একজন ফেরারি ও পুরিয়াকল্যাণ
সরস্বতী ছিল একটি নদীর নাম। তার পর নামটি ঘিরে একজন দেবীকে কল্পনা করা হলো। তারও পরে কোনও একদিন বৌদ্ধ তন্ত্রের দুর্গম দেবতা। শেষে বাঙালির বসন্ত পঞ্চমীতে সন্ত ভালেন্তিনের নারী অবতার। আধুনিকতম ভিজ্যুয়ালটি শুক্লা, শুভ্রা, মহাশ্বেতা, বীণাবাদিকা এক কোমল তরুণী। বটতলার ক্যালেন্ডারে শাদা শাড়ি, শাদা ব্লাউজ, ক্ষীণতটী, গোলাপি পদ্মাসনা। শিবাকাশির ক্যালেন্ডারে সবুজ শাড়ি, মেরুন ব্লাউজ, পূর্ণ দেহিনী, গুরু নিতম্বিনী এক দ্রাবিড় সুন্দরী। কিন্তু শ্যামলা মেয়েদের দেশে য়্যাপারথেইডের প্রতীক হয়ে এই দেবীমূর্তির কল্পনাটি পৌরাণিক যুগ থেকে পাব্লিক বেশ খেলো। শাদা নাকি জ্ঞানের রং, শান্তির প্রতীক, স্বস্তির ধারক। যাদের গায়ের চামড়া শাদা, তাদের নাকি এসব থাকে, যেমন আমাদের গৌরী দেবীটি।
এহেন দেবীমূর্তির কল্পনা যাঁরা করেছিলেন, ধরে নিই প্রাক পৌরাণিক যুগের ‘আর্য’রা, তাঁরা কিন্তু দেবতাদের পোশাক আশাক বিষয়ে বেশ সাম্যবাদী ছিলেন। পুরুষ বা নারী দেবতার আবরণ কিন্তু অধোবাসেই সীমাবদ্ধ থাকত। উত্তরীয়ের কল্পনা পরবর্তী কালের নাগরিক রাষ্ট্রের সময় এলেও, দেবতামূর্তির কল্পনায় তার কোনও ভূমিকা ছিল না। আর যদি সমান্তরাল ভাবে চলা প্রকৃতিপূজা ও সেই ধারার কল্পিত দেবীদের কথা ভাবি, তবে তো দেখব, ‘বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না, মা আমার তাই দিগ্বসন’, এই তত্ত্ব দু’তিন হাজার বছর ধরে চলেছে। তাই যখন সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর অ্যানাটমির নিবিড় প্রশংসা আবৃত্তি ক’রে ছাত্রছাত্রীরা অঞ্জলি দেয়, তখন জ্ঞানের দেবী (যদি কেউ থেকে থাকেন, মিনার্ভা?) হয়তো নিভৃতে পুলকিত হন। এ জীবনে এখনও পর্যন্ত যত সরস্বতীর রূপকল্প দেখেছি, ক্ষীণ, প্রায় অপ্রকাশ্য নীবিবন্ধে প্রতীকী বসন ব্যতিরেকে কোনও আবরণ কখনও দেখিনি। থাঞ্জাভুরের বৃহদীশ্বর মন্দিরে (একাদশ শতক) আর মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরে (পঞ্চদশ শতক) সরস্বতীর মূর্তি খুব যত্ন সহকারে দেখেছি। রক্ষণশীল দ্রাবিড় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ তীর্থেও আর্য সভ্যতার নন্দনতত্ত্বকে অবিকল অনুসরণ করা হয়েছে।
আচ্ছা, ব্রাহ্মণ মানে কি ‘হিন্দু’ জাতির অংশ একটি গোষ্ঠী? হয়তো না, অন্তত যখন ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দ বা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ‘হিন্দু’ নামে ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠী তো ছিল না! তখন ‘সারস্বত’ সাধনা যে সব মানুষের জীবনচর্যা ছিল তারা সবাই ছিল ব্রাহ্মণ। সেভাবে কি পান্ধারপুরের জন্ম নেওয়া সেই মুসলমান সারস্বত সাধকটিকে ‘ব্রাহ্মণ’ বলা যায়? জানি, এই প্রশ্নের উত্তরে এদেশে সংখ্যায় স্বল্প হলেও কয়েকটি মুষ্টিবদ্ধ হাত এগিয়ে বলবে ‘না’। তিনি দুশো বছর আগে য়মেন থেকে আসা সুলেমানি বোহরাদের বংশধর। তিনি তো ভারতীয়ই নন। এই সব হাত শুধু হুসেনের প্রতি আঘাত হানতে আসে না। তারা ভান্ডারকরের নামাঙ্কিত জাদুঘর ভাঙচুর করে, মীরা নায়ারের সিনেমা সেটে আগুন লাগায়। ইতিহাস বই পুড়িয়ে ফেলে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেবার ছেলেখেলায় মেতে থাকে। হুসেনের ছবি ছিঁড়ে ফেলে হাজার বছর আগের তুর্কি দস্যুদের প্রতি বদলা নিতে চায়। মেরুদন্ডহীন সরকারের সঙ্গে আমাদের মতো নপুংসক দেশবাসী শুধু খবরকাগজে পড়ি, টিভিতে দেখি আর মকবুল ফিদা হুসেন নামক ভারতীয় গরিমাটি কাতারের নাগরিক হয়ে যান সাতাশি বছর বয়সে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই হুসেনকে বলা হতো ভারতের পিকাসো। ১৯৭১ সালের সাও পাওলো বিয়েনালে পিকাসোর সঙ্গে একযোগে আমন্ত্রিত হবার আগে থেকেই এই তুলনার ‘গৌরব’টি তাঁর প্রতি প্রযুক্ত হতো। পিকাসোর দুর্দম শৈল্পিক আবেগের স্বদেশী প্রতিচ্ছবি হুসেনের কাজের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। এ ছাড়া আমাদের দেশে ছবির জগতে হুসেনের সঙ্গে তুলনা করা যায় গানের জগতে ভীমসেনের। হুসেনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জে জে আর্ট স্কুলে, কিন্তু তা নিতান্তই প্রারম্ভিক। আসল শিক্ষা প্রতি বর্গফুটে চার আনা পারিশ্রমিকের হিসেবে সিনেমার পোস্টার আঁকা থেকে শুরু হয়। জীবনের এই পর্বেই তিনি বুঝতে পারেন ছবি মানে ভিজ্যুয়াল, ছবি মানে আগের চোখের পরীক্ষায় পাস করা, ছবি মানে আমি যা দেখতে চাই কিন্তু দেখতে পাই না, ছবি মানে কল্পনার শেষ ঘোড়া যাতে আমি বাজি ধরতে চাই, ছবি মানে এক ধরনের ইল্যুশন যাকে বেদান্ত খুঁজেছিল। এই সব অধরা মাধুরীকে (লিট্যারলি!) ধরতে লাগে অসম্ভব প্যাশন, অন্তর্লীন আকুলতা। এই প্যাশন পুঁথিপত্রে নেই, স্কুল কলেজে নেই, সভাপর্বে বা স্ফটিকস্তম্ভে নেই; আছে শুধু নিজের শিল্পের প্রতি তীব্র আকর্ষণের মধ্যে, জৈব লিবিডোর সীমা বিচূর্ণ করে, সর্বনাশের শেষ দেখতে চাওয়ার মধ্যে। যাকে কোনও মধ্যবিত্ত মননে বাঁধা যায় না, একেবারে তৃণমূলস্তরে প্রকৃতিসঞ্জাত আবেগের ফলশ্রুতি এইসব সিদ্ধি। একালে যা আমরা পেয়েছি হুসেন ও ভীমসেনের দাক্ষিণ্যে। এই সব সৃষ্টির মৌল লক্ষণ হচ্ছে এর সারল্য, ভনিতাবিহীন সৃজনশীল শ্রমের কারুকার্য, যা চোখের কাছে, কানের কাছে, সহস্রার মূলাধারের কাছে আমাদের পার্থিব অস্তিত্বকে আঘাত ক’রে সেই সব অশ্রুত অব্যক্ত সার্থকতার কাছে পৌঁছে দেবে; যখন কোনও মধ্যবিত্ত বুজরুকি না করেও বলতে পারব, ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপরতন আশা করি’। হুসেন ভারতবাসীর গর্ব আর ভারতীয় গণতন্ত্রের লজ্জা।
উৎকেন্দ্রিকতার বিচারে হুসেন সালভাদোর দালিকেও মাৎ করে দেবেন। নিজের উৎপাদিত ফসল, শ্রমের মূল্যের নিরিখ তিনি এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম,
যেখানে সব চেয়ে সেয়ানা বেনিয়াও মাথা ঝুঁকিয়ে সেই দাম চুকিয়ে দেবে। বলা হয়, তাঁর ছবির আর্থিক মূল্য যদি গুণতে বসা হয়, তবে তা আফ্রিকার অনেক ছোট রাষ্ট্রের জিডিপি’র থেকে বেশি হবে। তিনি আগে শ্রমিক, পরে শিল্পী। প্রথমে আর্টিজান, পরে আর্টিস্ট। তাঁর প্রিয় প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রুপ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল দেশভাগের হিংস্র দাঙ্গা আর জাতিদ্রোহের প্রতিবাদে চিত্রকরদের একত্র করতে। তাঁদের স্বরচিত ব্যাকরণের শর্ত ভেঙে ফেলেছিল তদানীন্তন কলাকৈবল্যবাদী শৌখিন মজদুরির ভঙ্গুর মডেলটিকে। বাংলা ঘরানার মার্জনা, লালিত্য তাঁর জন্য নয়। মাটিতে ক্যানভাস ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে ছবি আঁকতেন। কব্জির কোন জোরে ঐ সব বিশাল পটে স্থানিকতা, বর্ণিকতা, আলোছায়ার ফ্ল্যাট বিভঙ্গকে লম্বা তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে নথিবদ্ধ করতেন, বিস্ময়ে মাথা নত করা ছাড়া কিছু করার নেই। তাঁর তুলি যেন ভীনসেনের গমক তান, হলক উৎসার, চাবুকের মতো কানে, ক্যানভাসে আছড়ে পড়ে। মানুষের ছবি আঁকার আদি প্রয়াস রেখাভিত্তিক ড্রইং থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হুসেন মানেন ড্রইংই ছবির মেরুদন্ড। তাঁর সমসাময়িক সব বড় শিল্পীরা রেখার ড্রইং আঁকতে দ্বিধাবোধ করতেন। হয়তো ভাবতেন, রেখাভিত্তিক তেলরঙের ছবির মধ্যে যথেষ্ট সফিস্টিকেশন আনা যাবে না। কিন্তু শ্রমজীবী শিল্পী হুসেন মনে করতেন, আদিম ইতরযানী রেখাপ্রধান ছবির ভাষাই মানুষের কাছে সব থেকে সহজে পৌঁছে যায়। ঠিক এ রকম ভাবতেন ভীমসেনও। চিরদিন অপ্রয়োজনীয় তানকারির চমক থেকে সযত্নে নিজেকে নিরস্ত করে রেখেছিলেন। ‘ম্লেচ্ছ’ হুসেন আর ‘ব্রাহ্মণ’ ভীমসেন ছিলেন আবহমানকালের ভারতীয় ইতরবর্গীয় নান্দনিকতার প্রতিভূ। কমরেড ইন আর্মস। হুসেনের আঁকা দেবী মূর্তির কল্পনা ‘হিন্দুত্ব’পন্থীদের হিংস্র করে তোলে। আবার তাঁর ছবিতে (মীনাক্ষী) ব্যবহার করা একটি গানের বাণী কট্টরপন্থী মুল্লাদের প্রবল বিরোধিতার শিকার হয়। মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক, এই সব প্রতিক্রিয়া বস্তুতঃ ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’ নির্বিশেষে ইতরবর্গীয়দের প্রতি ‘ব্রাহ্মণ্য’বাদীদের চিরকালীন আক্রমণাত্মক রণনীতির অঙ্গ। ইতিহাস বলছে, ভারতবর্ষে সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে নিম্নবর্গের সংখ্যাগুরু মানুষজনই ধরে রেখেছে চিরকাল। ব্রাহ্মণ্য বা মুল্লাবাদী সংস্কৃতির উৎসমুখেই থাকে বিভাজনের বিষক্রিয়া। হুসেনকেও এই বিষ ধারণ করতে হয়েছিল দীর্ঘদিন।
প্রচুর নিরেস ছবিও এঁকেছেন হুসেন। ছবি নিয়ে অকারণ বাণিজ্য করেছেন। যা কিছু করেছেন তার মধ্যে সতত অল্পবিস্তর ‘শক ভ্যালু’ আরোপ করেছেন। মানুষকে চমকে দিয়ে শিশুর মতো উপভোগ করেছেন। যাবতীয় ভারতীয় দর্শন ও পুরাণশাস্ত্রে অগাধ বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। বস্তুত তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলি সব ভারতীয় পুরাণের মিথস্ক্রিয়ার ফসল। কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম। সরস্বতীর ‘লজ্জা নিবারণ’এর দায়িত্ব তাঁর জন্মগত কর্তব্য। তিনি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো স্বপ্নে দিগম্বরী দেবীমূর্তি দর্শন করার অধিকারী নন। তাঁর জন্য এরকম কল্পনা করাও পাপ। তিনি তো ব্রাহ্মণ নন, ‘হিন্দু’ও নন। এই সব ধৃষ্টতা যদি করে ফেলেন তবে তাঁর বিচার করবে কয়েকজন দুর্বৃত্ত, যাদের ‘শিল্প’ শব্দটি বানান করার যোগ্যতা নেই। তারা চোখ পাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে বলবে, ‘আঁকো তো দেখি পয়গম্বরের ছবি, আঁকো দেখি মা ফতিমাকে নির্বসন করে!’ আমরা বিশ্রুত উদার, অত্যন্ত সহিষ্ণু, অহিংস্র সভ্য জনতা। শুধু ছবিগুলো ছিঁড়েই ছেড়ে দিলাম। নয়তো...! মজার কথা, এই জাতীয় প্রতিক্রিয়া শুধু চন্দন মিত্র বা বাল ঠাকরে জাতীয় লোকেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সতীশ গুজরালের মতো একজন শ্রদ্ধেয়, মূর্ধণ্য শিল্পীও এই রকম কথা বলেছিলেন। এ কী শুধু ‘শিল্পী’র উষ্মা, না পেশাগত ঈর্ষা? কে বলবে? যদিও সতীশ, হুসেনের দেশত্যাগ'কে ‘জাতীয় লজ্জা’ আখ্যা দিয়েছিলেন এবং ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে হুসেনের অবদান'কে চূড়ান্ত প্রশংসার সঙ্গে স্মরণও করেছিলেন।
হুসেন স্বেচ্ছায় ফেরারি হন। কিন্তু বুকের ভিতর রাত্রিদিন জেগে থাকে ভারতবর্ষ। কখনও অভিযোগ করেন না তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। সতত বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় নিরাপত্তার প্রয়োজনে দেশ থেকে দূরে রয়েছেন। চলে যাবার আগের দিন বোম্বাইয়ের কুলফি ফালুদা খেতে চান। মহার্ঘ সাহেবি আইসক্রিম প্রত্যাখ্যান করেন। নিজের সৃষ্টির পঙ্কিল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে কোনও জবাবদিহি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কারণ তিনি জানতেন, এই সব নির্বোধের সংখ্যা তাঁর গুণগ্রাহীদের তুলনায় নগণ্য। হুসেন এবং ভীমসেন চিরকালীন ভারতীয় সাব অল্টার্ন সংস্কৃতি চেতনার এ যুগের পুরোধা। ব্রাহ্মণ্য ছুঁতমার্গের বিরুদ্ধে প্রাংশু প্রতিবাদ।
আগামী ১৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর একশো এক’তম জন্মদিন। একশো পেরোনো মানে তো একেবারে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া। ভাবা যায় না, হুসেন কী ইতিহাস হয়ে গেছেন? তিনি তো অনুরাগীদের মনে এখনও সমান সতেজ, সবুজ, চঞ্চল। নেহাৎ সমাপতনই বলতে হবে, এই লেখাটি লেখার সময় ভীমসেনের পুরিয়া কল্যাণ শুনছিলাম ক্রমাগত। গানটি আমাকে ট্রিগার করছিল নানা চিন্তায়। সেই পুরনো, হাজারবার শোনা বন্দিশ, ‘বহুত দিন বিতে, অজহুঁ ন আয়ো...’
ফেরারি আর ফিরবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন