গোড়ালি
গোড়ালির চামড়ার মতো হঠাৎ উঠে গেল আমার দক্ষিণ কলকাতার উত্তর উন্মুক্ত ভাড়াটিয়া। আমি শুধু নিচের তলার ছাঁচে ফেলা উপর তলার জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দুটো হলদে ট্যাক্সি। ভরভর আওয়াজ পেলাম ওগুলো উধাও
হওয়ার সাথে সাথে। মনের সাথে গোড়ালির অবস্থাটাও ভালো নেই ইদানিং। সেই কবে থেকে বর্ষাকাল থই থই পায়ে পেট্রোলিয়াম জেলি ঠুসে ঠুসে অপেক্ষা
করছিলাম ফুলকো লুচির সাথে একখণ্ড বেগুন ভাজার। মা শিখিয়েছিল কেউ চলে গেলে দুঃখ
দেখাতে হয়, ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা সব বুকে চেপে প্রয়োজন মতো দুঃখ দেখাতে না
পারলে সমাজ থু থু করে। এই তো সেবার ঠাকুমা মরে যেতে মা আছাড় খেয়ে খেয়ে পড়ছিল
চৌকাঠে। ঠাকুমার খাট আঁকড়ে সে কী কান্না! পাড়াপড়শি সকলে কত
বোঝাল মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে, কিন্তু মাকে কে সামলায়! তারপর যেবার বড় পিসির মেজ দেওরের মেয়ে পালালো আর কাঁদতে কাঁদতে পিসিমা
ছুটে এলেন তার বাপের বাড়ি, মাকেও
দেখেছিলাম পিসিমার গলা জড়িয়ে কাঁদতে। আমি আবার এত কাঁদতে পারি না! সেটা মা কীভাবে
কে জানে বুঝতে পেরেছিল আর শিখিয়েছিল চার পাঁচ দিন ভালো ভা্লো খাবার খেতে নেই। তবে যেদিন
মা মরে গেল সেদিন খিচুড়ির গন্ধ
পেয়ে কেমন মাথা ঘুরে গেল আচমকা। নাক টেনে টেনে বুঝলাম সঙ্গে ইলিশেরও বন্দোবস্ত করেছে পাশের বাড়ির
জেঠু। আটার লুচি থেকে চালের খিচুড়ি! যেন তিরিং
তিরিং করে শীতের গম ক্ষেত থেকে বর্ষার আমন ধানের বাগিচায় লাফিয়ে ফেললাম এক পলকে।
তখনও আমি ছাঁচ জানালায় চোখ নাক ঠেলে দিচ্ছি বাইরের
দিকে। বৃষ্টি পড়ছে, মা ভিজছে ম্যাটাডোরের মাচায় আর জলের ছাঁট এসে বেকার ভেজাচ্ছে মায়ের শিকভাঙা কালো ছাতাটাকে।
আমি সেটাও দেখছি আর চেষ্টা করছি ইলিশ খিচুড়ি ভুলতে। ম্যাটাডোরের চালক দরজার পাশে
দাঁড়িয়ে ‘হয়্যাক হয়্যাক’ শব্দে আমায় চমকে দিয়ে থুথু ফেলছে সদর দরজায়। কেউ চলে গেলে দরজায় দাঁড়াতে হয়, কিন্তু গোড়ালির যা অবস্থা,
মা তো বলেই দিয়েছিল রাস্তায় না বেরোতে।
আমি মায়ের সব কথা শুনি, তাই প্রতিবারের মতো এবারেও খরাগ্রস্ত গোড়ালি আর মনে চার দিনের দুঃখ পোষ মানিয়ে
জানালায় দাঁড়ালাম। সেদিনের পর কেউ
বলেনি দুঃখ করতে, কিন্তু আজ একটু আগে উত্তর উন্মুক্ত ভাড়াটিয়ারা চলে যাওয়ার সময় মায়ের শেখানো কর্তব্যবাণী মনে পড়ল। পাশের বাড়ি থেকে এখন বিউলির ডাল আর আলুপোস্তর গন্ধ আসছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে উত্তুরে হাওয়ায়। সব চলে যাওয়াগুলো একই রকম
গোড়ালি বিহীন, আচমকা শুধু পেট্রোলিয়াম জেলি এক একটা আস্ত গোড়ালি থমকে রাখে ছাঁচ জানালার মেঝের ছকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন