখি মরণের আর এক রূপ যা মাটির সাথে শেকড়ের সাথে চিরকালের প্রবহমান জীবনের সাথে জীবনেরও অধিক সম্ভাষণে বিরাজে বিষাদে আনন্দে... 

এখানে মরণ/অস্থির গায়ে/দনকলসের/পাতা - ///
বাকল খুলেছে/মহাকাল ঋষি,/ভেষজের নীল/ছাতা///
মাটির ডেরায়/ডিমের আদল,/ঘুমাও পরম/গুরু ///
তোমাকে ফোটাই/দাদাজান পাখি/এখানে তাবৎ/শুরু/// (পরম্পরা)


এই মহাকাল, ঋষি, এই দাদাজান পাখি শব্দগুলো আমারে তাড়িয়ে নিয়ে চলে আমি কোথায় হারাই! আমার সুগভীর চৈতন্যেরও সীমারেখা ভেদ করে কতদূর --দূ-র্   বহুদূর! আর কোথায় বা ব্যপ্ত হয় আমার ভাবনা শুধু টের পাই চলে যাচ্ছি কোনো এক নিশ্চিত নির্দিষ্ট শেকড়ের কাছাকাছি যেখান থেকে শুরু আর যেখানে গিয়ে শেষ

পরম্পরা কবিতাটির নাম অর্থাৎ জীবন জীবন বংশানুক্রম জানিনা কবির কি  লা আছে হয়তো আমার সাথে আছে তার বোধের বিস্তর পার্থক্য কিন্তু সাহিত্যে  রিসেপশন থিওরী বলেও তো একটা কথা আছে আমি এক অকালপক্ক রিসেপ্টর কিছুটা বা নির্বোধও আমি দেখি এখানে এক হতে আর এক বংশানুক্রমিক চির প্রবহমানতা মানুষের বোধের চিন্তার ভাবনার প্রাত্যহিক জীবনের কাজের শ্রেণিগত বিভেদ আর সাজুয্যের এক অসাধারণ পরম্পরা সেই মনুসংহিতা থেকেশুরু হয়েছিল,  যার কাল চর্যাপদ বেয়ে যুগে যুগে বদলে গেছে সে আত্মা কত না কতই রূপে প্রকাশিত হয়েছে তার কর্মযজ্ঞ আবার কখনো বা হয়েছে অন্তরি অন্য আরও এক দারুণ অরূপে সাথে আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্তের দারুণ ছন্দোবদ্ধ বাঁধন দুর্দান্ত এক  অপরূপে বেঁধেছে তারে, অন্তত আমার পাঠের আনন্দে যোগ করেছে এক আনন্দপ্রদ  অসাধারণ মাত্রা-

আপন দীক্ষার মাছি করো, কিম্বা ওড়ার সাধক
সুফলা অনার্যা কবি চেটেপুটে অমৃতের ত্বক
কাহ্নপার জিভ হই সান্ধ্যবোলে ভন-ভন ভন
সাতপুরুষের জমি নেই; চামে এখানে লুণ্ঠন
চর্যার ভিটায় বসে গুম হই গীতল ভুসুক
মরমে পরমটুকু গানে গানে আঠালো থাকুক (পরম্পরা)

এই পরম্পরায় যে কী নেই! জায়গায় জায়গায় অসাধারণ ছন্দোবদ্ধ পংক্তির বাঁধন পুঁজিবাদ নিষ্পেষণ থেকে শণতন্ত্র, শোষ নিপীড়ন থেকে বিশ্বায়্ন অসহায় মানব  মন যাঁতাকলে পিষ্ট মানবের সুকোমল মানবিক বোধ আর সেই মানবিক বোধের ক্রমাগত স্খলন, লুন্ঠ, প্রতারণা কবিতাটির পরতে পরতে মানবিক বিকার আর তার স্বীকারের অ্যবস্ট্রাক্ট সব চিত্র্র আঁকা আঁকা রয়েছে পুঁজিবাদের যাবতীয় নৃশংস হুঙ্কার  আর কান্নার বীভৎস করুণ শব্দ, লালসা আর তার চরিতার্থতার বিচিত্র বিকৃত বিশদ ছায়া আর তার ছবি শক্তিমানের চিরায়ত লোভ, পরের সম্পদ লুণ্ঠন আর আত্মগত করবার ক্রমপ্রক্রিয়ার ফলাফল লোভীর অত্যাচারীর মুখোশ আর তার আড়ালের নিষ্ঠুতার প্রকাশ পদে পদে হয়েছে ব্যক্ত জটিল সাম্রাজ্যবাদ প্রজাশাসন  ধর্মের মাকাল বাক্যবাণীর আস্ফালন তার যাঁতাকলে অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদ কী যেন এক অসাধারণ রূপ পেয়ে গেছে এখানে এসে দাদাজানএখানে সিম্বলাইজ হয়েছেন এক আদি আর চির প্রকৃত স্বজাত্যবোধের ধারক হিসেবে-

ডিমের আদলে ঘুম যাও দাদা; ফাটাবোনা এই যাপনের ঘুম - ///
মৃত্যু টানেনা তোমাকে অপার;এখানে হাড়ের নয়া মওসুম///
তামাম দুনিয়া মন্ডু খুঁজেছি, ধুনুচি পুড়িয়ে চেতনার দম- ///
বর্গীবাজার আড়ৎ ডিঙিয়ে গোড়ালি চিনুক তোমার খড়ম///

কিংবা

পশ্চিমে সুরঙ্গ আছে-উন্মুক্ত বাজার/পুবালি সুষমা ঢেলে এত যে বিভোর ডাকো আয় আয়/ধনের পচনতন্ত্রে আজ/মন্ত্র দিয়ে ফুঁক/কিছু দাও সম্পৃক্ত পাঠক/বহতার রক্তে ফিরে অটুট বিদ্যায় লিখি/ক্রম নদী, হালচাষ/বাঁক-ফেরা জলের শাসনে/সাঁকোর দহন লিখি জলধির সমান সমান

আর অবশেষে প্রত্যাশার সুর বের হয়ে এসেছে কোনো একদিন হয়তো মানুষ চিনবে তার প্রকৃত শেকড় আর ধাবিত হবে তারেই পানে-
শুধু যে বিষয়ের গভীরতা কিংবা আন্তর্জাতিক বোধের জটিল টানাপোড়েনে সমৃদ্ধ  পরম্পরা বিশাল শরীর তাই নয়, পংক্তিতে পংক্তিতে অসাধারণ সব জটিল  সরল উপমা রূপক উৎপ্রেক্ষার দারু সুসংহত আর সংযত প্রকাশ এখানে তাঁর  কবিতা পড়তে পড়তে আমার এমনই মনে হয়, উপমা যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে কখন বসবে তার কবিতার শরীরে শরীরে আর অলংকৃত হয়ে উঠবে নিজেই দারুণ সব ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি হয় যা ড়ার সাথে সাথে মনের কিনারে

একটু দৃশ্যান্তর প্রয়োজন একটি দীর্ঘ-দারুণ-সুখপাঠ্য-দুর্বোধ্য-জটিল কিন্তু অসাধারণ  কবিতা পাঠের পর আমি একটু রিক্রিয়েশন খুঁজি একের পর এক পড়তে থাকি না কবিতার নাম ধরে খুঁজি কোনো পলকা সুখপাঠ্য কিছু নামে পেয়েও যাই এমন এক  পড়তে শুরু করি কিন্তু না তাতেও জীবনের জটিল কিন্তু ধ্রুব কিছু সত্যের আবছায়া দেখি নদী আর নিজের ঘর যেন এক করে ভাবি এই হ্বানে শুরু করি-
নদীকে নিজের বাড়ি মনে করো তখন ভাবতে হবে না যে তুমিও ভাসছ স্রোতের সমান/যদিও আবাস তার-পৃথিবী নিরত ঘুর্ণন বুঝতে পারেনা কেউ/তাই তো অটল থাকে বিবর্ণ বিষাদে সফল ক্ষমায় (ফেরার ইচ্ছে)

মন এই এক তামশাজীবনে মন আর তার কত কত যে রূপ অপরূপ হয়ে উঠেছে  যুগে যুগে কাব্যে আর কবি ভাবনায়! বিপরীত রূপেও কি তা পায়নি অন্য আর এক অবয়ব? অধরা চিরায়ত রাধার যাতনায় কি কৃষ্ণের ছলাকলায়! পেয়েছেলেখা হয়েছে একের পর এক সব কবিতা মহাকবিতা মানব মনে প্রেম আর তার প্রত্যাহৃত যাতনা কী দারুণ বিষাদে রূপান্তরিত হয় এক সবিশেষ আবেদনে তারই মূর্ত রূপ যেন   এই কয়টি পংক্তি-

তার মনে এক নেই/বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক/কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি/ঠোঁটে তার মনের পেরেক….(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পা্খি)

দারূ এক ইমেজ তৈরি করে দেয় এই টি পংক্তি আমার মনে দেখি সেই শৈশবের  চেনা পাখি কাঠ ঠোকরার ছবি তখন লালমাইয়ের পায়ের কাছে আমার বাস উপড়ে পাহাড় নিত্যই ভোরে নীল আকাশ ডানা মেলে ছায়া হয়ে থাকে জীবনের গভীরে সব কিছুতেই কী দারুণ সুন্দর ঝুলানো ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই দূরে লালামাইয়ের  ঘনচূড়া, গভীর বন, চোখের সামনে ছোট বড় শিশু গাছ আর বৃক্ষের ঘনসবুজ পাতা  গায়ে আদরের পরশ বুলায় তেমনি প্রদোষে কোনো কোনো মধ্য দুপুরে আমি দেখেছি  কাঠঠোকরার একাগ্র সাধনা নিজের ঠোঁটৈ - ঘন্টা মিনিটের হিসেব বিহীন কেটে চলেছে গাছ কেটে চলেছে কাঠ-আমার অপলক চেয়ে থাকাও তেমনি পার হয়ে গেছে তারে দেখে দেখে কি মধ্যাহ্নে কি অপরাহ্নে বিরামহীন সেই কাঠঠোকরাই আজ সেই সুদূর শৈশব থেকে চোখের সামনে উড়ে আসে ঠো্ঁটে এক নির্মম পেরেক নিয়ে নাম তার মনমন থেকে মনান্তর-এই ব্যাখ্যার অতীত কর্মক্রিয়া মানবের জীবণে বোধে কর্মে কি প্রাত্যহিক দিনযাপনে যে ক্লেশ যে প্রগাঢ় যাতনার বিষ রেখে চলে যায় তার দারুণ দারুণ সব প্রকাশ নানা উপমায় নানা ইমেজে জটিল কিন্তু অসাধারণ সব রূপকে প্রকাশিত হয়েছে কবিতাটির ভাঁজে ভাঁজে

-জল পড়ে/পাতা নড়ে/কবিতার সৌধ ভেঙে রোজ পাথরে খোদাই চিঠি ডাকবাক্সে পড়েনা এমন/আজন্ম ক্ষরণতবু লিপির অঙ্কনে শোক ভালো, ধন্য তবু হৃদয় জখম/শূদ্র ভালো, বৈশ্য ভালো, রক্তে ভালো ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ; /যবনের আল্লা ভালো, নমঃ নমঃ একক ব্রহ্মায়………..(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি)

ঠিক তেমনি আর এক শাশ্বত যাতনার বোধ আঁকা হয়ে থাকে দারুণ শব্দে দারুণ রূপকল্পে আমার কাছে যেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক এক অসাধারণ স্যাটায়ারের উদাহরণ-

-শুনেছি তোমার মনে পরাণগঞ্জের মধুর কিরিচ/রক্তে ফুলের মৌতাত/গন্ধের বিষ্ময়ে তবু খুনের পাপড়ি/হোক প্রেম, আজ দোষ নেই/ডাগর দুনিয়া ফেটে যাচ্ছে যাক; আত্মার দুহাত বাঁধাপরী, শপথবেলুন উড়িয়ে দিলাম/ফিরে যাবনা অক্ষয় ক্ষতিবিতন্ডা পাড়ায় (পাণিপ্রার্থনা)

আবার ঠিক তারই বিপরীতে একই যাতনার বোধে প্রাজ্ঞ কবিতাটির শরীরে নারীর যাতনা পুরুষের পলিগ্যামি বিভাজিত মনে শরীরের কালিমাখা রূপ আর ভালোবাসার ক্লাসিক রূপে নারীর প্রত্যাশিতের জন্য সাধনার এক দারুন প্রকাশ কবিতাটির দুজায়গায়

-ঔরসের রক্তের মতো যে ছিল আপন, /জান্তব পুরুষের টানে ছেড়ে গেছে বহুদিন

কিংবা

-আবুল কালাম! /মানুষের কলিজা নিয়ে ধাপ্পা খেলে যে নিষ্ঠুর, /অন্তহীন অঙ্কের অকূলপাথার নিয়ে উদ্ধত যৌবনে তারও পড়ন্ত বিকেল নামে/প্রেমের বিনয়ী জল হাতে পরিপূর্ণ মাটির বাসন-/অপেক্ষা করে সে প্রাণের কুকুরী, আহা, আপন মানুষ যদি ফিরে আসে………….

কুকুরীর জন্য সংবেদনা - সত্যি যদি বলি, কবিতাটির নাম শুনে আমি একদম বাদ দিয়ে রাখি পড়ব না বলে কী ভেবে যে আবার কোনো এক ফাঁকে পড়ে ফেলি আর  মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্কা করি তার অন্তর্গত গভীর বেদনার এক শাশ্বত রূপ



অবশেষে আসি পুরো কাব্যের নামাঙ্কিক কবিতাটির কাছে ইচ্ছে করেই রেখে দি তারে  সর্বশেষ পাঠের জন্য ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি যে কোনো গল্প বা উপন্যাসের প্রথমে দুএক চ্যাপ্টার পড়লেন তারপরই শেষের পাতা পড়ে জেনে নিলেন কি পরিণতি এবার শুরু হলো তার আসল পাঠ চুলায় রান্না পুড়ে যায়, বেলা পার হয়ে দুপুর বিকেল, টেবিলে তার ভাতের থালা পড়ে রয়, মধ্যরাতেও তার ঘরে আলো জ্বলে আজও জীবনের শেষ বেলাতেও রাত তিনটে কি চারটে দুচোখে ফ্যাকোর কাটাচেরা তবু বই শেষ না করা অবধি তার নিস্তার নেই আমি সেরকম হতে পারিনি বলে খুব দুঃখবোধ কাজ করে মাঝে মাঝেই আর কারণেই শেষ কবিতাটি আগে আগে পড়া হয় না আমি চাই শেষটুকু রস নিংড়ে আস্বাদন করি সেই রসে মুগ্ধ হয়ে রই সিক্ত থাকি উঠে যা্ই উর্দ্ধতর আরও আরও এক অনির্বচনীয় সত্তায় যতক্ষণ না আসে নতুন আরও এক অসাধারণ কিছু হাতের নাগালে শুরু হলো লখিন্দরের গান হায় খোদা ঈশ্বর ভগবান, তারও কি ছিল জানা একদিন তিনিই হবেন বেহুলা কোনো  এক কাব্য স্রষ্ঠার কাছে আর যাপিত জীবনে তার সৃষ্টিরই সব তারই হাতে নাকাল এক একটি লখিন্দরের আত্মা- আবার তারই সাথে মিলনে পরম প্রত্যাশা নিয়ে দিন রাতের আরাধনা মানব জনমের ১০টি পর্বে লেখা কবিতাটির প্রথম অংশটি পড়ি-

বোধিরা মরেছে আজ কেউটে ছোবল খাচ্ছি বর-
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর
নীলকন্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?

সুফিবাদী ভাবনায় বেহুলা লখিন্দরের মিথকে মোল্ড করেছেন দারুণ এক কম্পোজিশনে কি ভাবনায় কি প্রকাশে কি রূপক কি কাব্যবোধে সব জায়গায় কবিতাটি এক অসাধারণ মাত্রা পেয়েছে আমার কাছে জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনের যে আকাঙ্ক্ষা, যে হাহাকার বৈষ্ণব পদাবলী থেকে শুরু হয়ে সুফি সাধকদের মধ্যে যা চিরকাল প্রবহমান তারই দারুণ সব ধ্বনি প্রতিধ্বনি কবিতাটির পংক্তিতে পংক্তিতে এঁকে চলেছে অসাধারণ সব ছবি যাপিত জীবনের যাবতীয় সরল আর জটিল সবকিছু পাওয়া যায় এখানে চাষী বর্গাচাষে ফসল ফলায় আর জমিদার ভোগ করে, ঠকায় চাষীকে স্বার্থ  উদ্ধার হয়ে গেলে মানুষ ভুলে যায় সব পরের সম্পদে চিরকাল অপরের লোভ সবল চিরকাল দূর্বলকে করেছে লুট দুঃসহ তার শাসন, শোষ পুঁজিবাদের করাল আগ্রাসে  ধীরে মৃত্যুর মুখে দারুণ মানুষ আর সভ্যতা মানুষ ভুলছে তার অতীত সোনালি অতীতের সব কর্ম আর শেকড়ের কথা ভুলে চলেছে কোথায় কোনো এক অসা অনামা পৃথিবীর দিকে সেই সংশয়- কি নেই এখানে লখিন্দরের চিরায়ত প্রতীকে নির্যাতিত মানুষ মানব সভ্যতার আর তার নিষ্পেষণে অসাধারণ চিত্রকল্প কবিতাটির আদ্যোপান্তে

-আমার নিয়েছে সব; তবু বৃষ্টি বয়ে যায়/টিয়ার ঠোঁটের কাছে লাল ভোর সূযের প্রাণের গান গাইবেনা, /এমনতর পাপের নিশানা দেখিনি/সানকির বয়াতি ঢোলক/ভাতের বাজনা খেয়ে ক্ষুধাতুর-এখন দীক্ষিত/বানর নাচার খেলাঘর/বৃষ্টিতে শরীর ধুয়ে নেয়..(লখিন্দরের গান)

কিংবা

পিন্ড মনে খয়রাতি মন আজ ষন্ডা লখিন্দর
কলার ভেলাতে সোনা, পালঙ্কে সন্ন্যাসী, দেহে চট
সেচের প্রকল্পে খরা, নাকি ঝড়? দোটানা চম্পট
সকালে বৈকালি তারা মুখ টিপে বেহুলার শর
হাসি হাসি বাসি ভাতে কেরানির জোড়ালো থাপড়
অঙ্কৃশে জীবন টানে লোহা লোহা শনির হোঁচট
রাজার নৈতিক বলে খুলবেনা মরণের জট-
এমন ভরসা এলে বেদখল! স্বপ্নে যাবে চর

এত এত সব জটিল রাজনৈতিক পতন কিংবা উত্থান উচ্ছৃঙ্খল জীবন যৌবনের অবাধ অগাধ ছলাকলা নিষ্পেষণ বহুমাত্রিক আর বহুধাবিভক্ত মন, মনের জটিল পরিবর্তন দূর্বলের উপর সবলের মাত্রাবোধ বিহীন ক্রম অত্যাচার কেবলই কি নিরাশা জাগিয়ে তোলে? না তা নয় কবি বলবেন আশার কথা কবি ভাঙবেন মিথ্যের জটিল চাই পূর্ণ করার পথ দেখাবেন স্বপ্নের ষোলকলা শাসন করবেন দুঃসহ শাসক ছিঁড়বেন জটাজাল আর আঁকবেন স্বপ্ন স্বদেশ গড়বেন পৃথিবী মনোরম- সেই সুরে শেষ হয়, রুখে দাঁড়ায় নির্যাতিত মন শুভ আরসুন্দরের আজন্ম প্রত্যাশায় আমি পৌঁছে যাই এক দূর্দান্ত সাবলিমিশনে লখিন্দরের গানের পাঠ শেষে শেষ কথা টির রেশ নিয়ে কাটাই বেশ কিছু দিন...

-ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে/সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক/মাছে ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত/আমাকে দাঁড়াতে হবে/কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ন-ইতিহাস/-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল:/আমার দখল নেবে কে আছে এমন?

তারপর কতদিন আমি আর কিছুই পড়ি না অলস বিবশ দিন যাপন একেবারে সত্যি সত্যিই এমন এইভাবে একটি একটি দারুণ বই দারুণ কবিতা আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে, নেশার রেশ কেটে উঠতে আমার সময় নষ্টহয়ে যায়লোকে এই বলে কিন্তু আমি তা অনুভব করি না আমি রসে সিক্ত থাকি, উপভোগ করি, কাঁদি নয়ন ভরে হাসি আনন্দে হৃদয়ে পূর্ণ করি বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠি এক জনমেই যেন ভোগ করি আর এক জন্মের সাধ

তারপর শুরু হয় আর এক নতুন, অশ্রুপার্বণ...
-আমি সেই গান, সেই অধিকলহের নৃত্য জ্বেলে রেখে
খুব এক সঙ্গত নারীকে বলি, এবার আমাকে ছাড়ো
অনন্য প্রেমের নামে সাত পাক ঘুরে আসি পৃথিবী আমার
…………………………………………………………………
যাপনের ধুলো মেখে দাঁড়াও ঘনিষ্ঠ তুমি, আমূল সংস্রব
দেখবে, যৌবন জুড়ে অজস্র গীতল প্রজাপতি বার বার উড়ে আসে
আমিও অধীর ছুটি পিছু পিছু... (গৃহবাউল)

গৃহবন্দী উদাসী বাউল মনের চিত্রকল্প এত সুন্দর এত সুন্দর করে প্রকাশিত যে কবিতায়তা তো কবিতা নয়, যেন মানবের নিষিদ্ধ প্রেম অনুসন্ধিৎসা কামসুশৃঙ্খল মনকে অবদমনের অনন্ত সৌন্দর্য বহনকারী এক গোপন ইস্তেহার সেখানে দারুণ দারুণ সব উপমা রূপকেরও ব্যবহার আমাকে মোহমুগ্ধ করে ঠিক বিপরীতে কিংবা সাধারণত উপমান কিংবা উপমেয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় না এমন শব্দ আর শব্দের পর শব্দের সমাবেশ জটিল করেছে কবিতাটির গায়ের অলংকার ঠিক কিন্তু রূপের মধুরতা নষ্ট করেছে বলাই যাবে না বরং যেন সোনার চেয়ে জুড়ে দিয়েছে কন্ঠে হীরের দ্যূতি - আমি এইটুকুই বলতে চাই সবুজ স্বাস্থ্য, শান্তির পশুদল, গোলাপমুখর হয়ে আছে,  মানুষের বিষ, ঘাসমেলা গাছ, মোরগ রঙের কিছু পাখি, সদানন্দ ঘন প্রাণ, দুধেল সঙ্গীত, নৃত্য জ্বেলে রেখে, ধুলো হয় পায়ের ঘুঙুর, গীতল প্রজাপতি... ঠিক এমনই কিছু উপমা রূপকধারণ করে আছে




পথের সাথে জীবনের গভীর সাদৃশ্য পরম ভালোবাসায় জীবণার্পন আর বিদগ্ধ যাতনায় তার প্রত্যাঘাতে হতাশার এক অন্তর্ভেদী রূপ দেখি এখানে কবির কিংবা লেখকের সূক্ষ্ম জীবনবাসনায় জীবন এবং বোধে ক্রমাগতই হতাশা সুন্দরের পাশে  অসুন্দরের অবস্থান তাকে হতাশ করে, প্রচলিত জীবনের বাঁকে বাঁকে মনন্তর তাকে হতাশ করে, সোজা পথে বাঁকা চলন তাকে উদাস করে আর এঁকে চলে পদে পদে তুমুল অভিমান লেখকের তো এমন হবারই কথা্ স্পর্শকাতরতা তারই তো স্বভাব যে সব অনুভব করতে পারে একাগ্রতায় আর যখন হয় আহত তার প্রকাশও তেমনি প্রতুল-

-হাতে ছিল নিরেট বিকেল সঙ্গে হাওয়া সহচর/আজ ভালোবাসা নয়-উপেক্ষা শিখেছি মানুষ অপর করে চলে আসি (পথ)

যতটা সময় ধরে পড়েছি তার কবিতা যাপন করেছি তার সময় ততটা সময় ধরে  কবিতায় এক অসাধারণ বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে খুব যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থানে যে কোনো বেদনার কিংবা বিষণ্ন যাপনের আঁকা ছবিতে কিংবা রোষে বিদ্রোহে, প্রতিবাদে কিংবা ভৎসনায় বরাবর অসাধারণ করে আশ্রয় নিয়েছেন প্রকৃতিতে তার লেখায় কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে গাছ পাতা ফুল চাঁদ নদী হাওয়া আকাশ কিংবা বাতাস প্রকৃতির নানা রং রূপ আর অনুষঙ্গ মিশে গেছে র্যাপদ থেকে  শুরু করে রাধাকৃষ্ণ পদাবলী অবধি, প্রণয় থেকে ঘৃণা পযন্ত, আল্লাহ থেকে ভগবান প্রেম থেকে স্খলন ছাড়িয়ে দমন কিংবা অবদমন নিপীড়ন শোষ অথবা প্রজাপালনের  মতো জটিল কঠি কাঠখোট্টা বিষয়ও দেখি তার একটি রূপ এই শেষ চুমুক কবিতায়-

-হে বাতাসদেহ, রসনিকুঞ্জের পরপারে বেদন-বৃষ্টির পরিচারিকা, তুমি কি ভাববে, আমিও জীবনের বিফলে উত্তাপে অপারগ/লাটিম ঘুরাচ্ছি শুধু শুধু? /যেন আমি কাঁদাখোচা পাখি; /সোনাবউ খুঁজছি কাঁদায়?

কিংবা

-বোধি প্রেমের মধুনারায়ণ, দেখো, কবরের কাছে এলে/আমাকে জড়িয়ে ধরে পলাতক প্রফুল্ল নিশীথ; /দেখো, ঝোপঝাড় বাতাসে নির্ভার জেগে থাকে; /সারারাত কেটে যায় জোনাকির পেটভরা আগুনের হল্লা দেখে দেখে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় তিনি জন্মের আনন্দ কিংবা মৃত্যু অথবা মৃত্যু দিনের আসঙ্গ লিপ্সা কিংবা যাতনার রূপকে অসীম প্রাণবান করে তোলেন প্রকৃতির নানা উপাদানের সমাবেশে-

-দাদীর মৃত্যু দিনে আমিযে-গান গেয়েছিলাম; সকল সংক্রান্তি ব্যর্থ হয়ে গেলে/তাকেই আলোর মতো ধরে রাখি; বলি মায়ানারী/বিপুল বয়সী তুমি সোনার কাছিম (জলাঞ্জলি)

প্রাত্যহিক জীবনে পরিবার থেকে রাষ্ট্রে ঘর থেকে পথে সংসার থেকে রাজনীতিতে প্রেম থেকে ঘৃণায়, কোথায় না তিনি প্রকৃতির খুব ছোট আর সাধারণ উপাদানগুলোকে ব্যবহার করেননি-

-আমাদের ঘরে ঘরে হিড়িম্বা, রাবণ/প্রলম্ব নির্জনে বসে মহাজাগতিক,/সংকল্প হানছে রোজ; যেন কান্না প্রকল্পিত উলঙ্গ লিপ্সায়/ওরা খুব স্বপ্ন ভেঙে দেয়/তবে কি আমিও অলীক খাঁচার ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৌচাক দেখছি শুধু?/কখনো অনেক লাল পিঁপড়ের বাসাবাড়ি, নিম লেবু আর চড়ুইয়ের বাসা? (কথাসৌধমালা)

জানিনা, কেন? বারবারই স্বীকার করি আমি, আমার পাঠের দীনতা তবু এক দারুণ অনুভব আমার মধ্যে কাজ করতে থাকে কাজি নাসির মামুন পড়তে পড়তে পাঠের দীনতাটুকু স্বীকার করে নিয়েই বলি, বিভূতিভূষণে প্রকৃতি প্রেম আর তার লেখনী  আমাকে নিয়ে চলে প্রকৃতির কাছে সবুজ আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠি তাঁর কবিতা কিংবা গল্প পড়তে পড়তে কাজি নাসির মামুনেও প্রকৃতির ব্যবহার শুধু যে কবিতায় কবিতায়তা বললে কম বলা হবে প্রকৃতি আর উপমা রূপক তার কবিতার পরতে পরতে যেন এক কবিতা বেয়ে উপচে পড়ে যায় অন্য কবিতায় কিন্তু সেখানে আমার অনুভব বিপরীতে অবস্থান করে বিভূতিভূষণে লেখা থেকে এখানে মনে হয়  প্রকৃতি আমাকে তার স্নিগ্ধ কোলে টেনে না নিয়ে নিজেই উঠে এসেছে এই জটিল কঠি বীভৎস নিপীড়ক শোষিত ডাকাত জীবনে-প্রেমে বিদ্রোহে বেদনায় কামে বিবাদে বিভাসে বিবিধে কখনো হয়ে উঠেছে দারুণ স্বেচ্ছাচারী তার অমরতায় কখনো উদ্ধত তার বিক্ষুব্ধতায় কখনো প্রেমময় তার স্নিগ্ধতায় কখনো রুদ্র তার সংক্ষুব্ধতায় কখনো উত্তাল তার মত্ততায় আবার কখনো নিরীহ নীরব ধ্যানমৌন তার গভীরতায়-পাঠে তৈরি করেছে আমার মধ্যে এক দারু নীরব উন্মার্গ অধিরম্য আবাস

শত শ্রদ্ধা কবির এই অসাধারণ সৃষ্টির প্রয়াসকে সুশৃঙ্খল অনুশীলনে যা ঋদ্ধ করেছে আর করেও যাবে, আমার বিশ্বাস, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ভালোবাসা আর  অজস্র প্রণাম জানাই তাঁকে বারে বারে