মেয়েখেলা
(পর্ব - ২)
একদা স্নান করে টাই চিবিয়ে
স্কুলের পথে পাড়ি দেওয়া মেয়েটি বড় হয়ে গেল। কালো মেয়েটিকে এখন শাড়িতে দেখে সব্বাই। বর্ণের কারণে যার পথে হাজার
প্রতিবন্ধকতা্র ভিড়, তাকে সে ঠেলে ফেলে এগিয়ে
যেতে লাগলো প্রকৃতির নিয়মে। লক্ষ্য জ্ঞানার্জন নয়। পড়াশোনা করে একটি চাকরি আর বিনা পণে ভালো বিয়ে করে
বাবা-মাকে মুক্তি দেওয়া। প্রথমত মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করা। দশম শ্রেণীতেই শাড়ির এক আশ্চর্য বিধান চালু ছিল বিদ্যালয়ে। বালিকা বিদ্যালয়গুলি ইংরেজ সাহেব, খ্রীষ্টান মিশনারি ও সাহসী
বাঙালির আধুনিক মানসিকতার কারণে তৈরি হয়ে গেলেও মহিলারা তাকে সাবালক করে
তুলতে নেয় দীর্ঘ সময়। দশমে শাড়ি, কিন্তু শরীরশিক্ষা নামক ক্লাসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই
দু’দিন পিটি বা আসন জাতীয় জিনিস অভ্যাস করতে হতো। আলাদা করে সালোয়ার পড়ার নিয়ম তখনও চালু হয়নি। অগত্যা প্রতি মাসে একবার করে সবাইকেই সাইড লাইনে দাঁড়াতে হতো অপরাধীর মতো। সবাই জেনে যেত, আজ অমুক মেয়ে আসন করতে পারবে না। এই বিষয়ক শিক্ষকদের আবার ভয়ানক মেজাজ খারাপ থাকত। ব্যঙ্গ করে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন মুখের দিকে চেয়ে বলতেন, ‘আজ তোর হয়েছে’? মন ফুঁসে উঠত, ফিসফিসিয়ে বলত, এরা জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হবার বদলে ভাগ্যচক্রে এই বিষয়ের
শিক্ষক কি করে হয়েছে? পুরো কাঠ। যদি কোনো ক্লাসে ফিজিক্যাল ম্যাডাম ঠিকঠাক পেতাম তো বাকীটা
পুষিয়ে দিত সেলাই ম্যাডাম। উনি আমার মধ্যে এই বিশ্বাসের জন্ম দেন যে, মেয়ে সেলাই না জানলে সে মূর্খই থেকে যায়। একবার উনি হরিণ কালারের সেটিং সুতো দিয়ে টেবিল ক্লথ করাবেন জানালেন। বাড়ি এসে মা’কে জানালাম। বাবা তো অফিস থেকে ফিরে
শোনামাত্র মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। একজন স্কুল ইনস্পেক্টর হয়েও বললেন, ‘হরিণ খুঁজে পাওয়া তো এর
চেয়ে সহজ! কি বেকার কাজ রে বাবা! টেবিল ক্লথ দিয়ে কি হবে?’ ছুঁচে সুতো দিতে গিয়ে
একগাদা থুতু সুতোর আগায় মাখিয়ে যখন কিছু সেলাই
দেখাতে নিয়ে যেতাম, তখন ম্যাডাম তো সেই জিনিসটি ছুঁতেই অস্বীকার করতেন। যাক হেম, বখে্যা, রান নামক তিনটি ষ্টিচ আমায়
গায়ত্রী ম্যাডাম শিখিয়েছিলেন। ঊষা ম্যাডামকে দেখে জেনেছিলাম, মেয়েদের বিবাহ কি জটিল আর সেটা দেরিতে হলে সেটাও কী অস্বাভাবিক! ম্যাডাম যখন সিঁদুর লাগিয়ে
বেশ কিছুদিন ছুটির পর এলেন, তখন নিচে জল খেতে গিয়ে শুনলাম
বড়দি বলছেন, দেরিতে হলেও ওকে বিয়ের পর দারুন
দেখাচ্ছে। দিদির সঙ্গে থাকা আরেকজন, যাকে পর্দার আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে না তিনি
উত্তর করলেন, হ্যাঁ, বিয়ের জল পড়লে সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে বিয়ের
জল নিয়ে বিশ্বাস নির্মাণ হতে থাকে যে, এ এক দেবতা নিদির্ষ্ট জল
তিনি চাইলে দেন নইলে নিজের কাছেই রেখে দেন।
তখন সপ্তম শ্রেণী। মামার বাড়িতে ছুটিতে সবাই গেছি। দাদুর বাড়ি যাওয়ার পারমিশন পেতাম না
আমরা, কেননা বাবা এক দরিদ্র স্কুল মাষ্টারের এগারো সন্তানের একজন। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ক্যাপিটাল বলতে মেধা। বিশ্বাস ওই কাস্তে হাতুড়ি। অন্যদিকে মা আবার জমিদারদের
প্রতিভূ, হাতের রক্ষক। মানে পঞ্চায়েত কংগ্রেস প্রধানের চার কন্যার একজন। তাই পাল্লা মায়ের ভারি। খাবার-দাবার যেমন ভালো জুটত তেমনি ছিল বিরাট লিচুর
বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর এক বাঁধনহীন টান। অন্যদিকে দাদুর বাড়িতে খাবার ছিল সাধারণ। ভ্যারাইটি আনার প্রশ্ন ছিল না। তাই আমাদেরও লক্ষ্য ছিল
মামাবাড়ি। বাবা মিন মিন করে বলতেন, ‘তবে আমি ওখান থেকে আমার বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে একবার
দেখা করে আসব,’ তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘তোমরা যাবে কেউ’? আমরা মায়ের দিকে তাকিযে না বলার অভ্যাসে রপ্ত ছিলাম, তাই কি হবে জেনে মাথা নিচু করেই থাকতাম। দারিদ্র্যের চাপে নিজের
মেরুদণ্ডটিকেও বন্ধক রেখেছিলেন বাবা বিবাহের পরে শ্বশুরবাড়িতে।
সম্পত্তি হারানোর সঙ্গে
সঙ্গে জমিদার মামার বাড়িতে নৈতিক অধঃপতনও এক রেখা ধরেই চলে। বাড়িতে কোনো শাসন ছিল না। বড়মামা রাজনীতি করতেন। নেশার অভ্যাসও ছিল। তার বাইরে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার তেমন দায় ছিল
না। আসলে শিক্ষায় তাদের তেমন বিশ্বাসও ছিল না। ক্ষমতা আর অর্থই ছিল
জীবনধারনের হাতিয়ার। আমার মামার মেয়েদের আমি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে কাজ করতে
দেখতাম।
একদিন দুপুরে খাওয়া শেষে
বসে বাড়িতে আরও অতিথি। মহিলাদের আসর বসেছে। শুরুধলো মায়ের কথা। সেখানে আমার গায়ের রঙ একটি
বড় টপিক। শুনতে শুনতে আমি পাশের ঘরে ঘুমের মুখে। আমার মামার মেয়ে যে আমার চেয়ে বুদ্ধি, বিদ্যায় কম হলেও বর্ণে আমার চেয়ে এগিয়ে, তার কদর তাই পরিবারে বেশি। সে এসে বলল, ‘জানিস ওখানে কি বলছে? তুই কন্ডোম ব্রাস্ট হয়ে জন্মেছিস’। আমার বায়োলজি বইয়ে তখনো প্রজনন জাতীয় এসব চ্যাপ্টার আসেনি, তাই অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’ সে একরাশ হেসে বলে ফেললো, ‘আরে তোকে নিতে চায়নি, তুই জোর করে হয়ে গেছিস’। কি জানি আমার মধ্যে তেমন কোনো অপমানবোধ জাগেনি, যদিও ওর হাসিটা ছিল তাচ্ছিল্যের
আর বিনোদনের, সেটা আমাকে আঘাত করেছিল। পরে যখন বুঝেছিলাম আমি বাবা-মায়ের আনওয়ান্টেড সন্তান, তখন বাবার প্রতি গভীর
অবিশ্বাস জন্মেছিল।
মা তার নিজের বাড়িতে গিয়ে স্বামীর জ্ঞান ও
প্রতিপত্তি নিয়ে এবং নিজের ভালো থাকা নিয়ে এমন গল্প বলতে শুরু করতেন যে, ভুলেই যেতেন আমারা দুটি
ছোট প্রাণী নীরবে সব মাথায় ছেপে নিচ্ছি। আমাদের অনুসন্ধানী মন এমনি করে মামাবাড়ির তীর, বর্গায় তোলা চটি বই নামিয়ে
আনতে বাধ্য করে। বিস্ময়ে আমরা দেখি, সেই নেতা কাম রাজনীতিবিদ বড়মামা কোনো ইতিহাসচর্চা নয়, নিয়মিত চটি বই পড়েন। ভাষাগুলি না বুঝলেও বিষয়টা
শরীর ও ছেলেমেয়ে সর্ম্পকিত, তা বুঝতে পারি। বড় হয়ে মাথায় কথাগুলো এলে বিভীষিকা মনে হতো। সেই ভাষা, আবেদন ও বর্ণনা হয়তো আধুনিক একাধিক এক্সমার্কা ছবি ও পর্ণসাইটকে হার মানায়। সেগুলি যে কোথা থেকে তিনি সংগ্রহ করতেন, আজও আমার কাছে তা রহস্য। রুচির নিম্নতার সঙ্গে বুঝি
রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই।
একবার মামাবাড়িতে এক দারুণ ঘটনা ঘটে আমায় নিয়ে। ওখানে আমরা একটা বাড়িতে মামার মেয়ের সাথে টিভি
দেখতে যেতাম সময় পেলে। সেখানে অনেক ছেলের মধ্যে ছিল তাজেল নামের একজন। এ গ্রামের ছেলেদের মতো লাজুক ছিল না, কথা বলত
নিয়মিত। সেজমাসীর বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে আনতে, আমার সেই মামার মেয়ে যে আমাকে এক কোপে পেলে দুই কোপে কাটবে না
এমন মনোভাব রাখত, সে বাদে অনেকেই এমন কি বাবাও গিয়েছি্লেন। বিকেলে আমরা ঘুরতে ঘুরতে ওই টিভি বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে
নদী দেখতে যাব ভাবছি। তখন সেই ছেলে এসে হাজির। সে বলল নিয়ে যাবে, আমিও হাঁটা দিই। এদিকে মামার মেয়ে এসে বাড়িতে জানায়, আমি তাজেলের সাথে মাঠের
দিকে যাচ্ছি। গ্রামে মাঠ মানেই বিছানা, সেদিন সেটা শিখি। সবাই মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে আমাকে খুঁজতে। তারপর মা্মার মেয়ের
ডাইরেকসনে ও প্রযোজনায় এক নাটিকা উপস্থাপিত হয়। আমার চটি দর্শনের মামা মাকে
বলতে থাকে, তার পলিটিক্যাল কেরিয়ার শেষ। ‘যা তোর মেয়েকে নিয়ে চলে যা! মুখ পুড়িয়ে দিল তোর মেয়ে
আমার’। নিরুপায় মা বলতে থাকে, আমার মেয়ে অমন নয়, তাছাড়া ওর তো পিরিয়ডস হয়েছে। এবারে পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকা অপরাধী শ্রমিক আমাকে ছাদে টানতে
টানতে নিয়ে যায়। চীৎকার করে বলতে থাকে, প্যান্ট খোল! প্যাড ছিঁড়েখুঁড়ে বলতে থাকে, কই কোথায় রক্ত? বাবা ছুটে আসে মারতে। বলতে থাকে, ‘আমার সম্মান থাকল না’।
শহরের খোলা পরিবেশ ছেড়ে
মেয়ে যাবে এঁদো গ্রামে শরীরের জ্বালা মেটাতে এক ছেলের সাথে, তাও এত কম বয়সে, এটা তাঁরা কী করে বিশ্বাস করে নিলেন, জানি না। নিজের রক্ত ও সংস্কারের ওপর তাদের কোনো আস্থাই জন্মায়নি বুঝলাম। মেয়েদের সম্মান যে যোনি আর
প্যাডে আর রক্তে থাকে, তা আমার বাবা-মা ও তাঁদের পরিবারের লোকজন সেদিন
আমায় বলে দিলেন। কিন্তু সেদিন আমি বুঝতে পারিনি, আমার সমবয়সী একটি ছেলের সাথে এক পা হাঁটার সঙ্গে পিরিয়ডসের
কি সম্পর্ক! পরে অনেকটা বড় হয়ে হাসি পেতো আমার। মামার বাড়ির সকলেই বুঝি বিশ্বাস করতেন, এই সময় মেয়েদের ছেলেরা স্পর্শ করে না। হাদিস জ্ঞান হয়তো! ধর্ম কত অবৈজ্ঞানিক হতে
পারে, সেটা বুঝে আমাকে ধারণ করার আর কিছুই বেঁচে থাকে না জীবনে।
কিন্তু সেদিনের সেই অপমান
আমার জীবনের পথ বদলে দেয়। পড়ায় ফাঁকি দেওয়া কমে যায়। সরলতা হারিয়ে যায়। আমার মধ্যে এই প্রতিহিংসা
জন্ম নেয় যে, এদের আমাকে পরাস্ত করতেই হবে। একটি একটি ভালো বিয়ে ও একটি ভালো চাকরির চিন্তা আমাকে দিনেরাতে হন্ট করতে থাকে। আমি আমার বড়মামার মৃত্যুতে, এমন কি দিদার মৃত্যুতেও
সেখানে পা দিইনি। মামার বাড়ি আমার কাছে নরকের চেয়ে ঘৃণ্য বলে মনে হয়েছিল। আর সেই চটিবই পড়া, অশ্লীল ভাষায় রাজনীতি করা, একগাদা ছেলেমেয়ে বোনদের সামনে অর্ধনগ্ন হয়ে
পড়ে থাকা ও নিজের স্ত্রীর সাথে প্রকাশ্যে সহবাসে লিপ্ত থাকা লোকটির প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মেছিল। সেই ঘৃণা যাবতীয় মধুর স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছিল। ‘মামা’ শব্দটি একদম অচেনা হয়ে গেছিল আমার কাছে।
বাবা ধর্ম না মানলেও আজানের
পরে বাড়িতে ভালো মেয়েরা ফেরে না, এমনটা আমায় শিখিয়েছিলেন। এমন কি গায়ে ওড়না না দিলেও
তাঁর আপত্তি ছিল। সব মিলিয়ে একটি ভালোমেয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা আমি সেইদিন মামার বাড়িতে নষ্ট করে দিয়েছিলাম বাবা-মায়ের। পরবর্তীতে বাবা অনায়াসেই
মায়ের সঙ্গে গল্প প্রসঙ্গে বলতেন, মেয়ের দৃষ্টি ভালো নয় সে তা আমি সেদিনই ধরতে পেরেছি। ধীরে ধীরে বাবাও আমার কাছে
অচেনা পুরুষ হয়ে ওঠেন, যেন আমার কোনো প্রতিবেশী। প্রেমিকের সেই প্রথম গালি ‘বেশ্যা’ যা শুনে আমি সাতদিন স্কুল
যেতে পারিনি, সে ঠিক বাবার সাথে এক খাতায় দ্বিতীয় নম্বরে নাম তোলে। নিজের অজান্তেই প্রথম
সন্তান জন্ম নিচ্ছে জেনে, তাকে এখুনি নিতে পারব না, কেননা ডব্লু বি সি এস
পরীক্ষা আছে, এ কথা বললে বাবা ডাইনিং টেবিলে বলে ফেললেন, ‘মেয়েদের মা হতে হবে নয়তো মাগী’। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি সেদিন। এমনি করেই অচেনা পুরুষের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে আমার জীবনে। নিজের নিঃশ্বাস বিষের
হল্কার মতো তাড়া করতে থাকে।
মায়ের সেইসব কথা সবসময় মন্ত্রের মতো বাজতে থাকে, তোকে তো আমরা ছাইয়ের গাদায় ফেলতে পারতাম, কিন্তু ফেলিনি। মা কালো রঙের এক মেয়েকে
অনাথ না করে নিজের পরিচয়ে মানুষ করেছেন, তার জন্য আমার কৃতজ্ঞতার বদলে আমি ক্রমশ প্রতিবাদী হচ্ছি, নিজেই দাবী করছি আমার বেঁচে থাকার ও
আদর যত্ন পাওয়ার, ফর্সা দাদার সব ভাগে হাত বসানোর, এইটি মা মানতে পারতেন না। ক্রমশ একা হতে থাকি, কিন্তু ভেসে যাওয়ার বদলে
আমার মনের জোর বাড়তে থাকে। সবার অলক্ষ্যে আমি নিজেকে
শক্তিশালী করতে থাকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন