ইট-পাটকেল
ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। এটাই নিয়ম নাকি। কিন্তু
আমি ইট মারলাম না, তবুও আমাকে পাটকেল খেতে হলো। পাটকেল বৃষ্টির মতো ঝরে
পড়তে লাগল আমার ওপর। তখন কী করণীয় আমার? ঢাল
তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো
নিরস্ত্র আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে শুধু রক্তাক্ত হওয়া ছাড়া
আর কিছু হবে না। তাই সেখান থেকে মানে মানে সরে পড়াই উচিত।
সাময়িক এই যে পিছু হাঁটলাম, তার মানে কি আমি
পালালাম? আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কে কী ভাবল, তা নিয়ে আমার
মাথাব্যথা করলে চলে না। আমি ততক্ষণে আমার নিরাপদ স্থানে আমার কর্তব্য করছি। আমার
কর্তব্য কী? অবশ্যই নিত্যকার কাজকর্মের পাশাপাশি সংসার সামলানো এবং আমার কিছু
লেখালেখি, কিছু পড়াশোনা... এই তো! কিন্তু যারা ভাবল আমি পালিয়ে গেছি, মরে গেছি,
তাদের কি এভাবেই ভাবতে দেব? তারা ইতিমধ্যে আরও অনেক খিল্লি লিখে ফেলেছে। অনেক মজা
নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার লিখছে না, বলছে না, শুধু দেখছে আর মজা পাচ্ছে। তা আমি যদি ওই
করুণার পাত্রদের একটু মজা দিতে পারি এই জীবনে, এর চেয়ে মহৎ কর্ম বুঝি আর করিনি কোনোদিন।
মহত্বের প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন আগাম বলে রাখি, আমি
ঠিক অতটাও মহৎ নই, যতটা আমার আগের কথাগুলো পড়ে কেউ ভাববে। আমি দুঃখ পাই, রেগে যাই
অল্পতেই, রেগে গিয়ে ভাবনা চিন্তা না করেই যাকে যা খুশি বলে দিই। এতে যে অন্যকে
দুঃখ দেওয়া যেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় থাকে না তখন। পরে খুব খারাপ লাগে,
অনুশোচনায় মরে যাই ভেতরে ভেতরে। একটা ‘সরি’ বলে
দিলেই যে সেই মানুষটির দুঃখ কমে যাবে, তা তো না! ক্রোধ আমার শত্রু যেমন, আবার আমার
মিত্রও বটে। যেমন অনেক সময়ে রাগের বশে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি
যে পরবর্তীকালে সেটা আমার জন্য ভালোর হয়েছে। আর দুঃখকে অতিক্রম করতে আমি ততটাও
পারিনি, যতটা পারলে আমাকে মহৎ বলা যেত।
তাই আমার করুণা যখন ওই ঈর্ষান্বিত মানুষদের
নীচতাকে কিছুটা হলেও ধুয়ে দেয়, তখন তাদের শুদ্ধতার দিকে হাঁটতে দেখি। এই অলীক
আনন্দে মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আমার দুঃখ, হতাশা, রাগ কমে আসতে আসতে আমার হাতের মুঠোর
মধ্যে চলে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের দেখি, আর নিজেকে আবিষ্কার করি। এই
নিজেকে আবিষ্কার প্রক্রিয়াটি আবার কয়েক ধাপে চলতে থাকে। প্রথমেই খেয়াল করি, যে
আমাকে অযথাই পাটকেল
ছুঁড়েছিল, তার ওপর আমার ক্ষোভ ক্রমশ কমে এসেছে। আর যে দুঃখটা পেয়েছিলাম, সেটা যেন টলটল করতে করতে
পদ্মপাতা থেকে গড়িয়ে জলে মিশে যাচ্ছে। একটা হালকা ভাব আসছে, যাকে শূন্যতা বলা যায়
না কিছুতেই। আর সেই যে অলীক আনন্দ পেয়েছিলাম করুণা করে, তার অলীকত্ব উধাও হয়ে গিয়ে
আনন্দ এগিয়ে আসছে অন্য রূপ ধরে।
পরের ধাপে হালকা ভাব কেটে যায়। নিজের ভর ফিরে এলে
বুঝি, এসবই মানুষ জীবনের প্রাপ্তি। যা থেকে আমি নিজেকে পরিণত করে তুলছি একটু একটু
করে। আমার ভেতরের না-মানুষটা হালকা হচ্ছে। ধৈর্যহারা যে অস্থিরতা আমাকে ছুটিয়ে
মারত, ক্ষেপিয়ে তুলত, সেগুলো স্থির হয়ে আসছে। আমি তখন মনে মনে সেই পাটকেলধারীর
কাছে কৃতজ্ঞ হতে শুরু করেছি। ভাগ্যিস তুমি ওই পাটকেলটি ছুঁড়েছিলে অনর্থক, তাই তো
আমি ধীর হচ্ছি! আমার মন থেকে একটা
কুয়াশার আস্তরণ কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটা আলোর রেখা আমি দেখতে
পাচ্ছি যেন! সে আলো এখনও খুব
স্পষ্ট নয়, কাছেও নয়। তবে তার আভা এসে পড়ছে চোখে। আমি এতদিন অন্ধকারে কিছু একটা
হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আর পাচ্ছিলাম না। কী
খুঁজছিলাম নিজের কাছে, সেটা
খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। আজ বুঝতে পারছি, আমি নিজেকেই খুঁজছিলাম এতদিন। কবে কোথায় আর কীভাবে হারিয়ে
গেছিলাম আমি, সেসব আর জানতে চাই না এখন।
এখন একটা স্থিতির কাছে জড়ো করছি নিজেকে। আমার সবগুলো
টুকরো যেদিন এসে যাবে এক জায়গায়, সেদিন আমি আলোটা স্পষ্ট দেখতে পাব। এই বোধ এসে
গেছে যখন আর চিন্তা কী! নিজেকেই নিজে পিঠ চাপড়াতে গিয়ে দেখি সেই যে পাটকেলধারী
দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ, আর পাত্তা না পেয়ে টার্গেট বদলে ফেলেছে। আমি শিকার হয়েছিলাম
স্বীকার করতে বাধা নেই যেমন, তেমন এটাও মেনে নিতে হবে আমাকে, যে ওই শিকার হওয়ার
সম্ভাবনা আমি নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলাম। এই জায়গাটায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে আরও।
নিজের পিঠ চাপড়ানির বদলে নিজের জন্য সচেতনতা আজ খুব জরুরী। সেই আলখেপলা কবি হওয়ার
দিন শেষ আজ। ইট-পাটকেলের মধ্যে না গিয়ে নিজের কোমরের জোর বাড়াতে হবে। নিজের কব্জির
জোর থাকলে অবশ্য কোমর এবং পা -
দুইয়েরই জোর বেড়ে যায়। তবে অবশ্যই এই কব্জির জোর যেন কারো গায়ে গতরে গিয়ে না পড়ে,
সেটা দেখা এবং খেয়াল রাখার দায়িত্বও আমার।
আলোর কথা মাথায় রাখলাম যেমন, অন্ধকারকেও ভুলিনি
তেমন। অন্ধকার ছিল বলেই আলোর সম্ভাবনা ফিরে আসছে। আমি এই সম্ভাবনাকে জল দিচ্ছি,
সার দিচ্ছি। আর অপেক্ষা করে আছি সেই দিনটির, যেদিন এক আলোময় দিন ও তার আভা ছড়ানো
রাত আমার সামনে এসে দাঁড়াবে দু’হাত
বাড়িয়ে। কোনো আলোর বৃত্তের মধ্যে
আমি দাঁড়াতে চাই না। আলো মাখতে চাই, বুকের ভেতরে আলো নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাই
শান্তিতে। জানি মনে মনে, আলোর আশায় অনেকেই থাকে আমার মতো। এই আশা আর অপেক্ষা আছে
বলেই না এখনও আমরা বাঁচি! এই আশার
মধ্যে, এই অপেক্ষার মধ্যে কোনো ইট-পাটকেলের স্থান নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন