শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

শ্যামাসঙ্গীত বিষয়ে দু-চার কথা, সঙ্গে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ




কালীপুজো
চলে গেলো। সাথে নিয়ে গেলো শ্যামাপোকাদের সঙ্গে প্যান্ড্যালে মন্ডপে কচি মেয়েলি গলায় লঘুসঙ্গীতের ঢঙে গাওয়া শ্যামাসঙ্গীতের ঢল। ভবানীদাস, মৃণালকান্তি ঘোষ, হীরালাল সরখেল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জ্ঞান গোঁসাই তথা জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, নজরুল ইসলাম, বিশেষতঃ পান্নালাল ভট্টাচার্যর গলায় শ্যামাসঙ্গীত শোনা কানে বেশ ধাক্কা লাগায় অনুরাধা পড়োয়ালের এই শ্যামাসঙ্গীত!সঙ্গে ‘ধুনোর গন্ধ’ কুমার শানুর হেঁড়ে গলার শ্যামাগীতি একটু আরো ভালো গাইছেন আসরফ উদাস। সল্টলেকের কৃত্রিম নির্মাণ ছেড়ে ক’গজ পা চালালেই এই আধুনিকায়িত শ্যামাসঙ্গীতের পোয়া বারো! স্লুইস গেট পার হয়ে কয়েকশো ফুট হাঁটলেই, নয়াপট্টিতে, কেষ্টপুরে, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের মহাসমারোহের সাক্ষ্য দেয় অজস্র খাওয়ার দোকান— জিলিপি-বিরিয়ানি-চপ-কাটলেট ছাড়াও যাবতীয় দৈনন্দিন সামগ্রীর। আর এই ‘quotidian’ বা প্রাত্যহিকতায় ভরা জীবনানন্দের সঙ্গত করে বা সঙ্গী থাকে অ-প্রথানুগ, গায়কীবিহীন কালীগান! অনেক দিন ভেবেছি শ্যামাসঙ্গীতের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী! সুর মোটামুটি তিন চার রকমের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যদিও গায়ক বা গায়িকারা নিজের নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী তানকারি, কালোয়াতি, গলার ‘কাজ’ ইত্যাদির মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনায় মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু অন্যদের কথা থাক, আমি আমার নিশ্ছিদ্র নাস্তিকতার মধ্যে কালীপুজোর আগে পরে তো বটেই, সারা বছর ভবানীচরণ, মৃণালকান্তি, হীরালাল, ধনঞ্জয়ের, বিশেষ করে পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীতে মজে থাকি কেন, যার ফলে আমার এক দেশবিশ্রুত, পরমপ্রিয় অধ্যাপক আমার নিশ্ছিদ্র নাস্তিকতার মধ্যে বড় ছিদ্র আবিষ্কার করেছিলেন? কী এমন আছে শ্যামাসঙ্গীতে? একটা কি এই যে অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনী অন্নপূর্ণার কাছ থেকে প্রার্থিত বর চাইতে গিয়ে যে সামান্য আশ্বাসের দাবি করেছিল নিজের সন্তানের ‘দুধেভাতে’ রাখতে পারার, সেটাই শ্যামাসঙ্গীতের গানে গানে পল্লবিত হয়েছে? হয়ে উঠেছে আপামর বাঙালির জীবনের থেকে মোটাভাত, মোটাকাপড়ের এক নিশ্চিন্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, যে আকাঙ্ক্ষা কার্ষ সমাজের জীবনবীক্ষা থেকে উৎসারিত?বাঙালি চিরকাল তার জীবনে কী চায় আর চায় না মা কালীর কাছ থেকে, তার সঙ্গে তা কেন চায়না মা কালীর কাছ থেকে, সে বিষয়ে অনুযোগ/ অভিযোগের বহর এত বেশি যে যে কোনো ধরনের ভক্তিমূলক গানের থেকে শ্যামাসঙ্গীত একেবারে স্বতন্ত্র রয়ে গেছে। কীর্তনের ভবোন্মাদনার থেকে এ সম্পূর্ণ আলাদা জাতের, যতই তাতে দাস্যভাব, সখ্যভাব থাকুককীর্তন কখনোই এত ‘পার্সোন্যাল’ ছিল না বা হয়নি। শ্যামাসঙ্গীত মানেই কালীর সঙ্গে বাঙালির ‘নখড়া’। আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে হাওড়া-হুগলি তথা রাঢ়বঙ্গের কোনো কোনো জায়গায় একে বলা হতো ‘ন্যাংরামো’। এক দিকে কালীকে নিয়ে মাতামাতির, তাঁরপ্রতি ভক্তি-অনুরাগের বাহুল্য (হাওড়া-হুগলি তথা রাঢ়বঙ্গের গ্রামীণ বাংলায় ‘বাহাল্লুতি’), আরেক দিকে কালীর কাছে অনুযোগ, কালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সব মিলে শ্যামাসঙ্গীতের সঙ্গে একমাত্র সাদৃশ্য আছে পৃথিবীতে কেবল একধরনের ভক্তিমূলক গানের, ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-এর সঙ্গে কালীগানের মধ্যে  জন্মমৃত্যুর যে চক্র, সংসারের যাপনের যে অলাতচক্র, তার সঙ্গে নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের যে মিল আছে তার কথা আমি প্রথম জানি বার্ট্রাণ্ড রাসেলের থেকে, যদিও রাসেল জানতেন না পশ্চিমী দর্শনের ইতিহাস বইতে রাসেল ‘অর্ফিক’ গানের প্রসঙ্গে যখন ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-কেআনেন এই প্রসঙ্গে যে অর্ফিক-দের কাছে এই পৃথিবী কেবল যন্ত্রণা ও ক্লান্তি, কারণ আমরা একটা চাকার সঙ্গে বাঁধা যেটা জন্মমৃত্যুর অনন্ত ঘুরণপথে ঘুরছে। কেবল শুদ্ধীকরণের ও বৈরাগ্যের এক কৃচ্ছ্রসাধনের জীবনই এর থেকে মুক্তি দিতে পারে। যে জীবন এই গানের জন্ম দেয় সেটা যে স্বচ্ছন্দ আর সুখপ্রদ নয় সেটা বোঝাতেই রাসেল এনেছিলেন ‘নিগ্রো স্পিরিচুয়াল’-এরএকটিগান, ‘যখনবাড়ি যাবো সব দুঃখের কথা বলে দেবো ভগবানকে’ (‘I’m going to tell God of all my troubles/ When I get home’

পৃথিবীর দুঃখের যন্ত্রণার সম্পর্কে এরকম অনুযোগ, ‘বাবাকে বলে দেবো’ ঢঙে  ঈশ্বরকে বলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পল রবসনের যাদুস্বরেছাড়াও আছে বেয়াত্রিচে রিপির গলায় আর ক্যারল হলিস্টারের পিয়ানো সঙ্গতে একই গানে; যেমন আছে আরো অনেক গানে, যেমন ‘All I do, the church keep a-grumbling;অথবা ‘Sweep it clean/Ain’t going to tarry here; When you see me on m knees/ Come here, Jesus, if you please;Where to go I did not know/ Come along home to Jesus Lord’, কিম্বা মাহালিয়া জ্যাকসনের এই অমর গান

'I’ve been 'buked
… …
Children,
I've been 'buked and I've been scorned
Tryin' to make this journey all alone
You may talk about me sure as you please
… …
Children, talk about me sure as you please
Your talk will never drive me down to my knees
Jesus died to set me free
… … Children Jesus died to set me free
Nailed to that cross on Calvary’.

যদিও এই গানটিরও অনেক অন্য রূপ আছে, যেমন অ্যালভিন অ্যালির গানে, আবার নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের অফিসিয়াল সাইটে আছে এরকম আরেকটা গান, ‘I’ve been ‘buked and I’ve been scorned/ And I’ve been talked ‘bout as sure as you’re born/ And my soul looked back and wondered/ How I got over, my Lord Dere's room enough … / Room enough in de heaven, my Lord … / I can't stay behind


কিন্তু তবুও ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল-এর থেকে শ্যামাসঙ্গীতে বৈচিত্র্য অনেক বেশিনিগ্রো স্পিরিচুয়াল-এ আমরা দেখি দাসজীবনের অজস্র যন্ত্রণার মধ্যেও অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান ক্রীতদাসের তরফে ঈশ্বরের তথা যীশুর প্রতি অটল অনুরাগ, ভক্তি, প্রেম, আর সমর্পণই ফুটে ওঠেশ্যামাসঙ্গীতে কিন্তু এই সমর্পণ একমাত্র সুর নয়। কালীকে নিয়ে বাহাল্লুতি, কালীর কোলে ওঠার, তাঁর সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রায় জরায়ুজ আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি আছে তাঁর প্রতি তীব্র অভিযোগ, এমনকে তাঁর স্নেহাশ্রয়কে বর্জন করার ইচ্ছা, যদিও সবের পিছনেই আছে শেষে তাঁরই শরণ নেওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প। 




শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন অনেক প্রসিদ্ধ ভক্ত গায়ককবি— রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়), কৃষ্ণচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরুঠাকুর, রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), কালী মীর্জা, দাশরথি রায় (দাশু রায়),ছাড়াও কিছু মুসলিম কবি! কিন্তু যে অনুযোগ, অভিযোগ, আবদার, কটূক্তি শ্যামাসঙ্গীতের এই বহুস্তরীয় বৈচিত্র্যকে নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের থেকে অনেক উপরের স্তরে নিয়ে গেছে তার সুলুক সন্ধানসব রচয়িতার গানে নেই, যে কারণে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা সাধক কমলাকান্ত-কেরামপ্রসাদের অনেক উপরে রাখলেও আমি রাখি না! অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কমলাকান্তের ভণিতায় প্রায় তিনশ পদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি ... রামপ্রসাদের চেয়েও কাব্যাংশে উৎকৃষ্ট।’ হতে পারে। কিন্তু উমার গান শাক্তপদাবলীর মধ্যে পড়লেও কোনোভাবেই শ্যামাসঙ্গীতের গোত্রে পড়ে না। কমলাকান্তের শ্যামাসঙ্গীতের গানগুলি নিঃসন্দেহে কালীর প্রতি ভক্তিময়তার সুন্দর প্রকাশ। যেমন অসিতকুমারেরই উদ্ধৃতিতে ‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমোহিনী গো মা/ তুমি আপন সুখে আপনি নাচ আপনি দাও মা করতালি’, কিম্বা ‘শুকনো তরু মঞ্জুরে না ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে।/ তরু পবনতলে সদাই দোলে প্রাণ কাঁপে মা থাকতে গাছে’, অথবা ‘মজিল মনভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে।/ যত বিষয়মধু তুচ্ছ হৈল কামাদি কুসুম সকলে’। কিন্তু কালীর প্রতি অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগ, আবদার,কটুকাটব্যের যে বান ডেকেছে রামপ্রসাদের গানে, কমলাকান্তে তা কোথায়? অসিতকুমার তো নিজেই লিখেছেন, রামপ্রসাদের ‘নিরাভরণ প্রেমের বাণী ... সাদা কথায় ধরা পড়েছে। শ্যামার সঙ্গে তাঁর মা-ছেলের সম্পর্ক, মান-অভিমানের সম্পর্ক— এমনকি কটু কথার সম্পর্ক। ... তাঁর পদ আশাহীন মানুষের সান্ত্বনাস্থল, বাস্তব দুঃখের একমাত্র প্রতিষেধক। তত্ত্বসাধনার সঙ্গে বাস্তব জীবন ও সুখদুঃখের এমন নিবিড় সংযোগ অন্য কবির খুব অল্প পদেই পাওয়া যায়। ... রামপ্রসাদের গান বৈকুণ্ঠের গান নয়, তার সঙ্গে ধূলি ও ধরিত্রীর নিবিড় যোগ আছে বলে আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়েও তার কাব্যরস উপলব্ধি করা যায় — যে কাব্যরস বাস্তব জীবনকে অবধারণ করে আছে’ কিন্তু অন্য কবি বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন অসিতকুমার? কেবল বাংলায়? ভারতবর্ষে? না পৃথিবীতে? নিগ্রো স্পিরিচুয়ালে এ সম্পদ নেই, আর আমার সীমিত জ্ঞানে ল্যাটিন আমেরিকায় বা আমাদের এই ভারতবর্ষেও ‘লিবারেশন থিয়লজি’র গানেও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অভিযোগের এই সম্পদ নেই। আর রামপ্রসাদের বলতে কাকে বোঝচ্ছি আমরা? অসিতকুমার জানিয়েছেন, কিন্তু তিনি বলার আগেই আমরা তো জানি যে হালিশহরের রামপ্রসাদ (আঃ ১৭২০/২১-১৭৮১) ছাড়াও দ্বিজ রামপ্রসাদ নামে পূর্ববঙ্গের এক সমসাময়িক পদকার অনেকগুলি চমৎকার গান লিখেছিলেন। অসিতকুমার জানাচ্ছেন ‘এখন রামপ্রসাদের পদাবলী বলে যে সঙ্গীতসংগ্রহ ছাপা হয়ে থাকে, তাতে দ্বিজ রামপ্রসাদ ভণিতাযুক্ত যে সমস্ত পদ স্থান পেয়েছে তা অবিকল রামপ্রসাদ সেনের গানের মতোই। কাজেই শুধু ভাষা দেখে কোন্‌টি রামপ্রসাদ সেনের আর কোন্‌টি দ্বিজ রামপ্রসাদের তা নির্ণয় করা যায় না।’ উপরন্তু ‘রামপ্রসাদ চক্রবর্তী নামে আর এক জন আধুনিক কালের কবিওয়ালাও অনেক পদ লিখেছিলেন এবং শুধুই “রামপ্রসাদ” ভণিতা ব্যবহার করেছিলেন। ... এতে গোলমালের কারণ বেড়েই গেছে’২ যেটা এক্ষেত্রে ভাবার কথা সেটা হলো রামপ্রসাদ চক্রবর্তীকে নয় ছেড়েই দিলাম, সেই সময় বাংলাদেশের দুই প্রান্তে একই রামপ্রসাদ নামধারী দুই কবি কী করে মা কালীকে নিয়ে একই রকমের মান-অভিমানের, অভিযোগ-অনুযোগের কবিতা লিখলেন? উৎসের বিভিন্নতাই তো ব্যক্তিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার বিরোধিতা করছে! সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির কোন গহন গোপন থেকে উঠে এলো এই গলাচেরা আবেগ? তবে কি ১৭৩৯-এর বিশাল প্লাবন/বন্যা, ১৭৪২-৫২-র বর্গী আক্রমণ, ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানির বিজয়ের থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, ১৭৬৯-এর মন্বন্তর এই সবের ফলে বাঙালির কার্ষ সংস্কৃতির যে টালমাটাল আর তার থেকে আসা বিপন্নতা সেটাই রামপ্রসাদদের কলমে উঠে এলো? হতেই পারে! ভবানীচরণ দাসের গাওয়া ‘অন্নদে অন্নদে গো,/ অন্ন দেঅন্নদে,/ অন্ন দাও।/ জানি মায়ে দেয় ক্ষুধায় অন্ন,/ অপদা বিপদিলে পদে পদে,/ অন্ন দে।/ মোক্ষপ্রসাদ দাও অম্বে,/ এ সূতে অবিলম্বে মা/ জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা/ কাতরা হয়ো না প্রসাদে।’ এই অসাধারণ গানে রামপ্রসাদ যেভাবে দৈহিক ক্ষুধা আর আধ্যাত্মিক অশনায়াকে মিলিয়ে দিয়েছেন তার পিছনে পটভূমি যে মন্বন্তর ছিল না বিশ্বাস করতে মন চায় না। শারীরিক ক্ষুধাকেই উত্তীর্ণ করতে চেয়েছেন রামপ্রসাদ আধ্যাত্মিক নিবৃত্তিতে।  



কিন্তু কারুর, এমনকি  অসিতকুমারের মুখেও, ঝাল না খেয়ে আমরা রামপ্রসাদের গানগুলির দিকেই তাকাই না! ঈশ্বরী পাটনীর সেই ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’  আকাঙ্ক্ষা আরেক শাক্ত কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের হাত থেকে যে অন্নদামঙ্গলেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো একথা যে জানে না সে তো বাঙালিই নয়! সেই কথাই কত না পল্লবিত হয়ে কতকোটি বাঙালির অধ্যাত্মসাধনার কিম্বা অনধ্যাত্মসাধনার মর্মবাণী হয়ে উঠেছিলো! পান্নালালের গলায় এই গানটির ভিতরের কথা কত গভীর? তল মেলে না।


চাই নাগো মাগো রাজা হতে
রাজা হবার সাধ নাই মা গো
দুবেলা যেন পাই মা খেতে
চাই নাগো মাগো রাজা হতে

আমারমাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
পাই যেন তায় খড় যোগাতে মা
মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
পাই যেন তায় খড় যোগাতে
আমার মাটির ঘর যে সোনার ঘর মা (২)
ও মা কী হবে দালানেতে
যদি দালান কোঠায় রাখো মা
পারবো না আর মা বলিতে
চাই নাগো মাগো রাজা হতে

যদি দ্বারেতে অতিথি আসে মা
না হয় যেন মুখ লুকাতে
ঘরে কাঁসার থালা কাঁসার বাটি মা
পায় যেন তায় দুটো খেতে। 
তোর সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা
তাই পারি না ছেড়ে যেতে
কেবল কেবল রামপ্রসাদের এই বাসনা
পাই যেন স্থান ঐ পদেতে।।

এই গানের ক্লাইম্যাক্স ‘তোর সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা/ তাই পারি না ছেড়ে যেতে’ আমাকে কেন যেন চিরকাল মনে করিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই গান ‘আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি’। নিজের সংসারের অনেক ঝড় ঝাপটায় মন যখন ডানাভাঙা পাখির মত অবসাদে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে তখন এই গান আর তার এই তুঙ্গভাব যেমন অনেক বাঙালিকে  আবার প্রেরণা যুগিয়েছে তেমন আমাকেও। কিন্তু কেবল এই স্বচ্ছন্দ দিনযাপনের কথা বলে চুপ যাওয়ার বান্দা রামপ্রসাদ নন, তা তিনি সেনই হোন আর দ্বিজই হোন। পৃথিবীতে আর কোথায় সাধক তাঁর ঈশ্বরকে বলতে পেরেছেন ‘দে মা আমায় তবিলদারী।/ আমি নিমকহারাম নই শংকরী/ দে মা আমায় তবিলদারী।/ পদরত্ন সবাই লুটে মা ইহা আমি সইতে নারি।/ তবে ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা সে যে ভোলা ত্রিপুরারি’, তাঁর দৌড় তো আবেদন নিবেদনে শেষ হবার নয়, যতই কেন শেষে তবিলের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা এসে যাক। কখনও কবি দুঃখের দায় চাপিয়ে দিয়েছেন শ্যামার উপরই — ‘মন-গরীবের কি দোষ আছে।/ তুমি বাজিকরের মেয়ে শ্যামা, যেম্নি নাচাও তেম্নি নাচে’।


ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক জননী যদি দুঃখ দেন তবে সন্তানও তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে না কেন! প্রসাদ তাই সগর্বে বলছেন, ‘আমি কি দুঃখেতে ডরাই/ ভবে দাও মা দুঃখ আর কত চাই।।/ আগে পাছে দুখ চলে মা যদি কোনখানেতে যাই/ তখন দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে দুখ দিয়ে মা বাজার মিলাই।।’ কালী একটু জিরোতে হবে, দুঃখের বোঝা তুলে নিতে হবে না। ‘প্রসাদ বলে ব্রহ্মময়ী বোঝা নামাও ক্ষণেক জিরাই।/ দেখ সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে আমি করি দুখের বড়াই।।’কিন্তু সন্তান দুঃখ নিতে শিখে গেছে বলেই মায়ের দোষ কমে যায় না।ঈশ্বর কারুণিক হলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, অন্যায় কেন এ নিয়ে খৃষ্টধর্মের যে চর্চা তারই তাত্ত্বিক নাম  theodicy এই পদাংশটিতে রামপ্রসাদ সোজাসুজি অভিযোগ করছেন বিশ্বনিয়ন্তার বিরুদ্ধে। ‘মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো।/ ওমা মিঠার লোভে তিত মুখে সারা দিনটা গেল।।’

সংসারের দিনযাপনের গ্লানিতে বিপর্যস্ত রামপ্রসাদ যখন বলে ওঠেন, ‘মা আমায় ঘুরাবি কত?/ কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত।।/ ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত।/ তুমি কি দোষে করিলে আমায় ছ’টা কলুর অনুগত।’, তখন কী কৌশলে জন্মমৃত্যুর নিশ্ছিদ্র অলাতচক্রের ডিস্কোর্সকে রামপ্রসাদ জুড়ে দেন তাঁর সামাজিক প্রতিষ্ঠার দৈন্যের গপ্পোর সঙ্গে!

কিন্তু এই সব কথা কি কেবল রামপ্রসাদ সেনই বলেছেন? দ্বিজ রামপ্রসাদের এই পদটিও কম কিসে?

করুণাময়ী! কে বলে তোরে দয়াময়ী।
কারো দুগ্ধেতে বাতাসা (গো তারা)
আমার এম্নি দশা শাকে অন্ন মেলে কৈ?
কারো দিলে ধন জন মা, হস্তী অশ্ব রথচয়।
ওগো তারা কি তোর বাপের ঠাকুর,
আমি কি তোর কেহ নই?
কেহ থাকে অট্টালিকায় মনে কই তেম্নি হই।
মাগো আমি তোর পাকা ক্ষেতে দিয়াছিলাম মই?
দ্বিজ রামপ্রসাদ বলে আমার কপাল বুঝি অম্নি অই।
ওমা, আমার দশা দেখে বুঝি শ্যামা হলে পাষাণময়ী

কিম্বা সব ভোগার শেষে শ্যামার নিজের প্রতি ছদ্ম হতাশার কবিরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ছবিতে একটা গান শুনেছিলাম, সেটা ধনঞ্জয়ের গলায়ও আছে একটু অন্য সুরে, মা মা বলে আর ডাকবো না/ দিয়েছ দিতেছ কতই যন্ত্রণা।/ ...  দ্বারে দ্বারে যাব ভিক্ষা মেগে খাবো,/ মা বলিয়ে আর কোলে যাবো না।’ এই গান নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের অন্য মেরুর। যেমন রাজা নরচন্দ্র রায়ের একটি গান —

যে ভালো করেছ কালী আর ভালতে কাজ নাই।
এখন ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই।
মা তোমার করুণা কত বুঝিলাম অবিরত।
জানিলাম শতশত কপাল ছাড়া পথ নাই।
জঠরে দিয়েছো স্থান করো না অপমান।
এখন কিসে হবে পরিত্রাণ নরচন্দ্র ভাবে তাই। 

আসলে বাংলায় কোনো এক সময়ে রাজা থেকে ভিখারী গেয়েছে এই গান। মায়ের কোলে শুয়েই মাকে কটুবাক্য শোনাবার গান। স্লুইস গেট পার হয়ে কয়েকশো ফুট হাঁটলেই, নয়াপট্টিতে, কেষ্টপুরে, সারা বাংলায় খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের সাথীও এই গান। নয়া উদারনীতিবাদের জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত মানুষ গাইছে। তাদের এই ভালোবাসা টের পেয়েই মুম্বইএর গায়ক/গায়িকারাও রেকর্ড করছেন এই গান। মূলতঃ রামপ্রসাদের কিন্তু অন্যদের রচিত পদেও এই অভিযোগের গানের সমাজ চিন্তাকে তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো বারান্তরে, যদি কাজলবাবু অনুমতি দেন।

গ্রন্থসূত্র
Bertrand Russell, History of Western Philosophy(New York: Simon and Schuster, 1972), p. 21.
https://www.youtube.com/watch?v=- eQWkJej1xs, ২৫শে নভেম্বর ২০১৬ প্রবিষ্ট।
৩। https://www.youtube.com/watch?v=YZJT2wcv9iI, ২৫শে নভেম্বর ২০১৬ প্রবিষ্ট।
৪।অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত  (কলকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সী, ১৯৬৬/১৯৯৮-৯৯), পৃঃ  ২৪০-৪৮







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন