কাজলির গল্প
হিমতাবাড়ি
থেকে দেড় মাইলের হাঁটাপথ, তারপর বাসরাস্তা ধরে একটু এগোলে
ইস্টিসন, দুপুর বারোটায় টেরেন ধরলেই রাতের আন্ধারে বাড়ি।
হাঁস
আর মুরগী মিলে খান তিনেক ওই বেতের ঝাঁকায় আর কাপড়ের পুঁটুলিতে সীতাভোগ চিড়া,
এই হলো পুঁজি। মাথার কাপড়টা তুলে হনহনিয়ে হাঁটা দেয় কাজলি।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় মেয়েটা ক’টা মুড়ি বেঁধে দিয়েছে। তাড়াহুড়োয় খিদের কথা ভুলে গিয়েছিল কাজলি, এখন পেটে বড্ড চাগাড় দিচ্ছে। সাঁকোটা পেরোতেই বুড়ো বটগাছটার ছায়ে বসে দু’গাল মুড়ি চেবায় কাজলি। সামনের দীঘিতে কাকের চোখপানা জল। হঠাৎ মোটর সাইকেলের শব্দ, মাথায় লোহার টুপি তাও মুখটা চেনা চেনা ঠেকে। ঘ্যাচাং করে সাইকেল থামে কাজলির বোঁচকার সামনে। রায়বাড়ির লালচুলো ছেলে, ‘কী রে কাজলি, একা কেন রে?’ আঁচলটা টেনেটুনে বসতেই এবারে আরো অনেক মোটর সাইকেল ভোঁ ভোঁ করে তেড়ে আসে। ক’টা ঠিক মতো গুনতেই হাতের মুড়ি ছিটকে যায়।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় মেয়েটা ক’টা মুড়ি বেঁধে দিয়েছে। তাড়াহুড়োয় খিদের কথা ভুলে গিয়েছিল কাজলি, এখন পেটে বড্ড চাগাড় দিচ্ছে। সাঁকোটা পেরোতেই বুড়ো বটগাছটার ছায়ে বসে দু’গাল মুড়ি চেবায় কাজলি। সামনের দীঘিতে কাকের চোখপানা জল। হঠাৎ মোটর সাইকেলের শব্দ, মাথায় লোহার টুপি তাও মুখটা চেনা চেনা ঠেকে। ঘ্যাচাং করে সাইকেল থামে কাজলির বোঁচকার সামনে। রায়বাড়ির লালচুলো ছেলে, ‘কী রে কাজলি, একা কেন রে?’ আঁচলটা টেনেটুনে বসতেই এবারে আরো অনেক মোটর সাইকেল ভোঁ ভোঁ করে তেড়ে আসে। ক’টা ঠিক মতো গুনতেই হাতের মুড়ি ছিটকে যায়।
সন্ধ্যের আকাশটা বড় অচেনা ঠেকে
কাজলির। বটগাছের পাখপাখালি বাসায় ফিরে
ডানা ঝাপটায়। ছেঁড়াখোঁড়া শাড়িটায় চাপচাপ রক্ত, সারা গায়ে
বিষ বেদনা। বিলের জল নিকষ কালো, হাঁসটা ছাড়া পেয়ে প্যাঁক প্যাঁক করে সাঁতরাচ্ছে। মুরগী দুটো কোথায় কে জানে!
শিয়ালের মতো রাতটা ওত পাতে। দূরে
একটা হৈ হৈ শব্দ ভেসে আসে। টর্চের আলো দেখতে পায় কাজলি। ক্লান্ত মাথা কাত করে ঘুমিয়ে পরে।
আজ সাতদিন হাসপাতালে কাজলি। ছুটি
হয়েই যেত, পার্টির বাবুরা বলেছে মটকা মেরে থাক। ডাক্তার
আসে ওষুধপাতি দেয়। এবেলা মুরগীর ঝোল আর ভাত, ওবেলা রুইয়ের দাগা। সাদা পায়জামা
পাঞ্জাবী পরা বাবুরা নিয়ম করে ফল দিয়ে যায়। ফলগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় কাজলি, কচি দুটো খাবে। মাঝে দু’দিন পুলিশ এসেছিল। কী বলতে হবে, বাবুরা শিখিয়ে দিয়েছে।
গড়গড়িয়ে সেসব বলেছে কাজলি,
এতটুকু ভুলচুক হয়নি। কজন মেয়েছেলে মাঝে মাঝে আসে।
ওকে দেখে মুখটিপে হাসে। আগে গায়ে লংকাবাঁটার মতো লাগলেও এখন সে সব গা সওয়া হয়ে
গেছে কাজলির। বরটা একদিন বলে, পাড়ায় অকথা কুকথা রটছে, কাজলি যেন কান না দেয়! কচিদুটোর খবর জানতে
চায় কাজলি। বরটা কোনো উত্তর দেয় না।
বরের গায়ে নতুন জামা, পায়ে রাবারের চটি মসমস করে। পাখিপড়া
করে বোঝায়, সেদিন রায় বাড়ির ছেলে গ্রামেই ছিল না। কাজলি
জানে, কাজলি কাউকে দেখেনি। কাজলি
মানে কাজলির খিদেপেট একটা বিষফল গিলেছিল। কাজলি বিশ্বাস করে, ওর সাথে কোন
অসৈরণ হয়নি। বড় বড় চোখে শুধু হাসপাতালের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দু’দিন হলো হাসপাতাল থেকে ফিরেছে
কাজলি। শরীর জুতের নেই, মাথাটা টাল
খায়। আজকাল ভাতের চিন্তা নেই কাজলিদের। দু’পক্ষ থেকেই অনেক টাকা পেয়েছে। পাড়ার সবাই আড়েঠাড়ে কানাকানি করে কাজলিরা দেখেও দেখে না।
হাসপাতালের মতো একটা পাখা ঝুলছে চৌকির ওপর। কচিদুটোর নতুন জামা বই খাতা। বরটার একটা কাজও জুটেছে রায়দের মিলে।
আজ টিভি কিনতে যাচ্ছে কাজলি ওর বরের সাথে নতুন সাইকেলে। এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ
ঝকঝকে শান্ত রাস্তায় ওরা দুজন। সাঁকোর সামনের রাস্তায় মোটর সাইকেলের শব্দে একলা মেয়ে চমকে তাকায়।
তার একহাতে হাঁস-মুরগীর ঝাঁকা আরেক হাতে পুঁটুলি; বারোটার ট্রেন ধরতে যাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন