সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

বারীন ঘোষাল

বহে যাই বহেরাগোড়ায়




কম বয়স থেকেই পথ আমাকে ভীষণ টানে বন্ধুর মতো। তাই কখনো বিপথে পড়িনি। বিপদে পড়িনি। প্রথমে সাইকেলে তারপর ক্রমে নিজেদের দ্বিচক্রযানে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাবার রোমান্সের তুলনা নেই। আর গড়েছিলাম কৌরবদলবল মিলে নানাদিকে। চলে যেতাম বারিপদা হয়ে সিমলিপালের দিকে, কখনো বালেশ্বর হয়ে চাঁদিপুরে, কখনো লোধাশুলি পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম। প্রতিবারই বহেরাগোড়া ক্রসিং পেরিয়ে যেতে হতো। বহেরাগোড়ায় এন এইচ ৩৩ থেকে ওড়িষ্যার দিকে সুবর্ণরেখার ব্রিজ পেরিয়ে গেছে বড়রাস্তা। প্রতিবার এখানে একটা ব্রেক নেবার জন্য ক্রসিং মোড়ের বিয়ার শপে বসে গলা ভিজিয়ে নিতাম। সেরকমই বিশ্রামে বসে একবার বহেরাগোড়ার মিঠু (পুরো নাম মনে পড়ছে না) নামের এক তরুণ কবির কথা উঠল যে বহেরাগোড়ায় লিটল ম্যাগাজিনের অভাবের কারণে জামশেদপুরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছিল কৌরবের প্রতি আগ্রহে, সে এখানেই থাকে, মনে পড়লআরে! এতবার যাই আসি, ভেতরে ঢুকে এই আধা শহরটা দেখা হয়ে ওঠেনি! ঠিক করলাম নেক্সট ট্রিপ এখানেই। জামশেদপুরে বাড়ি ফিরে প্রণবকে ধরলাম। প্রণবকুমার দে সারা জীবন হিমালয় থেকে নীলগিরি আর সমস্ত জঙ্গল চষে বেড়িয়েছে,  তার জানাশোনা বাংলো চারদিকে, বললাম ওখানে একটা ব্যবস্থা দেখ। তো সে ঠিক মোড়ের মাথায় ন্যাশনাল হাইওয়ে ইন্সপেকশন বাংলোটাই বুক করে ফেলল। ১৯৮৩ অক্টোবরের শেষে আমরা রওনা দিলাম। আমরা – আমি, কমল চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী সুশ্বেতা, দীপক চ্যাটার্জি (নাট্যকার), ধীরাজ জানা (নাট্য সমাচার পত্রিকার সম্পাদক), আর বাবু প্রণবকুমার দে, যে মাটিতে থাকলেও মাথাটা নন্দাদেবীতে থাকেমালপত্র নামিয়ে চা-এর উদ্দেশে শহরে ঢুকছি, মিঠুকে আগেভাগেই চিঠি দিয়ে রেখেছিলাম, দেখি সে আসছে। কী আনন্দ! মিঠুর কাছেই শুনেছিলাম তার মাস্টারমশাই জ্যোতির্ময় বাবুর কথা যিনি ছাত্রদের নিয়ে পড়ানো, নাট্যচর্চা, আর লাইব্রেরি গড়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। সেই মহাপুরুষকে প্রণাম করে আমাদের বহেরাগোড়া ভ্রমণ শুরু করা যাক।


চা আর পান খেয়ে হেলতে দুলতে আমরা জ্যোতির্ময় বাবুর বাড়িতে পৌঁছলাম। ভিতরে ঢুকে সবাই তাঁর লাইব্রেরি দেখে হাঁ হয়ে গেছি। আমাদের শহরে এতবড় লাইব্রেরি ছিল নাসেই ১৯৬৮ থেকে শুরু করে জামশেদপুরে এমন একটা লাইব্রেরির অভাবে যে কষ্টে ছিলাম! অথচ এখানে কোনো লিটল ম্যাগাজিন নেই। বাংলায়  পড়াশুনো হয়, কবিও নিশ্চয়ই হয়তাহলে এই প্রৌঢ় মাস্টারমশাই কোন্‌ আনন্দে তিল তিল করে লাইব্রেরি গড়ে তুললেন? তাও পাকা বাড়ি না। টিনের চাল, সিমেন্টের  মেঝে, রীতিমতো লোহার র‍্যাকে থরে থরে বই রাখা। ঘরে মৃদু আলো দিনের বেলাতেও। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, বাংলা আর ইংরিজি, হাজার হাজার বই।  উই আর ইঁদুরের সাথে যুদ্ধ করে বাঁচিয়ে রাখা দশ বিশ বছর, শুধু একটা প্রাইভেট কালেকশন ছাত্রদের জন্য, কত ভালোবাসা থেকে এর অভিভাবনা! নিরহঙ্কারী জ্যোতির্ময়বাবুকে আমরা সবাই প্রণাম করলাম।

তিনি আমাদের ভেতর বাড়ির দাওয়ায় চেয়ার মাদুর পেতে বসিয়ে আলাপ করতে করতে চা খাওয়ালেন। ধীরে ধীরে বললেন তাঁর লাইব্রেরি করার স্বপ্নের কথাসুশ্বেতা গান জানে শুনে গাইতে বললেন। ভাগ্যিস আমি নাচ জানি সেকথা বলিনি। লাইব্রেরি দেখতে ব্যস্ত মিঠুর সাথে। সেদিন দুপুরে মাস্টারমশাইয়ের চাপে তাঁর বাড়িতেই আহার সারতে হলোবাইরে চটি খুলে ঢুকেছিলাম। কী ঠান্ডা ঘরের মেঝে! শেষে প্রণাম করে  রওনা দিলাম আমরা। শীত পড়ব পড়ব, ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আমরা বহেরাগোড়ায় মোটামুটি চক্কর দিলাম মিঠুর সাথে। হাঁটা শুরু করলাম ওড়িষা বর্ডারের দিকে। ক্রমে সুবর্ণরেখার ব্রিজ। এসেছি, গেছি। কখনো এখানে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে  চেয়ে থাকিনি নদীটির অপার সৌন্দর্যের দিকে। দীর্ঘ তাকিয়ে থেকে চারিপাশ বিস্মৃত হলে ফুটে ওঠে সেই সৌন্দর্য। আমার তো ভালো লাগে নদীর চলে যাওয়া দেখতে।  ক’টা যে সিগারেট খেলাম, কী ভাবলাম, সন্ধে হয় হয়, মিঠু বলল - চলুন। ফিরে আসছি, পথে ডান হাতে দেখি একটা গেটলেখা – হাতীবাড়ী অভয়ারণ্য – ভুলভাল লেখা অবশ্য। ঠিক করলাম কাল সকালে আসব।

সন্ধেবেলায় বাংলোর হাতায় চেয়ার টেবিল পেতে আমরা গোল হয়ে বসলাম। হুইস্কি, হালকা খাবার এলো ধাবা থেকে। ধীরাজের একমাত্র গল্প উৎপল দত্তদীপকের গল্প  ইবসেন। দুজনে মুখোমুখি। সুশ্বেতা বড্ড ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় আর প্রণব তখন  সেতার শিখছে। দুজনে মুখোমুখি। দুজনেই মদ খায় না। কমল আমি আর মিঠু এক টেবিলে কবিতা। রাত গড়ায়। একসময় মিঠু উঠে বাড়ি ফিরল। সুশ্বেতা উঠে গিয়ে বিছানা পেতে এলোশুতে ডাকল সবাইকে। দীপক, ধীরাজ, কমল একে একে। আমার  গায়ে শাল দিয়ে গেল প্রণব। আলো নেই কবিতা পড়া বন্ধমদ তখনও। কমল সঙ্গে বউ এনেছে। আমাকে ফেলে গেল। আচ্ছা, ব্যাটা! আমি মন থেকে পড়ছি।  আমার না কমলের না স্বদেশ সেনের নাকি সুভাষ মুখার্জী বা জীবনানন্দ কি যায় আসে? কবিতা কবিতাই হয়। প্রণব বলে গেল – বারীনদা চলে এসো, ঠান্ডা লাগবে। হু কেয়ার্‌স! রাত প্রায় নিশুতি। হাইওয়ে থেকে আওয়াজ কমে আসছেএই সুন্দর  রাতে কবিতার ঘর বলে কিছু হতে পারে না। কবিতা তো পথে, কবিতা আকাশে। প্রণব এসে আমার খাতা কেড়ে আমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেলল। আমি ছটফট করে প্রতিবাদ করছিলাম। সে সরে যেতে আমি রেগে মেগে একাই বেরিয়ে হাইওয়ের দিকে গিয়ে হাঁটতে থাকলাম সোজা। আমার কবিতার ভাষায় বাধা দেয় কোন মূর্খ? মুখ দিয়ে কবিতা বেরোচ্ছে তখন অনবরত ‘সাতটি তারার তিমির’ থেকে --- ‘সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি,/ বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে ;/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা :/ নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;’ --- আমার মনে সেই আগুনের উত্তাপ। ‘আমরা যাইনি মরে আজও – তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় :/ মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;’ --- সত্যিই সেদিন কার্তিক মাস প্রায় শেষের মুখে - মহীনের ঘোড়া নয় ভারতীয় ট্রাকরা খাবি খাচ্ছে পথে প্রান্তরে - অন্ধকার পথে ট্রাকের আলোয় একজন কবিকে দেখা যাচ্ছে বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে যেতে - যারা দেখল কী ভাবল কে জানে, তবে মন শান্ত হয়ে আসাতে পায়ে পায়ে ফিরে এলাম। বাংলোর বারান্দায় তখন ধীরাজ ক্যাসেট চালিয়ে রেখেছে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানেরবিছানায় না গিয়ে আমি সেখানেই থামে হেলান দিয়ে বসে শুনতে থাকলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বারান্দায়সকালে উঠে সবাই আওয়াজ দিতে থাকলে আমি চুপচাপ শুনলাম


এর পর সবাই মিলে হাতির বাড়ি। কথা শুনে মনে হয়, প্রণব আর কমল জঙ্গল নিয়ে কত কিছু জানে! আমি কিছু জানি না বাবা। আমার না জানা বিস্ময়গুলো  অক্ষত থাক। আবারো নদীর ধার। হাতির দেখা নাই রে! এমনকি কোনো পটিচিহ্নও  চোখে পড়ল না। একটা গাছের ছায়ায় বসে সুশ্বেতা গান ধরল – মায়াবন বিহারিনী হরিণী – ফলে হরিণও উধাও হয়ে গেলএরপর যা যা দেখলাম, সেসব হাতিবাড়ি নামের অযোগ্য। ফিরে এলাম বাংলোয়, তারপর জামশেদপুর।

এহেন শূন্যস্থান থেকে এতদিনেও একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ পেলো না, এই প্রাকৃতিক পরিবেশে, জ্যোতির্ময়বাবুর পাঠাগার থাকা সত্বেও, কেন যে! সেখানকার  বাসিন্দা কবি বেবী সাউ চেষ্টা করেছিল অবশ্য, কিন্তু সফল হয়েছে কিনা জানা নেই। আমরা শহর গ্রাম গঞ্জ ঘুরে বেড়াতাম কবিসঙ্গ করার জন্য। এই ভ্রমণের কাল পর্যন্ত কেবল মিঠু ছাড়া আর কো্নো কবির সন্ধান ছিল না আমাদের কাছে। অগত্যা  নিজেরাই গুলজার করে ফিরি।

                                                

৫টি মন্তব্য:

  1. চেনা চেনা লোকজন, চেনা চেনা রামের গেলাস.... ভালো লাগলো.... :-)

    উত্তরমুছুন
  2. মনটা সত্যিই চলে গেছিল সেই তেত্রিশ বছর আগের বহরাগোড়াতে। যখন ছিলনা এতো ট্রাকে ট্রাকে প্রতিযোগীতা। সাইকেল টা নিয়ে কতবার ঐ ঘাটশীলার দিকে চলে গেছি। আরেকটু এগিয়ে নরসিংগড়ের সেই প্রাচীন কালো দূর্গার মূর্তি। সব মনে করিয়ে দিলো দি গ্রেট বারীনদার এই লেখা।

    উত্তরমুছুন
  3. মনটা সত্যিই চলে গেছিল সেই তেত্রিশ বছর আগের বহরাগোড়াতে। যখন ছিলনা এতো ট্রাকে ট্রাকে প্রতিযোগীতা। সাইকেল টা নিয়ে কতবার ঐ ঘাটশীলার দিকে চলে গেছি। আরেকটু এগিয়ে নরসিংগড়ের সেই প্রাচীন কালো দূর্গার মূর্তি। সব মনে করিয়ে দিলো দি গ্রেট বারীনদার এই লেখা।

    উত্তরমুছুন
  4. বহড়াগোড়া এখনও এমনই আছে । কিছুটা সময়ের ছাপ দাগ কেটেছে অবশ্য । তাও ওই জঙ্গলে জ্যোৎস্না রাতে মায়ার খেলা ,এন এইচ সিক্স আর থার্টি থ্রি র মেলবন্ধন ট্রাক ড্রাইভারের উদাসী বিরহী দৃষ্টি, একটা দুটো হঠাৎ নাম না জানা পাখি সব আছে ।আপনার লেখাটা সত্যিই অপূর্ব । বহড়াগোড়া র একটি সম্পূর্ণ চিত্রল রূপ ।

    উত্তরমুছুন
  5. বহড়াগোড়া এখনও এমনই আছে । কিছুটা সময়ের ছাপ দাগ কেটেছে অবশ্য । তাও ওই জঙ্গলে জ্যোৎস্না রাতে মায়ার খেলা ,এন এইচ সিক্স আর থার্টি থ্রি র মেলবন্ধন ট্রাক ড্রাইভারের উদাসী বিরহী দৃষ্টি, একটা দুটো হঠাৎ নাম না জানা পাখি সব আছে ।আপনার লেখাটা সত্যিই অপূর্ব । বহড়াগোড়া র একটি সম্পূর্ণ চিত্রল রূপ ।

    উত্তরমুছুন