বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

অন্যরকম




পঞ্চাশ ডিগ্রি বাইরের তাপমাত্রা দেখায় ডিজিট্যাল থার্মোমিটার দেওয়ালের গায়ে।  আরও দেখায় আর্দ্রতা ইত্যাদি। ডিফিউজড সানলাইটের আলোয় এক অদ্ভুত সকালে ঘড়ি দেখায় সকাল আটটা সময়। এই সময়ে পোষা বেড়ালটা ডেকে ওঠে, গায়ে উঠে আসে, আদর করে আমাকে। ওকে দুটো দানা দিই। মুখরোচক অ্যাপেটাইজার তোলা থাকে প্যাকেটে, তাকে। গ্লাভস পরে ওর পটির গামলাটা ছাঁকনি দিয়ে  পরিষ্কার করে ক্যাটলিটার আর ময়লা আলাদা করি। সোফার হাতলে গোঁজা আছে অজস্র প্লাস্টিক প্যাকেট। ময়লা নিয়ে বাইরে বেরোই। ডাস্টবিনে ফেলে আকাশ দেখি। বাইরে হাওয়া বয়ে যায়। আকাশে জলদ মেঘ। পুরো অন্ধকার নয়।  ১৪০৩ নম্বর টড ট্রেইল রাস্তার সামনে ফুটপাথে দৈনিক খবরের কাগজ মোড়া থাকে প্লাস্টিকে। কে যে দিয়ে যায়! বিনি পয়সার কাগজ। হয়তো বিজ্ঞাপনদাতার   পৃষ্ঠপোষকতায় বিতরিত। কিম্বা বাড়ির আগের মালিকের সাবস্ক্রিপশন করা ছিলআমার ভালো লাগে খবরের কাগজ আজও। ছাপা। কালির একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে তাতে।

দু’দিনের কাগজ রেখে দিই ব্যাক ইয়ার্ডের লাগোয়া চালায়। ওখানে একটা  দোলনা আছে। ঝোলানো সোফা। ওখানে বসে কাগজ পড়ি যখন তাপমাত্রা সত্তর পেরোয়। আপাতত হাঁটি টড ট্রেইল ধরে। একটুখানি। এখানে অনেক গাছ। প্রতিটি বাড়ির সামনে গাছ এবং আবশ্যিক লন।  বাঁদিকের বাড়িটা ১৪০০ আর ডানদিকেরটা ১৪০১। এখানেই মিশেছে সাউথউড ড্রাইভ। অর্থাৎ তেমাথার মোড়। কয়েকজন দৌড়ে পার হয় আমাকে। কেউ কেউ হেঁটে যায়। দুয়েকটা সাইকেল এবং কিছু গাড়িও পেরিয়ে যায় আমাকে। মানুষেরা হাসে। হাত নাড়ে। আমিও প্রত্যুত্তর দিই। হ্যালো হাই পর্যন্তই কথা হয়। তবু হয়।

গাছগুলোর নাম জানি নাজানতে বড় ইচ্ছে করে। কে বলবে আমাকে! কে জানাবে অজস্র নতুন পাখির নাম যাঁদের দেখি রোজ সারাদিন! ‘টি মেকারে’ চা  বসিয়ে গেছিলাম। চায়ের জাগ থেকে চা ঢেলে নিয়ে ল্যাপটপে বসি। যতটা স্মৃতিতে আসে আজকের সকালটা, লিখে ফেলি। এখনও ত্রিজ্ঞ মাতামাতি শুরু করেনি। টের পাচ্ছি, ঘুম ভেঙ্গেছে তার। তাপমাত্রার হিসেবটা ঝালিয়ে নিই। ৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট = (৫০-৩২)/৯X৫ = ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একই হিসেবে ৭০ ডিগ্রি ফা = ২১.১ ডিগ্রি সে।
এটা গতকালের কথা।

এখন ইস্টার সপ্তাহ। শুক্রবার ২১ শে মার্চ ২০১৬। ক্রিশ্চিয়ানিটিতেও বারো মাসে তেরো পার্বন লিঙ্কন রিক্রিয়েশন সেন্টারে ইস্টার এগহান্ট দক্ষিণার ব্যাপার স্যাপার কিছু নেই শহরের পুরদপ্তর এর উদ্যোক্তা খাবারদাবার, মুখে রংমাখা, লাফঝাঁপ, ছবিতে রং মাখানো, আরও হাজার মজা যার অন্যতম এগহান্ট বা ডিমের খোঁজ একটাই শর্ত, এগহান্টে অংশ নিতে গেলে বয়েস হতে হবে নবছর বা তার চেয়ে কম

এগহান্ট খেলাটা খেলা হয় রঙিন বা নানা আঁকিবুকি কাটা আসল ডিম, সেদ্ধডিম, নকল ডিম, ডিমের আকৃতির চকোলেট, চকোলেট ভর্তি ডিম নিয়ে এই ডিমগুলোকে সাধারনত কোনো খোলামাঠে নানা স্থানে ছড়িয়ে বা লুকিয়ে রাখা হয় ইঙ্গিত দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে গিয়ে এই ডিমগুলোকে খুঁজে বের করে নিজের ঝুড়ির মধ্যে রাখতে হবে

এই ডিম লুকোনটা একটা শিল্প বিশেষ। খুব কঠিন ভাবে লুকোলে চলবে না। বিশেষত সেই বয়েসের বাচ্চাদের জন্য খেলা লুকোনটাও তাঁদের খুঁজে পাবার ক্ষমতা  অনু্যায়ী হতে হবে। বলা বাহুল্য, ঝোপঝাড় আর গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ডিম খোঁজার এবং সেই খোঁজার পরিশ্রমের সুফল ভোগের মাধ্যমে হয়তো শিশুর মনে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রোথিত হয়প্রতিযোগিতার স্পৃহা যে পৃথিবীতে প্রতিটি কাঙ্ক্ষিত বস্তুর প্রাপ্তি শ্রম নির্ভর! অনায়াসে পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায় না এই বাস্তবতা শেখানো তো জরুরী বটেই

খৃষ্টপূর্ব সময়ে ডিমই ছিল পৃথিবীর পুনর্জন্মের প্রতীক এদিকে গুড ফ্রাইডেকে যিশুর ক্রুসিফিক্সিওনের দিন ভাবা হয়, আর তার দুদিন পরে ইস্টার সানডেতে যিশুর পুনর্জন্ম বা পুনরাগমন ভাবা হয় এভাবেই যিশু চল্লিশ দিন অবস্থান করেন এবং অতঃপর ঈশ্বর পুত্র তাঁর পিতার সান্নিধ্যে গমন করেন। যিশুর পুনরাগমনের প্রতীক  হিসেবেও তাই ডিমকেই ভাবা হয়।

একটা নাগাদ লিঙ্কন রিক্রিয়েশন সেন্টারের অনুষ্ঠান শুরু হলোত্রিজ্ঞর দেড় বছর  বয়েস হতে মত্র কয়েকটা দিন বাকি। রিক্রিয়েশন সেন্টারের প্রশস্ত মাঠে এগহান্টে প্রচুর বাচ্চা এসেছে। বাবা মার হাত ধরে। বয়েস অনুযায়ী এগহান্টের ঘোষণা হচ্ছে। ০ থেকে ১, ১ থেকে ২, ২ থেকে ৩, ৩ থেকে ৫ - এই রকম। জীবনের প্রথম এগহান্টের ঝুড়ি নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে ত্রিজ্ঞ। ছবিতে রং দিচ্ছে। টয় ট্রেনে চড়ছে। খুব মজা করল সে। আমরা সাক্ষী রইলাম। দেখা হলো মিশরের  মহম্মদ আলি আর নাসরীন আর ওদের ফুটফুটে মেয়ে ইওসরার সাথে। ইওসরা ত্রিজ্ঞর চেয়ে তিন সপ্তাহের ছোট।


বিকেলে পাঁচটা সময় আবার বি ক্রিক পার্ক। সাউথ ওয়েস্ট পার্ক ওয়ের লাগোয়া। নানা রকম আউটডোর খেলাধুলোর ব্যবস্থা সমেত বিশাল পার্ক। ২৩৭টা গাড়ি পার্ক করা যেতে পারে এখানে। এখানেও সেই এগহান্টের খেলা। রবিবার পর্যন্ত চলবে ইস্টারের উৎসব। কমিউনিটি সেন্টার, পুর পরিষেবা নিগমগুলো, ইস্টারের নানা উৎসব পালন করে। পিঠে ক্রস বহন করে যিশুর সেই অন্তিম মুহূর্তগুলো পুনরাভিনয় করা হয় সমস্ত অ্যামেরিকা বা ক্রিশ্চান দুনিয়ায়। এখানে  ব্রায়ান শহরাঞ্চলে বেরোল সেই শোভাযাত্রা। জেরুজালেমেও ক্যাথলিক প্রটেস্ট্যান্ট নির্বিশেষে  অসংখ্য মানুষ যিশুর কথিত হেঁটে যাওয়া পথে নিজেরা আবার শোভাযাত্রা করে দিনটিকে স্মরণ করে। ইস্টার এবং এগহান্টের পালা শনি এবং রবিবারও চলবে এই কলেজ ষ্টেশন ব্রায়ান এলাকায় লক্ষ লক্ষ ডিম আকাশ থেকে হেলিকপ্টারে করে ছাড়া হবে। দি ঈগল কাগজটির স্থানীয় সংস্করণে তার বিশদ নির্ঘন্ট পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, বি ক্রিক পার্কে আবার নাসরিন আর ইওসরার সঙ্গে দেখা হবার কথা,  চিনা অধ্যাপক ডঃ হাউয়ের কথা, তারা আর স্টিভ ডেকারের কথা, বাংলাদেশি মেয়ে কাকলির কথা। সবাই এসেছিল সেই মেলার মাঠে বিকেলে। কাকলি তার  মেয়েটিকে প্র্যামে চাপিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এসেছে। শাঁখা সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। বলল, তেমন আলাপ হয়নি কারও সাথে। বেশিদিন আসেও নি এখানে। বাংলা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে উঠছিল। বলল, আসেন না আমাদের বাড়ি, কথা বলব!  অবশ্য আমরা ঠিকানা বিনিময় করিনি। টেলিফোন নংও নয়। ইংরেজি বলল প্রথমে। তারপর আমরা বাংলা বলতেই গড়গড়িয়ে বাংলা চলল। বলল, আপনারা ইন্ডিয়ান, ইন্ডিয়ানরা তো বাংলা বলতেই চায় না। অবশ্য কাকলির কথা শুনে আমার খটকা লাগল। কোনো ইন্ডিয়ান বাঙালিকে দেখেছে সে। আমি যে কজনকে  দেখেছি, তাদের তো এই দোষ দেখিনি! অবশ্য সেকেন্ড জেনারেশন বাঙালিদের  কথা আলাদা। বাড়িতে বাংলার চল না থাকলে দ্বিতীয় প্রজন্ম স্থানীয় সংস্কৃতিকেই গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

স্টিভ অবশ্য নিজেই এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করল। আলাপ করালো স্ত্রী তারার  সঙ্গে। ভারত সম্পর্কে আগ্রহী। ত্রিজ্ঞ মানে বুদ্ধদেব এটা জেনে জিজ্ঞাসা করল আমরা বৌদ্ধ কিনা। এবং আমরা যে হিন্দু এবং আমাদের নামে বুদ্ধদেব যিশুখিষ্ট ইত্যাদি ঢুকে যায় এবং বৃহত্তর ভারতীয় সমাজে মানুষ যে যেমন ধর্মেরই হোক না কেন বা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না করেও একসঙ্গে থাকে, এটা জেনে চমৎকৃত হলো আমি বললাম, সাহেব বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের অংশটা বড় বিচিত্র। ক্রিশ্চিয়ানিটি আমরা সম্মান করি। যিশুকে আমরা ত্যাগের প্রতীক ভাবি। দেবলীনা বলল, তুমি সাহেবকে তো খুব ওপরে তুলে দিলে! আমি বললাম ভুল কি বলেছি? মিশনারিরা তো বাংলাকে কম প্রভাবিত করেনি! স্কুল কলেজ হাসপাতাল অনাথালয় ইত্যাদির  সঙ্গে ফাদার সিস্টার তথা ক্রিশ্চিয়ানিটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের গল্প উপন্যাস সিনেমা থিয়েটারে চার্চ ফাদার বা সিস্টারদের খুবই শ্রদ্ধার স্থান দেওয়া হয়, এটা তো অস্বীকার করার নয়। অন্যকে সম্মান দিলে আমার সম্মান নষ্ট তো  হবেই না বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হবে তাতে। তারা এবং স্টিভ ঠিকানা বিনিময় করল এবং আমার ফেসবুক বন্ধু হয়ে গেল। পারস্পরিক বাড়িতে যাতায়াতের আমন্ত্রণও রইল।

অ্যামেরিকার ভালোমন্দ দোষগুণ বিচারের দায় আমার নয়।এখানে থাকতে হয়   মাঝে মাঝে। ভালো খারাপ এক কথায় বলা যায় না। যা বলা যায় তা হলো, এ এক আলাদা পরিবেশ। অন্যরকম। প্রতিনিয়ত নানা দেশ ভাষা বেশভূষা খাদ্যাভাস মানুষ অ্যামেরিকার ধারায় মিশে যাচ্ছে। চালিত হচ্ছে। চালিত করছে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন