বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত  







‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’...

কবেকার কোন রাত্রিদিন থেকে নতুনতর হয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা রাত্রিদিবসসকল যেন মজা ও ম্যাজিক ছড়াতে থাকলেও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নচিহ্নের সমস্বরে দূর থেকে ভেসে আসা মহরমের বাজনায় তাজিয়ার বর্ণবহুলতায় উন্মুখ হয়ে উঠতে উঠতে বাল্যস্মৃতি জেগে উঠতে থাকলেও তাকে প্রশ্নাতীতভাবেই বলরামপুরের মাঠ খেত প্রান্তর উজিয়ে হাটগঞ্জ উজিয়ে ডম্ফ বাজনার স্বরশ্রুতির নিবিড়ত্বে আটকে পড়তে হয়। বলরামপুরের বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও তাকে কিন্তু সম্পৃক্ত থাকতে হয় আত্মপরিচয়ের গূঢ়সত্যেই যে সে জাফর জোতদারের জোতজমির অংশ হয়ে উঠেছে শেষাবধি। আর পূর্বের কালজানি নদী, নদীপারের কুলঝোপ, নদী পেরিয়ে তুফানগঞ্জ বন্দর, দোতরাবাঁশির ভিতর জেগে থাকা বেঁচে থাকা, বেঁচেবর্তে থাকতে থাকতে কখন কীভাবে বলরামপুরই বুঝি আত্মপরিচয় খসিয়ে ফেলতে থাকে। তখন আব্বাস তার চোখের সারল্যে বয়ন করতে থাকে দিনযাপনের টুকরোটাকরা। যেন কাড়ানাকাড়া বাজে। সানাইবাদ্যে ভরে ওঠে ঘর গেরস্থালী। এত এত যাপনের ভিতর চুপ করে বসেও থাকা যায় না। কেননা যাপন দিয়েই তো মেপে নেয়া হয় জীবনযাপন। বলরামপুরের ওপর নেমে আসতে থাকে আদ্যন্ত বলরামপুর। গঞ্জ বল গাও বল হাটগঞ্জ বল সবেরই দিকে ছুটে আসতে আসতে আব্বাসকে প্রাণপণ জীবনের কুহকেই গিয়ে পড়তে হয়। আর চলেই যেতে হয় গ্রাম্য গীদালের বাঁশি দোতরার টানে আদ্যন্ত এক বলরামপুরের দিকেই যেখানে মাঠফসলের পরিপক্কতায় বিমূঢ় হয়ে থাকতে হয় আদিমধ্যঅন্তহীন এক যাপনপর্বের বহুরৈখিকতায়।





 ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে

কালজানি নদীর বিস্তৃতির সামনে এসে দাঁড়ালেও বিস্তারহারানো নদীর প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করবার উপায়ন্তর না দেখে তুমুল ফিরে আসা কালজানির শিথানে। প্রান্ত থেকে প্রান্তকথা থেকে জীবনমরণময়তায় শষ্যভূমির ভিতর খেলে বেড়ানো হাওয়া বাতাসে মিশে যেতে থাকে পাগারু বুড়ার দোতরার গান। পাগা্রু বুড়ার গানে গানে স্মৃতিকাতরতা এসে পড়লেও আদ্যন্ত এক বলরামপুর দানাফসলের দেশ হয়ে আকাশের নীলে নীলে ভূটান পাহাড়ের দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদল ফিরে আসতেই চায় কালজানির পাড়ে পাড়ে গো-মহিষের গালার ঘান্টির মত। কালজানি উজিয়ে কখন চলে যাওয়া জাফর জোতদারের ইজারা নেওয়া হাটের অন্দরে অন্দরে। রাতের স্মৃতিতে রাত্রিকালের স্মৃতিতামাসায় গরুর গাড়ির নিচে দুলতে থাকা লণ্ঠ আলোয় ঝমঝম করে ওঠে গানগুলি-
     ও রে আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু
     পাছা নাওয়ে বইসো
গান তো রক্তের ভিতর মিশে যাওয়া পরিণতির মতোসে তো নিমেষেই কন্ঠে তুলে  আনতে পারে চাষিকিষাণমৈষালমাহুতের কন্ঠের সুর। সে তো গানের ভিতর গান হয়ে নাচের ভিতর নাচ হয়ে নাচগানের পর নাচগান অতিক্রম করতে করতে জনপদজনজঙ্গল খেতিবাড়ি বন্দরে বন্দরে টাড়িতে টাড়িতে আবহমানের জীবনের গল্প বহন করতে থাকে। কালজানির ঢে কালজানির বয়ে চলা কালজানিতে বাইচ খেলা ধনীবাড়িতে সত্যপীরের গানের আসরে নিমজ্জিত হতে হতেই তার বেড়ে ওঠা বেঁচেবর্তে থাকা। দিগন্তপ্রসারী মাঠে মাঠে হারিয়ে যেতে যেতে আধিয়ারি প্রজাদের গানগুলি দিনকালগুলির ওপর ঝুঁকে পড়ে। হাল বাইতে বাইতে পাট নিড়াতে নিড়াতে জীবনের  দর্শনকে খুঁজে পাবার মরিয়া প্রয়াসটাই জোরালো হতে থাকে। জীবন গনগণে আঁচে দাউ দাউ হয়ে ওঠে। আব্বাজান জাফর জোতদারের প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে আস্ত এক জীবন নিয়ে  সে জীবনের প্রকৃত জীবনযাপন হয়ে উঠবার দিকেই নিবেদিত করে তুলতে প্রস্তুতিপর্বই শুরু করে দেয়পাথারবাড়ির দিকে কচুবনের দিকে বলরামপুরের কুঞ্জ পালের দোকানের দিকে সে আস্ত এক স্বপ্নবৃত্তান্তই রচনা করে ফেলে-
   আজি নদী না যাইও বৈদ
   নদীর ঘোলা রে ঘোলা পানি
কোচবিহারের রাজার শিকারযাত্রার মিছিলের বাদ্যে বাদ্যে সে তুলে আনতে থাকে কেবল গান আর গান; আর আব্বাস আমার ভিতর আমি হয়ে চলে আসে, আমার পরিক্রমণের ভিতরেই সে তুমুল মিশে যেতেই থাকে, আমার বয়ানে বয়ানে আত্মগত হয়ে উঠতেই থাকে-
    মুখকোনা তোর ডিব ডিব রে
    ভাওজি গুয়া কোনটে খালু
নদীর ভিতর নদী শুয়ে থাকে। নদীর মধ্য থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে। হাই তোলে। পায়ে পায়ে গড়িয়ে যায় রাস্তা। গলিপ্তহ। তস্য গলি বস্তির বাচ্চারা গান গায়। গানের গায়ে জড়িয়ে যায় খিস্তিখেউড়। আবার এক একদিন সীমাহীন এক প্রান্তর হয়ে ওঠে পৃথিবী। বাতিদান বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে। রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিদের ডানার নিচে কাঁচপোকা, ফড়িং। জীবন কাঁটাগাছের দিকে পাশ ফেরে। দেশাচারের নকশির ভিতর হরেকরকম মানুষজন। বিলাপরত স্কুলবালিকা। গান বাজনার তাড়সে সংকরমনতায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাঠ প্রান্তর থেকে উড়ে আসে প্রজন্মপীড়িত কথকেরা। তারপর লোককথার ঢঙে গল্প এগোতে থাকে। অন্ধকারের নদীর পাশে তখন ভূতুড়ে ভাটিখানা। আর চোখে জল আসতেই মাতালেরা সব প্রেমিক হয়ে যায়। প্রান্তবাসীর হাতে হাতে বাঁশি ঘোরে। বাঁশি বেজেও ওঠে আচমকা। তখন হেরম্ব বর্মন উঠে দাঁড়ায়। মহামানব হতে পাবার সুযোগ হেলায় সরিয়ে দিয়ে সে ধুলো-মাটি আর মানুষের আখ্যানমালা সাবলীল বলে যেতে থাকে। অবিরাম তাঁতকল ঘোরে। আর নদীর মধ্যে থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।

ভালো ভালো গান শুনে বড় হয়ে ওঠা
নানা রঙের মানুষ দেখে দেখে বেড়ে  ওঠা। অপমানের পর অপমান, গলাধাক্কা ডিঙিয়ে খোলা আকাশের তলে। আর নতুন শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উলুধ্বনি ভেসে আসে, রাজবংশী মেয়েদের দলবদ্ধ নাচ। বিবাহ উৎসবের দিকে যাত্রা শুরু করল একটি নিঃসঙ্গ  পালক। 

এতসব টুকরো, ছেঁড়া খোঁড়া সময় যাপন অভিঞ্জতা  সবসময় ঘিরে থাকে এই বহুমাত্রিক জীবনই তো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। ইতিমধ্যেই দেখে ফেলা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মানুষটিকে। আর গাছের পাতায় আঠা মাখিয়ে সারাদিন ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করত বাবুলাল বাঁশফোঁড়। অন্ধকারে শতশত জোনাকি পোকা। লোকজ এই ভুবন যার ভিতর থেকে কোনওদিনই বেরিয়ে আসা হবে না। অথচ ব্যাধ যুবকেরা সব একদিন ভুলে যাবে প্রলাপকথন। আর মাটির ঊঠোন থেকে অনিবার্‍য কিছু গান গোটা জীবন  সঙ্গে থেকে যাবে। জীবনের বৃত্তে ঘনঘন আছড়ে পড়বে উড়ন্ত ঘোড়া, টিপছাপ ও হস্তচিহ্ন। 





নদীত ফোটে নদীয়া হোলা’...


রাস্তায় রাস্তায় উপচে পড়ছে রোদ। মন কেমন করা রোদ। পথচলতি লোকজন সারা শরীরে মেখে নিচ্ছে  ছোট শহরের দাউ দাউ রোদ। আর শহরের সমস্ত পুরনো, শতবর্ষ আক্রান্ত ইতিহাসের ছোঁয়া লাগা সেই সব ভূতুড়ে বাড়িগুলির দিকে  কী যেন এক চোরাটানের কুহক। আবার বাল্যকালের বন্ধুরা যায় সব আগের মতো। সাইকেলকে ঘনঘন দাঁড়িয়ে পড়তে হয়
জীবন উবু হয়ে বসে পড়ে গেরস্থ বাড়ির সম্পন্ন উঠোনে। উঠোন জুড়ে সদ্য কাটা ধানের আঁটি। ঢেঁকিশালে পোষা বিড়াল। গলায় ঘণ্টা বাঁধা।  রাজবংশী সম্পন্ন কৃষকদের ডারি ঘর বা বৈঠকখানা ঘরে বসে দোতারার আওয়াজ শুনি। গেরস্থালীর কাজের ফাঁকে মেয়েরা চটকা গাইছে


আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই
দুয়ারত আসিয়া করে ম্যাও

অজস্র আবিষ্কারে ভরে উঠতে থাকে  জীবন, ঘটনাবহুল বর্ণময়, গনগনে মশালের আলোয় বৃত্তে চুপচাপ বসে থাকা জীবন। গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ সারতে থাকা
উত্তরবাংলার লোকায়ত ভুবনের মায়া তার জাদুতে সেই থেকে বন্দি। এবং আচ্ছন্ন।  
















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন