মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

এই রূপকথা


পাতলা শালিখ চেহারার ছোটবউ, গোলাপি হলুদ ছাপা শাড়ি পরা নতুন বধূটি, কথা বলতে খুব লজ্জা পাচ্ছিল। নখ খুঁটছিল। শাড়ি গয়নার শব্দে ঢাকা পড়ে লজ্জায় প্রায় মরে যাচ্ছিল। বসেছিল সবার শেষে। মাথা ঢাকা ঘোমটায়। গায়ে তখনো ফুলশয্যার গন্ধ। বাড়ির ছোট ছেলের বউআর সবার মতো আমার ছোটকাকীমাছোটকাকার বিয়ের তিনদিনের মাথায় মেজকাকা বাড়ির সব বউদের পরপর বসতে বলেছিলবসেছিল বউরা লম্বা দালানের তেলকালো শান বাঁধানো মেঝেয়দালানের শেষ প্রান্তে ঘুপচি ঠাকুরঘর, শুকনো ধানের গন্ধে ভরাছাদের বাঁশ প্যান্ডেলে টেঁপুপিসি তখনো বাসি লুচি তরকারীর বখরা নিয়ে কারোর সঙ্গে কাজিয়া করছে ছোট কাকীমাকে শেষ দেখেছিলাম আঠেরো বছর আগে

ফুলকাকীমা গোলগাল, ভরাট গড়নপুজোর আগে আলাদা উনুনে সারা দুপুর ধরে সবার জন্য লবঙ্গলতিকা, ক্ষীরমোহন, দানাদার, নাড়ু তৈরি করত। ঘোমটা তবু খসতো না মাথা থেকেঘাম মুখে সিঁদূরের টিপটা আরো যেন জ্বলজ্বলে। সকালে চান করে উঠেই পরেছিল, এমন কি আশেপাশের গুঁড়োগুলোও অত ঘামে অক্ষতফুল    কাকীমার সাজের একটা আলাদা বাক্স ছিলএকবার দেখেছিলাম তাতে কাঁটা ক্লিপের ভেতরে ছোট্ট একটা সাদা কালো ছবি। ফুলকাকার। সিঁদূর লেগে ছবিটাও লালকাল থেকে ফুলকাকীমা ওই রকম টিপ আর পরবে না, ফুলকাকা মারা গেল ফুলকাকীমা  এখন কেমন দেখতে হয়েছে, কে জানে!

কচি কলাপাতা রঙ তার। পাতলা ঠোঁট। ধারালো চিবুকসবার মধ্যে থাকলেও ঠিক  চোখে পড়বেই। চোখে পড়বে কী ঘন চক্ষু পল্লব! ভিজে চুল রোজ পয়সা দিয়ে ঘষে  কোঁচকানো করত। নতুনকাকার বউ। আমাদের নতুনকাকীমা। তপন দাদারা বরযাত্রী গিয়েছিল চ্যাটালো মস্ত খোঁপায় রজনীগন্ধার জালি... মধ্যে মধ্যে আড়াআড়ি ছোট  লালগোলাপ। দোতলার উঁচু বারান্দা, জাফরি, পুরনো খড়খড়ি, শ্যামবাজারের ঘিঞ্জি গলি
মল্লিকা, নতুন কাকীমার নাম। বাউন্ডুলে নতুনকাকা দেওঘর না কোথায় চলে গেল, আর কাকীমাও ফিরে গেল বাপের বাড়িসেই যে গেল, আর ফিরল না! বহু বছর পর কানে এসেছিল, বাপের বাড়িতেই অন্নপূর্ণা পুজোর দালানে সেলাই ইস্কুল খুলেছে

ন’বউ-এর মুখখানা গমগমে। মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম ন’কাকার সঙ্গে, বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে। হরিপালেগাছের টাটকা ডাব পেড়ে খাওয়ালো, সঙ্গে ঘরে বানানো মিষ্টি লম্বা উঠোনে সার বাঁধা মরাইসঙ্গী জুটিয়ে সেই মাটির উঠোনেই আমি তখন এক্কা দোক্কা খেলতে শুরু করে দিয়েছি। ওদিকে ঘরের মধ্যে ‘ভালো রান্না পারে, সেলাই পারে, হ্যানা ত্যানা সব পারে...’ 
আমার ন’কাকার সঙ্গে ন’কাকীমার কোনোদিন ঝগড়া হয়নি। শনিবার রাতের শেষ ট্রেন ধরে ন’কাকা বাড়ি আসত, আবার ফিরে যেত সোমবার সক্কালেইসারা সপ্তাহ ন’কাকীমা যৌথ পরিবারের জন্য নাড়ু বড়ি বানানোয় গোটা দুপুর, বাড়ির ছোটদের জন্য গেঞ্জী জামা তৈরি করে সন্ধ্যে পার করতনাঃ, অনেক জলপড়া তেলপড়া ডাক্তার বদ্যি করেও ন’কাকীমার ছেলেপুলে হয়নি
ফোনে এখন কথা বলি ছ’ মাসে একবার। ন’কাকার খনখনে কন্ঠস্বর। যে কোনোদিন মরে যাবে!  

সেজকাকার বিয়েতে আমার যে জামাটা কেনা হয়েছিল, তখনকার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জামা ছিল সেটা। নিউ মার্কেটের। বেলফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ। দক্ষিণেশ্বেরের কো্নো এক তেতলা বাড়ির বারান্দায় বেনারসী পরা সেজকাকীমা বসে। দুধসাদা কপালে চন্দন, চওড়া সিঁথিকন্যা সম্প্রদান হয়ে গেলেই সেজকাকীমা শুদ্ধ সবাই ফিরে এলাম  বিয়ের বাকি পর্ব অর্থাৎ সিঁদূরদান হোম যজ্ঞ সব হবে গৃহ দেবতার সামনে টেপ রেকর্ডারে মহম্মদ রফি সাহেবের বাংলা গান শুনত সেজকাকা, সেজকাকীমা, সঙ্গে আমিও...  তোমার নীল দোপাটি চোখ...  
কর্মসূত্রে সেজকাকা কোথায় যেন গেল একবার মাসখানেকের জন্যবড়রা সেজকা্কীমাকে বলল, দুপুরবেলাটা বইটই পড়তে পারো তো!
এক দুপুরে কাকিমা সেটাই করছিল। বললাম, কী করছ?
বই পড়ছি। নিবি? ... যেন ধড়ে প্রাণ পেল নিয়ে নে...
ব্যস্ সেই মুহূর্ত থেকে বইটা আমারই হয়ে গেল এবং... কে তোকে এ বই দিল রে?
সেজকাকীমা!
সেজবউয়ের জ্ঞানগম্যি সব চুলোয় গেছে দেখছি! নইলে কোনো বাচ্চার হাতে কেউ এ বই দেয়? কোথায় সেজবউ? এখনই ডাক!
আমার সেজকাকীমার নাম ছিল ভারতী আর সে বইটা আর কিছু না, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’
থ্রি জি কানেকশনের দৌলতে আজকাল নাকি খুব জলদি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছেদেখি সেজকাকীমার ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে পারি তো!

মেজকাকীমা এখনো মনে হয় বেঁচে আছে। বীরভূমের পিয়াশুলা গ্রামে বাপের বাড়ি।  ১৯৮৩ সালেই গোবর গ্যাসের ব্যবহার শুরু করে যে গ্রামটি রাতারাতি খবরে উঠে এসেছিল। ইকো ফ্রেন্ডলি 
আমায় দারুণ ভালোবাসত মেজকাকীমাতবে গত উনিশ বছরে মেজকাকীমাকে একবারও দেখতে যাইনি। কেন? প্রশ্নটা ঠিক গাছের পাতা গুনিনি কেনর মতো! কেন ঘুম ভেঙে উঠেই প্রেমিককে চুমু খাইনির মতো!  

আমার মা। বাড়ির বড়বউ। একুশ বছর আগে নিরুদ্দেশ


1 টি মন্তব্য:

  1. তোর এই লেখাটা পড়ে ঝুরোগল্প সম্পর্কে বেশ খানিকটা আইডিয়া হলো । ভালো লিখেছিস ।

    উত্তরমুছুন