পুষি
দু’দিন ধরে কঙ্কা কাঁদছে, কেঁদেই যাচ্ছে। শাশুড়িমা সকালে বেশ শুনিয়ে শুনিয়ে রজতকে ঝেড়েছিলেন,
-এই ঢং তো আর সহ্য হচ্ছে না! বাচ্চাটা চলে যাওয়ার পর তো এত কাঁদেনি!
একটা বেড়ালের বাচ্চার জন্যে এমন মরাকান্না! রাস্তার জিনিস রাস্তায় ফিরে গেছে!
কথা ঠিক; দু’মাস আগে যেমন হঠাৎ
উদয় হয়েছিল ঠিক তেমনি হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল পুষি। সেদিন রান্নাঘরে কঙ্কা শুনতে পেল দেওয়ালটার পেছনে
কোথাও ডাকছে বেড়ালটা। প্রথমে গা করেনি। ওর
বাচ্চাটা যেদিন ‘নেই’ হয়ে গেল সেদিন
থেকে কঙ্কার সারাক্ষণ মনে হতো কচি গলায়
কেউ কাঁদছে কোথাও। কিন্তু ওটা বাচ্চার আওয়াজ নয়, একটা
বেড়ালছানা। বোঝা গেল মিনতিও শুনতে পাচ্ছে। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মিনতি দু’বার ঘুরে এসেছিল বাড়ির পেছনে। অবশেষে গেটের
বাইরে ড্রেনের ভেতরে দেখতে পায় ছানাটাকে। কঙ্কাও বেরিয়ে এসেছিল রান্নাঘর ছেড়ে;
গেটের ভেতরে রাস্তা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।
-বিলাই বাচ্চা বউদি মনি। কালা
বিলাই।
কঙ্কাই বলল ছানাটাকে তুলে আনতে।
-না গো আমি ড্রেন ঘাঁটব না!
সাফ জবাব মিনতির। কঙ্কার কী যে হলো
নিজেই রাস্তায় নেমে আলগোছে তুলে নিল ছানাটা। আশ্চর্য! ফোঁসফাস কিছুই করল না। কুচকুচে কাল। মুখের কাছটায়
সাদা আর লেজটাও সাদা। পিটপিট করে কঙ্কাকে দেখছিল। শাশুড়িমা হইহই করে উঠলেন।আর মিনতি?
-আমি কিন্তু ইটার হাগা মুতা পরিষ্কার
করছি না বউদিমনি।
মিনতি চা বাগানের মেয়ে। কাজকামে যেমন চতুর, কথায়ও চোখা।
দিন কয়েকের মধ্যে দিব্যি পোষ মেনে
গেল বেড়ালটা। কঙ্কার পায়ে পায়েই ঘুরতো। বেড়ালটার জন্যে
কার্ডবোর্ডের বাক্সে খবরের কাগজের টুকরো জমিয়ে শোয়ার জায়গা করেছিল কঙ্কা। বাক্সটা
কঙ্কার খাটের নিচে থাকত’। লক্ষ্মী
বাচ্চার মতো আলো নিভলেই ওর আস্তানায় ঢুকে পড়তো পুষি।
কঙ্কার সব কিছুতেই আবার ছন্দ ফিরতে
শুরু করেছিল। রাত কেটে কচি গলার কান্নাটা আর চোখ বুজলেই সেই দৃশ্য, আর ওকে
জাগিয়ে রাখছিল না। রজতকে একরাতে
শরীরও ছুঁতে দিল।
পুষি হারিয়ে যাওয়ার পর আবার সেই
অস্থির সময়গুলো ফিরে এলো যেন। সেই রাত, সেই
তুলতুলে ছোট শরীর, তুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সাদা ফকফকে
কচি হাত; চার মাস আগের সেই দিন।
ষোলই ফেব্রুয়ারী। অস্বস্তি লাগছিল
খুব। পাড়ার দীপালি ধাত্রীকে খবর দিয়েছিলেন শাশুড়িমা। পরের সপ্তায়
ডাক্তারের নিয়মিত চেক-আপের দিন। তেল গরম করে পেটে মালিশ করে দিয়ে গিয়েছিল ধাত্রী। আরাম হয়েছিল। কিন্তু ফের ব্যথা ফিরল দুপুরের পর। রজত বাড়ি ছিল না।
কবিতা উৎসবের তোড়জোড় নিয়ে মহাব্যস্ত। অনেকবার কল দেওয়ার পর ফোন তুলেছিল। রাজ্যের বিরক্তি গলায়; কঙ্কার কান এড়ায়নি। ঘন ঘন বাথরুমের চাপ হচ্ছিল। ঘন্টা দু’য়েক পরেই রক্ত! মিনতিই দেখেছিল কঙ্কার দু’পা বেয়ে
রক্তের ধারা। আধঘণ্টার মধ্যেই
সব শেষ। রজতকে ফোনে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে গভীর
রাতে ওষুধের ঘোরের মধ্যেও কঙ্কা টের পেয়েছিল কপালে রজতের ভেজা ঠোঁটের ছোঁয়া। ঘোরের
মধ্যেই ইচ্ছে হয়েছিল ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে কিন্তু হাত-পা বিবশ, বিবশ ছিল চোখও। স্মৃতিতে কোথাও বাজছিল
একনাগাড়ে,
-মেয়ে হলে মীরা; ছেলে আয়ুষ্মান।
কাপড়ে মোড়া ছোট শরীর, ফকফকে সাদা হাত - একঝলকের জন্যে দেখা সেই
দৃশ্য নিপুণভাবে মগজে খোদাই হয়ে গিয়েছিল; কঙ্কা বোঝেনি।
হারিয়ে যাওয়ার আগের রাতে পুষি
গুটিশুটি উঠে এসেছিল বিছানায়। বুকের কাছটায় কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ
অচেনা ওমে কঙ্কা চমকে উঠেছিল। তারপর এক অদ্ভুত প্রশান্তির আবেশে ডুবেছিল। ভোরের দিকে ঘুমের ঘোরে রজত এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল
ওকে। পুষির তুলতুলে গায়ে ঠেকে গেল আঙুল; ব্যস এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছিল নিচে। ভড়কে গিয়ে খাটের নিচে ঢুকে গেল পুষি। কঙ্কা অবাক! মিলছিল না হিসেব। দিনটা ছিল শুক্রবার। খাটের নিচ থেকে অনেকক্ষণ পর
পুষি মাথা বার করেছিল। কঙ্কা ওর ভয় ভাঙাতে কোলে বসিয়ে বাটি করে দুধ খাইয়েছিল।
রজত তখনও বিছানায় গড়াচ্ছে যেন কিছুই
হয়নি। আইপিএল-এর টি টয়েন্টি ম্যাচ ছিল
সেদিন। খেলা দেখবেন বলে শ্বশুরমশাই বাজারে গেলেন না। মাছওয়ালা, সব্জীওয়ালা আসে সকাল দশটা নাগাদ। আশে পাশের
ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে ঢুকে পড়লেই সারা; কিছুই মিলবে না আর। মিনতি কাজের কাজী, ঠিকঠাক মাছওয়ালার টিকি ধরে ফেলেছিল। বেশ বড় বড় কৈ। শ্বশুরমশাই মাছওয়ালার সাথে দরদাম করে প্রায়
পুরো ঝাঁকাই নিয়ে নিলেন। কঙ্কার গা ঘেষে পুষিও দেখছিল মাছের সদাই। মিনতি গামলা
ভর্তি কৈ মাছ পুষির সামনে নেড়ে বলল,
-বউমনির আহ্লাদী খবর কী? মাছ পসন্দ হইসে?
মাছওয়ালা দাঁত বের করে হাসছিল। ‘আলু সীম বড়ি দিয়ে কৈ মাছ রান্না হবে’,
শ্বশুরমশাই বায়না দিলেন। পুষি তখনও কঙ্কার পায়ে পায়ে। তারপরে সেই যে
রান্না ঘরে ঢুকল কঙ্কা! মিনতি মাছ নিয়েই পড়ে থাকল। অন্যেরা ক্রিকেট ম্যাচে। কাটাকুটি
সব কঙ্কাকে একহাতে করতে হলো। মাছ, ডাল, শাক, করলাগুচ্ছের রান্না হলো। পুষির কথা মনে করার সময় কই? রান্না শেষে উপরে উঠেছিল গা ধুতে। ভ্যাপ্সা
গরম। ওমা! জানালার গ্রিলের কাছে বসে পুষি একমনে কিছু দেখছে।
- পুষি!
ডাক শুনে ও তাকিয়েছিল কঙ্কার দিকে।
এক ফালি রোদ ওর কাল পিঠে খেলছিল। কঙ্কা গলার নিচে
হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছিল। গা ধুয়ে ফিরে এসে দেখে পুষি নেই। নিচেও নেই। খেলায় বিরতি চলছে তখন। রজত বাইরে। বিরতি শেষ হওয়ার আগেই কোকের বোতল নিয়ে ফিরেছিল। সবাই
খেল। কঙ্কার গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। পুষির প্লেটে
মাছমাখা ভাত পড়ে রইলো।
এই দুই দিন কেবলই মনে হচ্ছিল
জানালার পাশে হঠাৎ দেখতে পাবে পুষিকে। পুষি ফেরেনি। পুষির তুলতুলে ওম এখনও ওর বুকে
লেগে আছে। অথচ চার মাস আগে ছোট্ট সেই শরীরটা বুকে ধরা হয়নি কঙ্কার। বুক ভাসিয়ে
কাঁদছে ও, কেউ জানে না কেন।
রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল কঙ্কা। তুলতুলে হাতটার ফাঁক গলে সাদা লেজ। ধড়ফড় করে উঠে বসেছিল। গা
ঝাঁকিয়ে রজতকে তুলল’।
কঙ্কার মনে পড়ে গেছে খেলার বিরতিতে
রজত বাইরে গিয়েছিল। কানে বাজছে শাশুড়ির কথা
-রাস্তার জিনিস রাস্তায় ফিরে গেছে!
বিহ্বল রজত মাঝরাতে দেখছে অচেনা
কঙ্কাকে আর কঙ্কা কান পেতে শুনছে দূরে কোথাও পুষি কাঁদছে; কাঁদছে আয়ুষ্মান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন