ঋত্বিকচরিত
অথবা মিশন মুদ্রারাক্ষস
“...Film is not made, film is built. আমি চিত্রপরিচালক নই, আমি চিত্রস্রষ্টা। চিত্র সৃষ্টি করে একজন - সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন চিত্র সৃষ্টি করে, তাঁরা (নিছক) চিত্রপরিচালক নন”। (ঋত্বিক ঘটক)
তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন ব্যক্তি ঋত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও স্রষ্টা
ঋত্বিক সেভাবে আগ্রহীদের উপযুক্ত মনস্কতা আকর্ষণ করেননি। ঋত্বিককে কেন্দ্র করে
মনস্তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, চিত্রনির্মাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ের উদ্দীপক চর্চা শুরু হয়েছে
একটু ধীরে। কিন্তু অনিবার্য অভিঘাতগুলি দিনে দিনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে মানুষের মনে। একজন প্রকৃত শিল্পী যথাসময়ে মানুষের
মনোজগতের গভীরে পৌঁছে যান, এটাই শিল্পের নিয়ম। সময়ের
মাত্রা শিল্পের সার্থকতার একটা প্রধান শর্ত। ঋত্বিক আবার তা সপ্রমাণ করলেন।
সেকালে বিশাখদত্ত একটি
অঙ্গুরীয় মুদ্রার প্রতীককে কেন্দ্রে রেখে তাঁর চিরায়ত নাটকটির মাধ্যমে আমাদের
নাট্যশাস্ত্রের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিলেন। মুদ্রাই মন্ত্রী না মন্ত্রীর মুদ্রা, রাক্ষস শেষ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে
শিল্পবিচারে মুদ্রার ছাপ থেকেই আমরা শিল্পীকে চেনার প্রয়াস পাই। ঋত্বিক ঘটকও কোনও
ব্যতিক্রম ন'ন। তাঁরও কিছু প্রকট
মুদ্রালক্ষণ রয়েছে। এটা সর্বজানিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে সেদেশের সরকার
আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। উড়োজাহাজে যাবার সময়
তিনি আকাশ থেকে পদ্মানদী দেখে ভাববিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সহযাত্রী
সত্যজিৎ তাঁকে সম্বৃত করেন। কিন্তু সেদেশে পৌঁছে সেখানের তৎকালীন ভূমিগত বাস্তবতা
প্রত্যক্ষ করে তিনি অচিরেই প্রথমে নিরাশ ও পরে মোহমুক্ত হবার প্রয়াস করেন। কিন্তু
কখনও হতে পারেননি। তাঁর তক্ষশীলা ও মগধ পরস্পর ঘেঁটে গিয়েছিল। চিরকালের মতো। তিনি কার মুদ্রা বহন করেন, শেষ পর্যন্ত ঠাহর করে উঠতে পারেননি। আমাদের জন্য সেটাই
প্রাপ্তি। ট্রিলজি’র ছবিগুলি সম্বন্ধে তিনি
মন্তব্য করেছিলেন, “যোগসূত্র এই তিনটার মধ্যে
একই মাত্র। সেটা হচ্ছে দুই বাংলার মিলন। দুইডা বাংলারে আমি মিলাইতে চাইছি। দুইডারে
আমি ভালোবাসি হেইডা কমু গিয়া মিঞা, এবং আমি আজীবন কইয়া যামু, যখন মৃত্যু পর্যন্ত আমি কইয়া যামু। আমি পরোয়াই (করিনা), আমার পয়সার পরোয়াই (নাই)। I can fight that out. ঋত্বিক ঘটক can do
that out here and in Dhaka. আমারে কে মারব লাথি, মারুক গা যাক। বইয়া গ্যাছে
গিয়া”।
এই ছবিগুলি তাঁর কীর্তির
মাইলফলক, তারা কোনও না কোনও ভাবে ছিন্নমূল, মাতৃবিযুক্ত সন্তানের বিষাদবেদনায় ধূসর। যে দেশ তিনি ছেড়ে
এসেছিলেন তাকে কখনই মৃণ্ময় ভেবে সান্ত্বনা পাননি, তা চিরকাল অত্যন্ত প্রকটভাবে তাঁর কাছে চিন্ময় হয়ে থেকে গেছে। তাঁর ‘দেশ’মাতৃকার সঙ্গে তাঁর নাড়ি
সম্ভবত পঞ্চাশ বছর ধরেই কেউ ছিন্ন করতে পারেনি।
তিনি যতদূরে যেতে চেয়েছেন তত বেশি নাড়িতে টান লেগেছে এবং তিনি ব্যথাকাতর হয়ে
পড়েছেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবন, রাজনীতি, উৎকেন্দ্রিকতা, কেউই তাঁকে এই বেদনা থেকে মুক্ত করার উপযুক্ত শুশ্রূষা দিতে
পারেনি।
আবার অন্যদিকও আছে। এই
তিনটি ছবি নিয়ে নিছক আবেগের ঊর্ধে গিয়ে তাঁর বিশ্লেষণটিও প্রণিধানে রাখা প্রয়োজন।
“...‘মেঘে ঢাকা তারা’ was complete my... in my subconcious affair. ‘কোমল গান্ধার’ was a very concious affair. আমার এই মহিলার সঙ্গে বিবাহ
ব্যাপারটা তার সঙ্গে প্রচণ্ড ভাবে জড়িত। আর ‘সুবর্ণরেখা’ is a very serious work. ওখানে খাটতে হয়েছে, হ্যাঁ, মানসিকভাবে.... a work behind. দৈহিকভাবে খাটার ব্যাপার নয়, মানসিকভাবে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে এবং এটাকে আমাকে দাঁড় করাতে
হয়েছে। কদ্দূর দাঁড়িয়েছে সে আমি জানিনা, কিন্তু মিঞা কথা হইত্যাছে, যে খাটছি আমি”। অথচ এ কথাও বারবার বলছেন, “...বাংলার ভাগটাকে আমি কিছুতেই
গ্রহণ করতে পারিনি। আজও পারিনা। আর ঐ তিনটে ছবিতে(মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা) আমি ও-কথাই
বলতে চেয়েছি। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেলো একটা trilogy”।
এই মুদ্রাদোষটি থেকে তিনি
সচেতন বা অবচেতনে কখনও রেহাই পেতে চাননি। তাই আমৃত্যু সেটি তাঁর হৃদয়লগ্ন হয়ে থেকে
গিয়েছিল। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে একে ‘সীমাবদ্ধতা’র চিহ্ন হিসেবে গণ্য করা
যায়। যদিও ঋত্বিক আজীবন দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে
সৃজনশীলতার ক্যাথার্সিস খুঁজেছেন। সেটি সত্যজিৎও স্বীকার করেছিলেন।
“...Film is not made, film is built.” ঋত্বিক এই উক্তিটি ধার করেছিলেন আইজেনস্টাইনের থেকে। তিনি যে সত্যজিতের মতো হলিউডি মডেলে
বিশ্বাস করেন না এবং তাঁর রচনার সঙ্গে রুশ ক্ল্যাসিক ছবিগুলি মেলে তা স্বয়ং সত্যজিৎই বলে গেছেন, তাই তা জজেও মানে। তাঁর ছবি করার উৎস এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে
ঋত্বিক বলেছিলেন, “...আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর ‘ক’ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি -এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে
পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হতো। এই আইজেনস্টাইন... সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that, he is
the father of us.” এর পরে তিনি নাম নিয়েছিলেন
পুডোভকিন, কোজিনেৎসভ বা তারকোভস্কির। কিন্তু তা সত্ত্বেও
তাঁর ভিতরের অ্যানার্কিস্ট মুগ্ধ হয়েছিল আরেকজনের প্রভাবে। অবাক হবার মতো কিছু নেই
যদি তাঁর কাছে বুনুয়েল শ্রেষ্ঠতার শিরোপা
দখল করে নেন। যে স্ফুর্তির সঙ্গে তিনি বুনুয়েলের শিল্পকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর থেকে এর জুড়ি আমরা আর পাইনি।
“আমার মতে বর্তমান
চিত্র-পরিচালকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন লুইস বুনুয়েল। তাঁর চার-পাঁচটি ছবি আমি দেখেছি। ছবিগুলি আমাকে একেবারে পাগল করে
দিয়েছে। বুনুয়েল-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং তার মধ্যে দিয়ে আমাদের
একটা ছন্দে পৌঁছে দেওয়া। তিনি আমাদের মতো সাধারণ পরিচালকদের ভঙ্গিতে গুছিয়ে শট তোলেন
না বা গুছিয়ে গল্প সাজান না। মনে হবে যেন তিনি পরম অবহেলায় ছবি তুলেছেন অথচ প্রায়শ
এক-একটি মারাত্মক মুহূর্তে তিনি আমাদের নিয়ে যান যা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয়। ...ওঁর থেকে বড় ছবির শিল্পী আমার মতে কেউ নেই বর্তমানে”।
স্ববিরোধের অন্য নাম
ঋত্বিক। হয়তো সেটা বিরোধিতাই নয়। দ্বান্দ্বিকতা ও ভারতীয় ঐতিহ্যমুখী ব্যক্তিমানসের
বিবর্তনে ইতিহাস, ঐতিহ্য বা মিথস্ক্রিয়ার
ভূমিকা, ব্যক্তি তথা সমষ্টির সৃজনশীলতার প্রক্রিয়ায় তার
প্রতিফলন এবং এ প্রসঙ্গে ইয়ুং সাহেবের তত্ত্ব অনায়াসে মিলেমিশে গেছে। তিনি
নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন, “...ইয়ুং-এর সঙ্গে মার্ক্স-এর কোনো বিরোধ নেই, দু'জনে দুই জগৎ নিয়ে কারবার
করেছেন। দুটো প্রচণ্ডভাবে পরিপূরক। আমার
ছবিতে ইয়ুং-এর যে-ব্যাপারটা প্রচণ্ডভাবে আসে, সেটা হলো ঐ mother complex. আমাকে আমার এক বন্ধু বলেছিল, তোকে মায়ে খেয়েছে। আমার সব ছবিতে ঐ মা এসে পড়ে - তা মায়ে খেয়েছে কেন? এই ‘যুক্তি তক্কো গপ্প’ ছবির entire ছৌ নাচটার raison d'etre হচ্ছে মা - mother
complex. এখানে ঐ মেয়েটাকে, শাঁওলিকে তার সঙ্গে equate করো, জ্ঞানেশ বলছে নাচো, তোমরা নাচো, তোমরা না নাচলে কিছু হবে না। এটা সম্পূর্ণ Jungian, ‘তিতাস’-এ ছেলেটা স্বপ্ন দেখে মা-কে
ভগবতী রূপে, এই mother complex একটা basic point.” উত্তর আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত
ও ভারতীয় শিল্পবোধের নিরিখে এই উক্তির ব্যাখ্যা আজকের গুণগ্রাহীর বিচারে অনেক
সহজবোধ্য হয়ে গেছে। তিনি বহুবার ওয়াজেদ
আলি সাহেবের ‘ট্র্যাডিশন’ বিষয়ক অতি পরিচিত পরিভাষাটি
উল্লেখ করেছেন তাঁর আলাপচারিতায়। বছর পঞ্চাশেক আগে যা নিশ্চিতভাবেই স্ববিরোধের
সূচক ছিল, কিন্তু আজ স্বপ্রতিষ্ঠ।
আইজেনস্টাইন বা বুনুয়েল, অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি যাকেই গ্রহণ করুন না কেন, ‘আবেগপ্রবণতা’র ‘পিছুটান’ তাঁকে সতত আচ্ছন্ন করে রাখতো। বস্তুত তাঁর রচনার
বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রধান অভিযোগ, সেটাও তো তাই। আবেগের বশে মেলোড্রামার আধিক্য। এ প্রসঙ্গে
তিনি নিজে কী বলেন একবার দেখে নেওয়া যাক।
“...আসলে ছবি করার সময় অন্য কোনো শক্তি ঢোকে। তার প্রথমে
থাকে আবেগ, আবেগই চালিত করে। সমস্ত ব্যাপারটা আবেগ থেকে আসে। যার আছে, তার আছে, যার নেই, তার নেই। এ হলো ভেতর থেকে উৎসারিত। যে কোনো শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ কথা খাটে। লোকে গ্রহণ করুক অথবা না করুক। যে-দিন থেকে
দর্শকরা screen ছিঁড়ে দিল, সেদিন থেকে চুল পাকতে শুরু হলো”।
অতএব ঋত্বিক সচেতনভাবেই
আবেগকে চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। আমরা যারা সিনেমার মূল্যায়ণে
য়ুরোপীয় নন্দনতত্ত্বের ধ্যানধারণার প্রতি অধিক বিশ্বস্ত, তাদের মন্ত্র, আবেগ ভৃত্য হিসেবে উত্তম
হলেও প্রভু হিসেবে তার ভূমিকা নৈব নৈব চ। আবেগের বন্ধহীন প্রকাশ মানে মেলোড্রামার ‘স্থূলতা’। পরিভাষা হিসেবে ‘মেলোড্রামা’ শব্দটির মূল উনিশ শতকের ফরাসি গীতিনাট্য, মূলত অপেরার পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত।
যেহেতু প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা ছায়াছবি দুইই আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, তাই এই শব্দটিকে আমরা ‘অতি’ নাটকের আখ্যা দিতে ব্যবহার
করি। এই ‘অতি’ নাটকের উপাদান কী কী হতে
পারে?
১. সমাপতনের ঘনঘটার প্রতি
অধিক নির্ভরতা।
২. যে কোনো মানুষী সংবেদ প্রকাশ করার
সময় মন্দ্রসপ্তকের প্রতি ভরসা না রেখে তারসপ্তকের প্রতি অধিক
বিশ্বস্ত হয়ে পড়া।
৩. নীতিকথা প্রতিষ্ঠা করার
অদম্য উৎসাহে পরিবেশনার সূক্ষ্মতর দিকগুলির প্রতি উদাসীন থাকা।
এই লক্ষণগুলি পরিহার করার
প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা আমরা পশ্চিম থেকে শিখেছি। যেহেতু সিনেমা
একটি সম্পূর্ণ পশ্চিমী মাধ্যম, তাই দীর্ঘদিন আমরা বিশ্বাস
করেছি যে পশ্চিমের তৈরি করা (বিশেষত হলিউডের) ‘ভালো সিনেমা’র মডেলটিই আমাদের অনুসরন
করা উচিৎ। ঋত্বিক এই মডেলটির প্রামাণ্যতা অনেকাংশেই স্বীকার করেননি, তাই মারি সিটনকে তিনি
প্রভাবিত করতে পারেন না।
একটা কথা ঋত্বিক বারবার
বলতেন। “Content প্রথমে আসে। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে গিয়েছিলেন
যে আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তার পর সৌন্দর্যনিষ্ঠ।
কথাগুলোর মানে আপনারা ভালোভাবে বুঝে দেখবেন। Form-টা কিছু না, ওটা আকার মাত্র”। এই শর্তটির অনুপালন সবচেয়ে অধিক নিষ্ঠায় করা হয় এপিক
শিল্পে। ‘এপিক’ শব্দটি ঋত্বিকের লেখায় বহুবার এসেছে। আমাদের দেশে যাবতীয় সৃজনশীল
সৃষ্টির মূল উৎস দুটি। রামায়ণ ও মহাভারত। ‘মেলোড্রামা’ নামক শব্দটি সৃষ্টি হবার বহু হাজার বছর আগেই আমাদের শিল্প ও নন্দনশাস্ত্রে এই তথাকথিত মেলোড্রামার
লক্ষণগুলি খুবই প্রকট। যে কোনও ‘এপিক’ শিল্পে আমরা এই ‘অতি’বাদের প্রতি নির্ভরতা অতি প্রকটভাবে পাই। এই ‘অতি’বাদের লক্ষণগুলি উপরে
লিখেছি। সত্যনিষ্ঠাকে সবার উপরে স্থান দিতে গেলে যাবতীয়
শিল্পনির্মাণের ভিত্তি হবে নৈতিকতার দৃঢ় মাটি। শিল্পকে ‘লোকশিক্ষে’র প্রধান বাহন করতেই এপিকের
প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই য়ুরোপে
গ্রিকযুগ থেকে রনেশাঁস যুগের শেষ পর্যন্ত এবং আমাদের দেশে পুরাণযুগ থেকে ইংরেজ আসা
পর্যন্ত, যে কোনও শিল্প সৃষ্টির অন্তসলিল উদ্দেশ্য ছিল, রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায় ‘লোকশিক্ষে’। শুধু ‘শিল্প’ সৃষ্টির জন্যেই শিল্প সৃষ্টি এই ধারণাটিকে আমাদের দেশে কখনও মূলস্রোতে আসতে দেওয়া
হয়নি। Art for art's sake আমাদের দেশে চিরকালই অজানা
ব্যাপার। যে কোনও শিল্পপ্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য থেকেছে বৃহত্তর মানবসমাজের কাছে কোনও
কল্যাণকর বার্তা পৌঁছে দেওয়া। এ জন্যই আমাদের দেশে ব্যক্তির জীবনে সমষ্টির ভূমিকা
এতো প্রকট। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ নামক ধারণাটি আমাদের কাছে স্বার্থপর অসামাজিকতার নামান্তর
ছিল। ঋত্বিকের
পূর্ববঙ্গীয় শিকড় ও বামপন্থার জল তাঁকে এপিক ভারতীয়ত্ব, অর্থাৎ ব্যক্তিমানসের রূপায়ণে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মিথস্ক্রিয়ার অমোঘ ভূমিকার প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত
রেখেছে। ভারতশিল্পের মূল্যায়ণ, ফ্রয়েড সাহেবের
সরলরৈখিক, ব্যক্তিভিত্তিক, একমুখী বিশ্লেষণ থেকে করা সমীচীন নয়। তাই ইয়ুংসাহেবের
ব্যাখ্যা আমাদের এপিক মূল্যবোধের অনেক কাছাকাছি এবং ঋত্বিকের কাজে আমরা এর পরিচয়
পাই। শুধু চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রেই নয়, যাবতীয় অন্যতর ট্রিটমেন্টের
ক্ষেত্রেও ঋত্বিক হয়তো য়ুরোপীয় ও মার্কিন মানদন্ডে অতিরিক্ত উচ্চকিত ছিলেন। যদিও
সত্যজিৎ এই সব মানদন্ডের প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন। ‘অপুর সংসার’ শেষ করার সময় তিনি বিভূতিভূষণের ‘ভারতীয় পাঁচালি’র মতে সমে ফিরে আসার
প্রক্রিয়াটিকে গ্রহণ করেননি। তাকে য়ুরোপীয়
যুক্তিপরম্পরায় সরলরেখায় অগ্রসর পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে ঋত্বিক তো আপত্তি
করবেনই।
আইজেনস্টাইনের শিষ্য হিসেবে
ঋত্বিক alienation from the narratives-এ আস্থা রাখেন। তাঁর
নীতিবোধ, যা কেতাবি শিল্পবোধের থেকে অনেক প্রখর, সেখানে তিনি আপোসে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে, “আমি শিল্পী হিসেবে involvement'এ বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস
করি যে চারপাশের মানুষের জীবনের সাথে নাড়ির যোগ রেখে ছবি করতে হয়। তা না-হলে ছবি
করার কোন মানে হয় না... তাই আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিল্পীর কর্তব্য
এবং প্রয়োজন এই involvement। সেই সাথে audienceকে alienate
করব। ...আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো it is not an imaginary
story, বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাবো যে যা দেখছেন তা
একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা
বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesis-টা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর
জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মুহূর্তে”।
যখন শিল্পী বলছেন যে তিনি
দর্শককে ‘ধাক্কা’ দিতে চাইছেন বা hammer করতে চাইছেন, তার মানে তিনি তাদের আখ্যানের আরামদায়ী গৃহকোণ থেকে বার করে
রোদজলবৃষ্টিঝড়ের নিষ্ঠুর নিসর্গের মধ্যে ফেলে দিতে চাইছেন। তিনি এটা বোঝাতে চাইছেন
এই বিপর্যয় বা বিড়ম্বনা একটি গল্পের চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ। তুমি হল থেকে
বেরিয়ে গিয়ে নিজেকে এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত করতে পারো না। আমাদের দেশের যে
নীতিশাস্ত্র, সেখানে এই তাড়নাটিকে শাশ্বত
স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এমন কি এক জীবনে এই পাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে ‘পরজন্মে’ তোমাকে এটা বহন করে বেড়াতে হবে। অঙ্ক মেলাবার
জন্য ‘পরজন্ম’ বা ‘জন্মান্তর’ নামক এক্স ফ্যাক্টরকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি
দেওয়া হয়েছে। এই পাপ আসলে কী? একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে তুমি যখন এক জন্মে তোমার প্রতি
সমাজ-সংসারের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছো না, তখন তোমাকে আরও জন্ম নিতে হবে এই প্রত্যাশা পূরণের জন্য।
বুদ্ধজাতকের গল্পের কথা ভাবুন, পরে যেটাকে সনাতন ধর্মেও
স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে গীতা, ভাগবতে। সেখানে আমরা দেখি
সমাপতনের কী চূড়ান্ত ঘনঘটা। কেউ যদি অন্যায় ভাবে একটি মৃগবধ করে তবে ‘পরজন্মে’ তাকে মৃগ হয়ে জন্মগ্রহণ করে নিহত হতে হবে। এই
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে বা সেই বিমল মিত্রের উপমায় ‘যমুনাকি তীর’ বার বার ফিরে ফিরে আসবে এটাই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রের ঐতিহ্য। ভারতীয় নন্দনশাস্ত্র তৈরিই
হয়েছিল এই নীতিশাস্ত্রকে ‘ধাক্কা’ মেরে বা hammer করে মানুষের মনে স্থাপন করার জন্য। এই ধাক্কা
মেরে ইম্প্যাক্ট তৈরি করাই তো ‘মেলোড্রামা’র উদ্দেশ্য, যা আমরা বারম্বার বিভিন্ন
এপিকের মধ্যে পাই। ঋত্বিক তো সেই কাজই করেছেন। ব্যক্তির ক্ষয়রোগ ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ
থাকছে না, তা সমগ্র সমাজের ক্ষয়রোগের অংশ। দর্শকও তার থেকে
অব্যাহতি পাবে না। নীতিশাস্ত্র তো এই কথাই বলে। এই রোগের জীবাণু দ্যাবাপৃথিবীতে
একভাবে প্রভাবী হয়ে রয়েছে।
তাঁর সঙ্গে ছবি করার ক্র্যাফট
বা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি বলেন, “পদ্ধতি-টদ্ধতি বুঝি না মশাই, আমার কাছে আজও প্রমথেশ বড়ুয়া ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক”। এই উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণ করতে তিনি অবশ্যই অনেক উদাহরণ
দেবেন। এই জায়গাটিতেই ঋত্বিক তাঁর সমকালীন আরেক প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিত ‘রাজনীতি সচেতন’ স্রষ্টার থেকে আলাদা হয়ে যান। মৃণাল সেন কখনও
এভাবে তাঁর মুগ্ধতা জানানোর প্রয়াস
করবেন না।
শিল্প ও রাজনীতির, পড়ুন সমাজতন্ত্রের, পারস্পরিক টানাপড়েন বিষয়ে
তাঁর মতামত চিরকালই পি সি জোশির লাইন মেনে চলেছে। তাই নির্দ্বিধায় তিনি বলে ফেলেন, “রাজনীতি সম্পর্কিত হওয়া মানে, শিল্পী-টিল্পি নয়, যে-কোনো মানুষকে এই সমাজে, এই শ্রেণীসমাজে, রাজনীতি সম্বন্ধে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে হয়। এটা শিল্পী শুধু
নয়, সব্বায়েরই হওয়া উচিত। তবে তাই বলে slogan mongering শিল্পীর কাজ নয়। এই cheap slogan দিয়ে শিল্পী হয় না, শিল্পীকে কাজ করতে হয় মানুষের গভীরে। রাজনীতিকরা কাজ করে
ওপরতলায় - মানে চেঁচামেচি, হট্টগোল, cheap slogan, একটা short slogan, এই সব। শিল্পী এইগুলো করলে, আমি মনে করি, সেটা শিল্প আর থাকে না”।
ইশকুলের পড়ার বইয়ে আমাদের
শেখানো হয়, মানুষ সামাজিক প্রাণী। এই ‘সমাজ’টা যে প্রকৃতপক্ষে কী, সে বিষয়ে কিন্তু বিশদ কিছু ব্যাখ্যা
সে পর্যায়ে অধরাই থেকে যায়। এই তোতাপর্বের সীমানা পেরোলেই মানুষ অনুভব করতে শুরু
করে তার রাজনৈতিক অস্তির নিয়ত রক্তক্ষরণের বেদনা। একজন বিবেকী মানুষ কোনোভাবেই তখন ‘আমি পলিটিকস করি না’ গোছের শান্তিকল্যাণে আশ্রয় নিতে পারে না। সাধারণ মানুষই যা পারে না, শিল্পী কী করে পারবে? তার অনুভূতি, সংবেদনা, বিস্ময়বোধ অনেক বেশি প্রখর।
স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান না থাকলে সে অসহায়। এমনিতেই সে
সৃষ্টিশীলতার দোলাচলে পর্যুদস্ত, তার উপর যদি বাস্তব মাটির
খুঁটিটাও নড়বড়ে হয়ে যায়, তবে তো সূর্যাস্তের অপেক্ষা
করা ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই। সঠিকভাবে পারিপার্শ্বিক ও সমাজ-সংসারের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
করতে পারলেই শিল্পী তার টার্গেট
গ্রাহক সঙ্ঘটিকে খুঁজে নিতে পারে। ঋত্বিকের সৃজনশীলতার শিকড় তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক
পরিস্থিতির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে ছিল। এই সময়ের ধর্ম ও তাঁর শিল্পের চরিত্রকে ব্যাখ্যা
করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “এখন আমরা কীসের মধ্যে দিয়ে pass করছি? Neo-colonialism,
absolutely neo-colonialism. এটা আমি ছবিতে বলিনি। এ কথাগুলো বলতে গেলে আমার ছবি রাজনীতি
হয়ে দাঁড়াত, ছবি হতো না। আমি in human terms
ব্যাপারটা ছবিতে বলার চেষ্টা করেছি”। ‘তিতাস’ করার সময় তাই তাঁর কাছে
অদ্বৈত মল্লবর্মণকে অধিক গ্রহণীয় মনে হয়েছিলো । যদিও প্রথম থেকেই তাঁর মনে মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার ভিত্তিতে ছবি করার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রখরভাবে। কিন্তু মানিক'কে তাঁর খুব ‘তীক্ষ্ণ’ মনে হতো। সেলুলয়েডে ধরার
পক্ষে বড্ডো জটিল।
শিল্পীদের সময়ের প্রহরী বলা হয়। তাঁরা ভবিষ্যত সময়ের রূপরেখা বহু আগেই অনুভব করতে
পারেন। শিল্পীর ইনসটিংক্ট তাঁকে নিজের সময়ের আগে এগিয়ে দেয়। ঋত্বিকের অনুভবে বেশ
কয়েক দশক আগেই তাঁর স্বদেশভূমির রাজনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের চমকে দেয়।
অবহেলিত, বহুনিন্দিত এই ধীমান মাতাল এবং ‘পাগল’ যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন, যেন ডেলফির দৈববাণীর মতো তা আজ আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“...এখন আমার নিজের ধারণা দুটো রাস্তা পরিষ্কার - হয় straight Fascism, আর নইলে Leninist
পথে কোনো কিছু। তোমরা যদি ১৯২৯ থেকে
‘৩৩ সালের জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখো তো দেখবে
যে, এই যে এখানে ১৫-১৬ বছর থেকে ২০-২৫ বছরের ছেলেরা
বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছে, এটা যেন তারই প্রতিরূপ।
এরাই SS, এরাই Gestapo এই lumpen-দের থেকেই তৈরি হচ্ছে
ভীষণভাবে। গোটা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে চুরমার হয়ে - দুটো পথ খোলা - হয় Leninist পদ্ধতিতে নিয়ে যাবার একটা ব্যাপার আছে, নইলে clean
Fascism হবে। এবং আমার ধারণা within 3, 4 or 5 years এটা হবে - হয় এদিকে, নয় ও-দিকে। এ চলতে পারে না। ছবিতে এ বলার অবকাশ নেই, কেননা আমি জানি এ দেশে leadership
বলে কোনো পদার্থ নেই”।
শেষ দৃশ্যে ক্যামেরা আর কীই বা করতে পারে...? প্যান করে পৃথিবী থেকে আকাশের দিকে চলে যায়। জানা নেই, সেখানেও কোনও দাঁড়াবার
জায়গা বাকি আছে কি না!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন