শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

পেলেট




১৩..২০১৬ শ্রীনগরের SMHS হসপিটালের অপথ্যালমোলজি ডিপার্টমেন্টে চোখ-রোগীদের ঢল নেমেছে। ভারত রাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী কার্যক্রমে শেষ তিনদিনে যে ১০২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে এই হসপিটালে, তাদের চোখে পেলেট নামক এমিউনিশন প্রয়োগের ফলে আংশিক বা সম্পূর্ণ অন্ধত্বের সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তারদের মতে গোল বা ছুঁচের মতো শার্প পেলেট চোখের ভেতর গিয়ে রিভল্ভ করতে থাকে আর দূষণ ছড়ায়। শেষ দুদিনে এই হসপিটালে ৮৭টি আই-সার্জারী হয়েছে এবং ডাক্তাররা  বলছেন, এদের ৪০ জনের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তত দুটি বা তিনটি অপারেশনের দরকার ডাক্তারদের অনেকেই অবাক হয়েছেন যে, ওয়ারজোনে  ব্যবহার হওয়া এই অস্ত্র কেন ভারতীয় প্যারামিলিটারী শান্তি-প্রতিষ্ঠার কাজে প্রয়োগ করছে! রোগীরা বলেছে তারা অনেকেই এই বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্তও ছিল না। শুধু  প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাই তাদের দৃশ্যজীবন পছন্দ হয়নি রাষ্ট্রের। হয়তো তাদের কেউ  কেউ শব্দ করছিল। যা দেখছিল তা ভালো না লাগায় অভিযোগ করছিল। হয়তো তাদের কারুর কারুর শব্দ-দৃশ্য সংলাপ রাষ্ট্রের স্বাধিকার হানি করছিল। স্বাধিকার হয় রাষ্ট্রের নয় নাগরিকের হয় এসপার নয় ওসপার। রাষ্ট্রজীবনে প্রক্ষোভ-শব্দ তৈরি হলে  রাষ্ট্র, শান্তির  আক্ষরিকতায় দৃশ্য-দূষণের মাধ্যমে শব্দ দূরীকরণে দ্য হয়। রাষ্ট্রের  কান বন্ধ করতে গেলে তাই নাগরিকদের চোখ বন্ধ করতে হয়। আর 'law and order'এর নামে যেটা চলে, তাকে তো রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন আগেই দারোয়ানী বলে গেছেন।  
  
কানের ভেতর দিয়ে যা কিছু ঢোকে, সেইসব অনর্গল অভিযোগ-শব্দ চোখের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আমি কানের ভেতর শুয়ে থাকি। চোখের ভেতরে দাঁড়িয়ে। আর অভিযোগ-শব্দেরা চোখের বাইরে পড়ে থাকা আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ধরে বাবা-মা হাত ছাড়ানো বিচ্ছু বাচ্চার মতো তড়তড় করে এগিয়ে যায়। মনে  হয় অভিযুক্ত হওয়ার জন্যেই জন্ম হয়েছিল ভাষার, কথোপকথনের। যে সব কথাবার্তা মিহি ছিল আদিকালে তা এখন দ্বিপাক্ষিক গর্জনে বিরাগভাজন হয়েছে। শরীরের ওপর শব্দের সংরাগ এখন সংক্ষোভে পরিণত হয়েছে। শ্রবণের চরাচর জুড়ে প্রতিধ্বনিত অভিযোগ-শব্দ দৃশ্যের ক্যানভাসে ঢালা সহসা রক্তের উৎস্রোত, যা রেড ওয়াইন হতে জানে না। অভিযুক্ত রক্ত আনুভূমিক ক্যানভাসে ছড়িয়ে না গিয়ে উল্লম্ব হয়ে দৃশ্যশাসন করে। আমি চোখের ভেতর শুয়ে থাকি আর কানের ভেতর দাঁড়িয়ে। চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে আসছে যে অশুদ্ধ দৃশ্য তা অভিযোগ-শব্দের মোহগ্রস্ত। চোখের ভেতর দিয়ে যা কিছু ঢোকে তা কি কানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে? কণ্ঠের দৃশ্যস্বর আহুত হলেও দৃশ্যের কণ্ঠস্বর এখনো কণ্ঠরুদ্ধ।  

ইয়ার মানেই ইয়ারফোন। ভ্রাম্যমান সময়-মানুষেরা যন্ত্রের ওপারে অন্য কারুর সাথে কথাবার্তা চালায়... বার্তা না থাকলেও কথা চলতে থাকে... যন্ত্রের সঙ্গে কথা চালাচালি করে। দৃশ্যজীবন চলতে থাকে একদিকে। আর কানের প্রকোষ্ঠ মধ্যে ধ্বনিজগৎ, শব্দজগৎ অন্য আরেক টার্ন নেয়। দৃশ্যজীবন আর শ্রুতিজীবনের মধ্যেকার যাবতীয় সম্পর্ক ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে, তারপর অন্তর্হিত হয়। সময়-মানুষেরা সময়কে ইন্দ্রিয় দিয়ে ভাগ করে নিতে ব্যস্ত। তাদের দৃশ্যজীবন ধীরে ধীরে শ্রুতিজীবনকে ভুলে যায়। আর শ্রুতিও দৃশ্যকে। দেখার সাথে শোনার এই ঘোর অমিল দেখেই অভিযোগ-শব্দের দল ফিরে আসে। দেওয়াললিখনকে তারা ফেসবুক পোস্ট বানিয়ে দেয়। অভিযোগ-শব্দেরা দৃশ্যকে শব্দ চিনতে বাধ্য করে। 

মেয়ের জন্মদিনে অফিস থেকে সদ্য বাড়ি ফিরে বাবা যখন সোফায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে, কান থেকে তখনো ইয়ারফোন সরিয়ে নেয়নি। এফ-এম স্টেশনে সান্ধ্য সংবাদ। বাগদাদে বিস্ফোরণ, মক্কাতেও আর বাংলাদেশে হোস্টেজ সিচুয়েশন। স্ত্রী-কন্যা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একমুখ হাসি নিয়ে। সামনের টেবিলটায় এনে বসিয়ে দিচ্ছে মেয়ের তিন বছরের বার্থডে কেক। সাদা একটা তিনতলা বাড়ি। বরফাবৃত। হয়তো বা সাউন্ড প্রুফ। তিনতলার মাথায় একটা রেড চেরী। স্ত্রী অনুযোগ করছে, এখনো কানে ইয়ারফোন! আর মেয়ে কোলে বসে বাবার কান থেকে খুলে নিচ্ছে দৃশ্যহীন ধ্বনির উৎস। কিন্তু শব্দ ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে নিভন আলোর মতো। বাবার কানের মধ্যে ঘুরঘুর করছে একতাল বিস্ফোরণ-শব্দ। বাগদাদ... মক্কা... ঢাকা... এরপরেই কি কলকাতাকেন কলকাতা? কেন কলকাতা নয়? বাবা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সাদা তিনতলা কেক-বাড়ির ওপরকার লাল চেরীফলের দিকে। কখন গর্জনের অভিযোগে ফেটে পড়বে সেই ফল। বাগদাদ... মক্কা... ঢাকা... কলকাতা - একতাল বিস্ফোরণ-শব্দ! কে জানে হয়তো চেরীফলের মধ্যেই রয়েছে পেলেট। ফল ফাটলে স্বামী-স্ত্রী-কন্যার চোখে নেমে আসবে অন্ধকার। তাদের তিনজোড়া চোখে গোল হয়ে ঘুরপাক খাবে সেই অন্ধকার। চাকতি হয়ে কিম্বা ছুঁচ হয়ে পেলেট দৃশ্যশাসন করবে নিঃশব্দে। ওলোটপালোট করে দেবে সব। তখন কে হবে সেই অন্ধকারের দারোয়ান? গল্প না রাষ্ট্র

[এই লেখার মূলে যে ছবিগুলি রয়েছে তার একটি এখানে রইলো। ছবিটি কাশ্মীর রিডার নামক অনলাইন সংবাদপত্রিকার আইউইটনেস শীর্ষক প্রতিবেদন (১৩..২০১৬) থেকে নেওয়া হয়েছে।]


২টি মন্তব্য: