শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

শ্যামশ্রী চাকী

জার্নি

জলপাইগুড়ি রোডে এই স্টেশনটা শহরের গা ঘেঁষেই। বেগুনটারি থেকে মাত্র মিনিট  দশেক। আজকাল খুব টোটো চলছে শহরে। ছোট্ট লাগেজটা নিয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে হাঁটা শুরু করতেই সামনে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। মন ভালো করে দেওয়ার জন্য পর্বতরাজের এক ঝলকই যথেষ্ট। টিকিট বের করে সিট নাম্বারটা মিলিয়ে হাত পা ছড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুমন। এই কম্পার্টমেন্টটা প্রায় ফাঁকা, দু' জোড়া   নববিবাহিত দম্পতি, এক ল্যাপটপে মগ্ন যুবক, মাংকিক্যাপ জড়ানো বৃদ্ধ আর সে। ইতিমধ্যেই দুবার চা আর ঝালমুড়ি বিরক্তিকর ভাবে হেঁকে গেছে। নিউজ পেপারটা মেলে চোখ রাখতেই সামনে সেই বহু পরিচিত অবয়ব। হলুদ চুড়িদারে শ্রেয়া। মনে প্রাণে খবরের কাগজে মনোনিবেশ করে সুমনকিন্তু মুখ কুঁচকে খবরের কাগজ আড়াল করেও শেষ রক্ষা হয় না। ব্রহ্মতালুতে ঘিলু নাড়ানো চাঁটি, সাথে সেই হাড়পিত্তি জ্বালানো কান এঁটো করা হাসি। স্মার্ট হওয়ার অহেতুক চেষ্টা করতেই দাঁত বেরিয়ে চূড়ান্ত ক্যাবলরাম সুমন

ট্রেন চলতে শুরু করে দুলকি চালে। শ্রেয়া! পাক্কা তিন বছর বাদেবিয়ের পর খানিকটা মুটিয়েছে, তবুও তেলে কাজলে যথেষ্ট সুন্দরী।
'
তুই আমাকে ফেবুতে ব্লক মেরেছিস কেন রে? ঝটপট নতুন মোবাইল নাম্বারটা দে,  হ্যোয়াটস এ্যাপে এ্যাডাই। একটা এ্যাপস ডাউনলোড করতে গিয়ে সব উড়ে গেছে।'
উত্তরের অপেক্ষা না করেই তরবড়িয়ে বলতে থাকে শ্রেয়া। 
'তোর মতো স্মার্ট ফোন নিয়ে  সব যায়গায় ঘুরি না।' গলা দিয়ে ধাতব শব্দগুলো কোনোক্রমে ছিটকে আসে।
'
আর কত ঢপ দিবি! কিপ সাম রেস্পেক্ট ইয়ার... আভি ভি ওযাক্ত হ্যায়শুধর যা...!' ঝাঁঝিয়ে ওঠে শ্রেয়া। ছোঁ মেরে পকেট থেকে স্যামসঙ সেভেনটা বের করে পাসওয়ার্ডে আঙুল বোলায় আলিবাবার মন্ত্রের মতো আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা খুলেও যায়। এবার নিজের নাম্বারটা ডায়াল করে লাল লেদারের ব্যাগটা থেকে মুঠোফোন বের করে তড়িৎগতিতে, নাম্বার সেভড। নিজেকে বড় অসহায় লাগে সুমনেরআজ থেকে আবার রোজ একবার করে রাজকন্যের রাজত্ব রাজপাটের রূপকথামালার এপিসোড চলবে, সাথে ব্রেকিং নিউজের মতো মাখো মাখো কাপলের এভার স্মাইলিং ছবি। পাহাড়, সমুদ্র থেকে চীনে রেস্তরাঁ, রান্নাঘর কিছুই বাদ যাবে না। কেন যে প্রতিবার এই বিশ্বধড়িবাজ মেয়েটার কাছে গো হারান হেরে যায়! কিছুতেই মাথায় ঢোকে না সুমনের

ট্রেন মিটারগেজে বাঁক নিয়েছে। শীতের সকালে এখনো আলো সেভাবে ফোটেনি। কুয়াশামাখা বনানী এখন প্রচন্ড ভাবে রহস্যময়ী। খোলা জালানা দিয়ে হু হু হাওয়া বইছে। কালো পশমিনাটা গলা পর্যন্ত টেনে বসেছে শ্রেয়া কার সাথে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে মোবাইলে। হাওয়ার ঝাপটায় কুঁচোচুল উড়ে নাকে গালে পড়ছে। ভ্রু কুঁচকে একহাতে সরাচ্ছে সেগুলো। কাচের সার্সিটা নামিয়ে দেয় সুমন।

গতি বাড়ায় গাড়িফ্ল্যাশব্যাকে কলেজ ক্যান্টিন। টেবিল বাজিয়ে গলা ফাটিয়ে গান গাইছে শায়ক, সঙ্গতে গিটারের পিড়িংপিড়িং সুমনের। টেবিল চাপড়াচ্ছে গোটা আর্টস ডিপার্টমেন্ট। হঠাৎ অকাল কালবৈশাখীরূপিনী শ্রেয়া। হাতের গিটার এক ঝটকায় কেড়ে নোটসের তাড়া হাতে ধরিয়ে দেয়। 'এক্ষুনি জেরক্স করে নিয়ে আয়!'
সুলতানা রিজিয়ার সামনে সুমন সামান্য দাসানুদাস অবজ্ঞা করার সাধ্য কোথায়? শিরায় ধমনীতে প্রবাহিত আজও সেই অনুগত শোণিত স্রোত।

ফাইনাল ইয়ার, ফোর্থ সেমিস্টার সামনে। প্রোজেক্ট সাবমিশনের তারিখ পেরিয়ে গেছে। ঘাড় গুঁজে ফাইল রেড়ি করছে সুমিত। হঠাৎ দরজায় বেল আধখাওয়া ভুট্টা হাতে  গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে আবির্ভাব বেগমসাহেবার ল্যাপি বিগড়েছেঝরঝরে ল্যাপিটা তিন ঘন্টা ধরে ফরম্যাট করে প্রোজেক্টের চোদ্দগুষ্টির লেফট ওভারে কাজ সারল সুমন। ভাবলে এখনো চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে যায় অলক্ষ্যে দাঁত কিড়মিড় করে সুমন

গাড়িটা এখন গতি কমিয়েছে। দূরে পাহাড়গুলো স্পষ্ট। তিরতিরে নদী, সবুজ চা বাগান থেকে ভেসে আসা মন কেমন করা গন্ধ, আঠার মতো কুয়াশা, ফ্যাক্টরির চিমনির ধোঁয়া সরে সরে যায়। এন জি পি স্টেশনে সাদা এম্বাস্যাডারটা দাঁড়িয়েই   ছিল। ধীর পায়ে গাড়িতে ওঠে সুমন। শুকনা ফরেস্ট পেরিয়ে গাড়ি ছোটে তিস্তা বাজারের দিকে শ্রেয়ার পশমিনাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দেয় সুমন। বিয়ের  তিনবছর বাদে আজ তাদের মধুচন্দ্রিমা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন