গল্পের মতো
‘বেড়ালের ন’টা জীবন, তোমার ক’টা?’ প্রশ্নটা
করা হলো যেখানে, সেটা ছিল লন। একটু দূরে হেঁটে গেলে সাজঘর। দাঁড়িয়ে আছে নিভা আর্ট
স্টুডিও। আছে মানে ছিল। এখন ঝোপঝাড় আগাছা। গল্পটা ওখান থেকে হেঁটে গিয়ে সোজা, যেখানে মোরাম বিছানো পথ
শেষে পোর্টিকো। দু’পাশে ইতঃস্তত ভাঙা ছাতা, নিচে হাতলভাঙা চেয়ার, ভাঙা সাইকেলরিকশা, মরচে পড়া
সাদা বাতিল এম্ব্যাসাডারের ফাটা টায়ার সরিয়ে কামিনী ফুলের গাছটা দাঁড়িয়ে যেখানে, তার পাশটা জুড়ে এত কালো
দাগ! আজও!
ওইখানেই জন্ম হয়েছিল গল্পটার। যে কোনো গল্পেরই যেমন স্থান কাল পাত্র
থাকে, এরও তা ছিল। স্থানের কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। কাল অর্থাৎ সময়ের কথা বলতে গেলে
প্রথমেই বলতে হয় জলজ কিছু অভিজ্ঞতার কথা, নইলে বৃষ্টি এলো কেন? সন্ধ্যের সে অসম মাধুরীতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি
পড়ছিল অথবা টিপটিপ। মাথা বাঁচাতে কিছু ভীরু এসেছিল ছাতার নিচে, কিছু সাহসী তখন বৃষ্টিতে
ভিজছে আর হাসছে প্রবল। বৃষ্টি থামলে পর, যে যার নিজেদের জায়গায় আবার। তেমনটাই ঘটে। পাত্র বা
পাত্রীদের ভুল বলো বা ঠিক, মুখগুলো প্রায় একই রকম, আর অস্পষ্ট! এরপর গল্প শুরু হলে একে একে মুখ আঁকা হবে, চোখ, চক্ষুদান।
তখন সন্ধ্যে। উত্তমকুমার এই স্টুডিওতে এসেছিলেন মোট সাতবার। অজয় কর-এর একটা ফিল্ম করতে। কী ফর্সা, টুকটুক করছে গায়ের রঙ! চোখে রোদ চশমা। তিনটে টেক। তিনটেই ও কে। সেদিন অবশ্য শুটিং ছিল না। মহরত ছিল কোনো এক নতুন
ছবির। নতুন নায়ক, নতুন নায়িকা। ভীড় উপছে পড়ছে দেখে পুলিশকে মৃদু লাঠি চার্জও করতে হয়েছিল। গুরু চলে গেলে অবশ্য ভীড় পাতলা হয়ে গেল। সেটা
শ্রাবণ মাস। গুরুর জন্মদিন গেছে ক’দিন আগে। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে ক’দিন থেকেই। তনিমা রায় তখন সদ্য অভিনেত্রী, যে ছবির শুটিং চলছে, তার নায়িকাও সে। বেল ফুলের
মালা মাথায়, চোখে লাইব্রেরী ফ্রেমের চশমা। গুরুকে প্রণাম করবে। সাথে ব্লাউজের ফাঁকে গুঁজে রাখা চিঠি। গুরু তার স্বপ্নপ্রণয়ী।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা মারা গেছেন সেই কোন্ ছোটবেলায়! বিধবা মা লোকের বাড়ি
রান্না করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তা বলে কি সে নায়িকা হতে পারে
না? ভালোবাসতে
পারে না মহানায়ক কে? যত্ন করে সাত দিন ধরে লিখেছে চিঠিটা। সেদিন জানলো নিভা আর্টসে তিনি আসছেন, দেখা হবে দয়িতর সাথে। আসব
কি আসব না করে গুরু এলেন। হাসলেন। জয়
করলেন যেমন করেন। তনিমা এগিয়ে গেল দুরুদুরু বুকে চিরআকাঙ্ক্ষিত প্রেমিকের দিকে। রোদচশমার নিচে যেখানে নাক শুরু, তার দু’পাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে হাসি। কী অদম্য পৌরুষ! মনে হয় সঁপে দিই নিজেকে। গুঁড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার বুকের মধ্যে, সে সতই সুচিত্রা থাকুক বা সুপ্রিয়া; তনিমা কম কী’সে! তনিমা এগিয়ে এলো। প্রণাম
করতে নিচু হলো, অবাক হবার কিছুই নেই, গুরু আসলে এ সব ঘটে। গুরুর
হাতটা অজান্তে উঠে এলো কপালে। অভ্যেস। -‘মুখ তোলো দেখি’- তনিমার দিকে তাকিয়ে বললেন। কয়েক সেকেন্ড তো সুযোগ মাত্র। এর
মধ্যেই ব্লাউজে হাত ঢুকিয়ে বার করে নিয়ে আসতে হবে চিঠি। গুঁজে দিতে হবে গুরুর
হাতে। কিন্তু চিঠি কই? –‘এই উঠুন উঠুন! আরে কোথা থেকে যে সব আসে! গুরু বেরুবেন, সরুন তো! আরে এরা
করবে নায়িকার পার্ট, ধুর...!’ তনিমা উঠে এলো। পায়নি চিঠি। মাথা নিচু করে সরে যাচ্ছে। অপমানিত লাগছে খুব। হেঁটে সরে যাচ্ছে দূরে। আর তাই দেখে তিন কো-একট্রেস, যাদের এক্সট্রা বলা হয়, খুব হাসছে, তাদের হাতেই চিঠিটা। পড়ে গেছিল কীভাবে, কে জানে, খুব টেনশন হচ্ছিল তো তার! ‘বেড়ালের ন’টা জীবন, তোমার ক’টা?’ তনিমা আর
দেরী করেনি এক মুহূর্তও। গুরু বেরিয়ে গেলেন তখনই। আর সাজঘরে এসে পেয়ে গেল কেরোসিন ভর্তি একটা জারিকেন, সাথে দেশলাইও। সেই
সন্ধ্যেতে পুড়ে যাওয়া অপ্রাপ্তি আর আকাঙ্ক্ষার মাঝেও কেউ ভাবছিল, চিঠিটা পেলে গুরু কি তাকে একবার কাছে ডাকতেন? হাত ধরতেন?
চোখ রাখতেন চোখে?
সাদা বাতিল এম্ব্যাসাডারের
ফাটা টায়ার সরিয়ে কামিনী ফুলের গাছটা দাঁড়িয়ে যেখানে, তার পাশটা জুড়ে এত কালো দাগ
আজও! ওইখানেই
জন্ম হয়েছিল গল্পটার। নিভা আর্টস স্টুডিও। আছে মানে ছিল। এখন ঝোপঝাড় আগাছা। গল্পটা ওখান থেকে
হেঁটে গিয়ে সোজা, যেখানে মোরাম বিছানো পথ শেষে...
‘বেড়ালের ন’টা জীবন, তোমার ক’টা? দশম বার
জন্মালে হয়তো গুরুর মন...’ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল তারা। আর তারপর কালো ধোঁয়া, কিছু দগ্ধ ক্ষতচিহ্ন আর আবার বৃষ্টি...
গল্প মানে, একটা স্টোরির ভেতরে আসলে
অনেক স্টোরি রাখতে হয়। তবে তো পাবলিক নেবে, না'কি? লোকে পয়সা দিয়ে কি দেখতে আসবে, মাজাকি! স্ক্রিপ্ট
রাইটার তমোনাশকে ডাইরেক্টর বোঝাছিল লোকেশনে দাঁড়িয়ে।
এই তো জীবন, যা অনেকটা গল্পেরই মতো, তাই না কালীদা?
humm...
উত্তরমুছুন