চোখ
তিড়িক তিড়িক করে দুবার। সঞ্চিতা চোখ সরিয়ে নিল। ভুল দেখছে,
নির্ঘাৎ ভুল। সোফায় বসে ঝুঁকেছে শালের ডাঁইয়ের ওপরে। ভালো স্টক। হাল্কা মেশিনের কাজের সংখ্যা বেশি। দাম তুলনায় কম বলে বিক্রি ভালো হয়তো। পিক্টোগ্রাফে ফুলপাতা জাবরা কাজ পছন্দ না। জামরঙ শালটা তুলে নিয়ে গুছিয়ে
নামাল বাঁ কাঁধে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাল, যেন ঝুলন্ত আয়না
সামনে। চোখাচোখি হওয়ামাত্র আবার তিড়িক! চমকে উঠল সঞ্চিতা। কান গরম, মাথা ঝাঁ ঝাঁ। চশমা নাকে বসাল চেপে। অযথা ফুলবডি হাউসকোটের গলার কাছে
দু’মাথা টেনেটুনে-। পাগল নাকি ছেলেটা? চোখ সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। হাতের শাল খসাল নিচে। রহস্যময় হাসছে কেমন! আনকোরা
কাশ্মীর থেকে সোজা? পাঠান? গলার আওয়াজ গমগম কৈশোর পেরনো। পুশতু মেলানো হিন্দী এমন খটমট, এমনকী সঞ্চিতার কানেও ঠেকছিল।
হামি প্রথমবার এলাম
বঙ্গালে।
কাশ্মীর হাম কভী
নেহী জায়া থা। বহুৎ আচ্ছা হ্যায় শুনা হ্যায়।
কভী আ জাও, মেরা ঘর—।
তোমার ঘরে কে আছে?
মা বাবা? ভাইবোন?
বিবিও আছে।
বিবি! ওমা! কত বয়স?
সে তাহলে ছোট পুতুলের মতো। না?
ছেলেটা এক মিনিটও চোখ সরায়নি সঞ্চিতার মুখের ওপর থেকে। সুর্যোদয় রঙের
সুকুমার মুখ। সূর্মামাখা কুচকুচে দীঘল চোখ। লম্বা চুল। থুতনিতে দাড়ি। সবল দুই কাঁধ,
হাত। আফগানি কুর্তা-পায়জামা। সঞ্চিতা মুগ্ধ হয়েছিল, আসল কাশ্মীরী।
না, আমার চেয়ে বড়। আমার চব্বিশ, বিবির আঠাশ। আমাদের পরিবারে এরকম হওয়া দস্তুর।
ও, তাই নাকি? ঠিক
আছে। আচ্ছা, আসল পশমিনা জামেয়ার রাখ তুমি? দেখাও তো।
বিবি তো বড় হওয়া
উচিৎ। সব কিছু সামলায়, অনেক শিখিয়ে দেয়। তোমার আদমী? ছোট
না বড়?
বিচ্ছিরি অস্বস্তি
লাগছিল রোদ্দুরভরা বেলা এগারোটায়, তিনতলায় নিজের লিভিংরুমে বসেও। রূপম কলেজে,
শুভঙ্কর অফিসে। সঞ্চিতার চোখে ফেলা ওই দৃষ্টি স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ। বুকের মধ্যে শাবল দিয়ে মাটি খোদার ভয়ানক গুমগুম
শব্দ শুনে সঞ্চিতা উঠে দাঁড়াল। ছেলেটাও সঙ্গে সঙ্গে। কেমন এক বিহ্বল হাসি। আহ্বান? ডিসেম্বরেও হাতের
মধ্যে শক্ত মুঠোয় ফোন ঘামে ভিজছে। দরকার হতে পারে হয়তো এইমাত্র। যদি ওর সবল হাতটা বাড়িয়ে ফোন কেড়ে নেয়? তাকে
জাপটে ধরে? শিরশিরানি বাইছে ঘাড় থেকে
নিচে। পায়ে পায়ে এগিয়ে দরজাটা অন্তত হাট করে খুলে দেবে? কেউ দরজা ঠেলছে।
সঞ্চিতা তোমার দরজা
ভেজানো দেখে ঢুকে পড়লাম গো! ওমা শাল দেখছ নাকি? তা আমাদের শালওয়ালা এলো না এবারে? দেখি কেমন জিনিস রেখেছে!
ওমা আরে মুক্তিদি?
বস দু’কাপ চা করি। দেখ তুমি, তেমন পছন্দসই কিছু নেই। ওই নিচে সাইকেল ঘন্টি দিচ্ছিল। ভাবলাম ডেকে একটু
দেখি। ধুৎ নেব না।
পশমিনা জামেয়ার
দিখোগী বোলী থী। হ্যায় মেরে পাস। দিখাউঁ?
চাই না চাই না—। যাও যাও ঘরসে আভী।
লেনা নহীঁ হ্যায়? বোলী
থী তুরন্ত্! পানী পিলা দো থোড়া-।
যাও এখন, বাহার যাও
তো!
সঞ্চিতা লম্বা আঙুল
দেখিয়ে দিচ্ছে দরজার দিকে। ছেলেটা দৃষ্টি সরাচ্ছে না একবারের জন্যেও। চোখ স্থির,
গনগনে। বোঁচকা দুটো কাঁধে তুলে পিছিয়ে যাচ্ছে আস্তে করে।
সঞ্চিতা প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে বন্ধ করল দরজা। ডাইনিংস্পেসে বোতল থেকে ঢোঁকে ঢোঁকে জল
খেল।
সকালের ঘটনা শুভঙ্করকে
জানালে কপালে দুঃখ আছে। খবরকাগজ ভাঁজ করা সেন্টার টেবিলে।
ভাতঘুমের আগে টেনে নিল সঞ্চিতা। সামনের পাতায় একটা ছবি- ধরা পড়ার আগে আত্মঘাতী। মুক্তিদি
বলছিল,
খবর দেখেছ সঞ্চিতা?
কুড়ি বাইশের বাচ্চাবাচ্চা ছেলেগুলো নাকি জঙ্গী—
আতঙ্কবাদী! কীভাবে মারছে, নিজেরাও মরছে। প্রাণের তোয়াক্কা করে না এরা।
ছবির মধ্যে তীব্র
তাকিয়ে সঞ্চিতা। বয়স লেখা আছে একুশ। কাটা ধারালো মুখের গড়ন। কার সঙ্গে যেন খুব মিল! চোখদুটো গভীর টানা, গনগনে জ্বলন্ত। থুতনিতে একটু দাড়ি।
মোবাইল বাজছে
বালিশের পাশে। রূপমের ছবি আলো হয়ে ফুটছে। সঞ্চিতা অনিচ্ছাকৃতভাবে আবিষ্কার করল ছবির
সঙ্গে রূপমের অনেক সাদৃশ্য। চোখদুটো শালওয়ালা ছেলেটার মতো!
নিচে আবার ক্রিং
ক্রিং আওয়াজ সাইকেলের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন