সুখের দোকান
প্লাস্টিকের ঝুড়িটা হাত
থেকে কেড়ে নিয়ে বাচ্চাটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল অনুপমা। মনে হলো, চড়টা যেন আমার গালে এসে পড়ল। আমাকে উদ্দেশ্য করেই মারা বুঝি!
বাধা দিতে ছুটে গেলাম, ততক্ষণে বাচ্চাটার চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়া শুরু হয়েছে।
হিসহিসে গলায় আমাকে বলল, কোন্ পাপকে ঝোলাতে চাইছো আমার গলায়?
আদ্যিখেতা করছ করো, আমার চৌহদ্দিতে যেন না আসে ওই পাপটা।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পাঁচ বছরের
সোহম। ওর মাথায় হাত রাখলাম। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের ঘরের দিকে যেতে যেতে
শুনলাম, অনুপমা চেঁচাচ্ছে, শুয়োরের বাচ্চাটাকে বিদেয় করে ছাড়ব আমি!
আমি রূপম রায়, ব্যাংকে চাকরি করি। অনুপমা আমার স্ত্রী। স্কুলশিক্ষিকা, সুন্দরী। দেখেশুনে বিয়ে আমাদের। আমার অনুকে বরাবরই খুব অবোধ্য মনে হয়। দশ বছর ধরে সংসার সমুদ্রে
স্নান করছি, তবুও বুঝতে পারি না ঢেউয়ের স্বরলিপি। সন্তান নেই আমাদের। অনুপমা মাতৃত্ব চায় না। আমি ওকে আর জোর করিনি।
সোহমকে কয়েক দিন আগে শিলিগুড়ির
একটা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছি, যেদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ফোনটা এসেছিল। আমি কিছু জানাইনি
অনুকে। শুধু চুপচাপ অনলাইন টিকিটটা কেটে নিয়েছিলাম। সেদিন অনুর মা’ও মারা গেছিলেন, রাত বারোটা নাগাদ। অনুকে এই প্রথমবার কাঁদতে দেখেছিলাম। আমার ভালো লেগেছিল।
এটা কে? কোত্থেকে আনলে? কার পাপ?
মনে হচ্ছিল মরে যাই। অনুর
এই নোংরা কথাগুলো আমি নিতে পারছিলাম না। ও ভয়ানক বাজে ব্যবহার করে, আমি জানি। তাও একটা শিশুকে এভাবে বলতে পারে একজন নারী
হয়ে, ভাবিনি আমি।
আর আজ সকালে তো চড় মেরেই
দিল। গালটা ফুলে গেছে বাচ্চাটার।
ডাক্তারখানাগুলোতে আজকাল এত ভিড়!
পিরিত করে আবার ডাক্তারখানায়
যাওয়া হয়েছিল! তা এটা কার? সোহিনীর? ও মরেছে বুঝি? আর আমার বুকে পাপটাকে চাপিয়ে দিয়ে গেছে?
আমি সোহমকে ওষুধ দিতে দিতে
বললাম, ওকে টানছো কেন? বাজে বকা বন্ধ করো।
একবারে আমার কানের কাছে
মুখটা ঠেকিয়ে অনুপমা বলল, তোমরা শুয়েছিলে বলোনি তো? কোথায় কোথায় দেখা করতে যেতে?
অসহ্য হয়ে উঠছিল চারপাশ।
একটু আগের ঝড়টা এখন
স্বাভাবিক। সারা ঘর অসম্ভব নিস্তব্ধ। সোহমকে কোলে বসিয়ে মাছের
কাঁটা বেছে দিচ্ছে অনু। যাক বাচ্চাটা তার মাকে পেলো অবশেষে!
সেদিন যদি সমর ফোনটা না করত, জানতেই পারতাম না সোহমের অস্তিত্বের কথা। সমর
আর অনুর ভালোবাসার কথা। সমর আমার অফিস-কলিগ। অনেকবার আমাদের বাড়ি এসেছে। আমি প্রায় দু’ বছরের ওপর কলকাতার বাইরে ছিলাম। ট্রান্সফার হয়েছিল বিহারে।
বহুবার বলেছিলাম অনুকে আমার কাছে আসতে, কিন্তু ও আসেনি স্কুলের দোহাই
দিয়ে। আসলে ও সমরের জন্য আসেনি।
- মা আপনি জানতেন, তাই না, সোহমের কথা? সমর আর অনুর কথা? আপনি ওই শিশুটাকে কীভাবে এত অবহেলা করলেন?
- আমি, বিশ্বাস করো, বারবার অনুকে বলেছিলাম, এ কাজ না করতে।
- আমি বাচ্চাটাকে আনতে যাচ্ছি।
- শোন বাবা, অনু কিন্তু চায় না।
সেদিন রাগের মাথায় প্রচুর
কথা শুনিয়েছিলাম, উনি বোধহয় খুব কষ্ট
পেয়েছিলেন, কেননা সেদিন রাতেই তাঁর চলে যাওয়ার খবরটা
পেয়েছিলাম।
অনু তুমি বোধহয় জান না, সমর আর নেই। ওর ক্যান্সার হয়েছিল। বাচ্চাটা তোমার কাছে থাকুক, এই ছিল শেষ ইচ্ছে।
শিলিগুড়ির সমস্ত সম্পত্তি সোহমকে দিয়ে গেছে ও। আমি নিজে গিয়ে ওকে দাহ করে এসেছি। অনু কোনো কথা
বলল না। বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল কাৎ হয়ে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে ওর গালে গাল ঘষল।
শুধু দরজা দিয়ে বেরোবার সময়
বলল,' বাবার পরিচয়টা দিতে পারবে ওকে'?
বেরিয়ে এলাম চুপচাপ।
- রূপমদা, আমি কালো বলে ভালোবাসলি না, তাই না? অনুপমা সত্যি সুন্দর। তোকে খুব আদর করবে।
- সোহিনী কি বলছিস এসব! আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি, কিন্তু মা চায় না রে, বোঝ একটু!
- বুঝেছি। সুখী হোস্!
বিয়ের দিন ভোররাতে মা ডেকে
তুলে চিঁড়ে মুড়কি খাওয়ালো। গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, সোনা বলে কত আদর করল, তারপর জানালো সোহিনী আড়াইটে নাগাদ গলায় দড়ি দিয়েছে।
অনুকে সব বলেছিলাম। বলিনি শুধু ওর মৃত্যুর কথা।
এইমাত্র দুটো জীবনকে হাসতে
দেখলাম প্রাণ খুলে। সোহিনী, আমি খুব সুখী হয়েছি। আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করিস। দেখা হচ্ছে আমাদের।
বোতল থেকে জল আর গুনে গুনে
তিরিশটা ট্যাবলেট গিলে নিলাম।
ফাল্গুনি হাওয়া বয়ে চলেছে
শিরা উপশিরায়। আমি সুখী হব! ভীষণ সুখী!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন