গল্প লিখব না বলে কলমকে বলেছি
ঘুমিয়ে পড়
যুবকটি গল্পের একটা চরিত্র হতে পারত। যদি সঙ্গে ইতিমধ্যেই হারিয়ে না গিয়ে থাকত। সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিপর্যস্ত না করত তাকে। বিষিয়ে তুলত না তার চিন্তা, চেতনা, মননকে। রাতের পোষা পালক দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেলে তার মন বাঁওরা হয়ে উঠত। ছেঁড়াখোঁড়া দিনগুলোকে সারাই করার বদলে রাস্তায় হাঁটতে চাইত সে। আলগা পাজামায় লেগে থাকা রহস্যময় দাগগুলো প্রমাণ করত সুচারু বান্ধবীদের সম্মোহন। এই রহস্যময় দাগগুলো অনুসরণ করতে করতে যুবকটি একদিন ঢুকে গেল তার চেয়ে বয়সে বড় এক বাড়ির অন্দরমহলে। টিপটপ সাজানো বাড়িটার সর্বত্র ঐশ্বর্য, বৈভব। সে সেখানে থেকেছে, ঘুমিয়েছে, কম্পিউটারে তুলে রেখেছে গত জীবনের গোপন তথ্যাবলি। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল, সেই দিনগুলোতে পাজামায় রহস্যময় দাগগুলোর আর প্রাদুর্ভাব না ঘটা। হয় সে সময় পায়নি অথবা সময়ের সদ্ব্যবহার করেছে সঠিক উপায়ে। তখনো তার স্নায়ুর ঘুমিয়ে পড়ার সময় আসেনি। চরম দুর্দিন শুরু হতে তখনো বাকি আস্ত দুটো মাস। কারণ তখনো পর্যন্ত অপশক্তির সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালাতে আরও একমাস দেরী।
কচ্ছপের খোলায় উল্টো শোয়ানো
রাজনীতি। ইতঃস্তত আগুন, রাস্তায় রাস্তায় জ্বলন্ত টায়ারের
দুর্গন্ধ, লুটপাট, ধর্ষণ,
চাঞ্চল্যকর স্তরে মানুষের জ্যান্ত পোড়া শবের ওপর দেবালয়ের
তূর্যনিনাদ। কীভাবে জীবনের প্রতি সৎ এক যুবককে আটকে
রাখতে পারে নিশ্চিন্ততা? সুতরাং পথে
নামার ঐকান্তিক আকুলতা তাকে নামিয়ে আনে ঠিকানাবিহীন
গলিতে। চোখ গিলতে
থাকে একটার পর একটা ঘটনা। দু’মাস ধরে গুছিয়ে তোলা অঢেল পেট্রোল, গ্যাস সিলিন্ডার আর হ্যাঁ, আতঙ্কিত সংখ্যালঘু বাড়িগুলোর তালিকা।
আত্মরক্ষার উপায়হীন যারা যুঝছিল পাশবিক শক্তির সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে। যুবক প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। খুনিরা তার মাথা কেটে ঝুলিয়ে দিয়েছে
সর্বসমক্ষে। অসহায় নাম-ঠিকানা খুনিদের হাতে
নিধনযজ্ঞের উন্মত্ততা হয়ে উঠেছে সুপরিকল্পিত
ভাবেই। যুবকের চোখে লং শটে, ক্লোজ শটে
ধরা থাকছে ধর্ষিত মানবাধিকার। যা অদূর ভবিষ্যতে ছেঁড়াখোঁড়া বিকারগ্রস্ত এক মস্তিষ্কের জন্ম দেবে।
নির্ভরযোগ্য কুঠুরি থেকে ভারতবর্ষ সাক্ষাৎ করে যুবকের
দীর্ঘদেহ, আজানুলম্বিত বাহু, উস্কোখুস্কো চুল এবং চামড়ার রুক্ষতা কীভাবে
অসহায়ের মতো আগলে রাখতে চাইছে পুড়ে যাওয়া
বাড়িগুলোর ততোধিক পুড়ে যাওয়া আত্মাসমূহকে। ধরে রাখতে চাইছে পূর্ণ গর্ভবতী সেই মা এবং
তার না জন্মানো শিশুটিকে। খুনিরা যে পূর্ণমাসী গর্ভ চিরে বের করে এনেছিল পূর্ণাবয়ব শিশুটিকে এবং অবলীলায়
ত্রিশূলে গেঁথে ফেলেছিল তার কচি হৃদয়ের কান্নাকে - পৃথিবীতে তার আগমনের সূচনাকে। প্রতিরোধের নিষ্ফল চেষ্টায়
যুবক আঁকড়ে ধরেছিল ছিন্নভিন্ন জরায়ু আর রক্তাক্ত পাকস্থলী, বৃক্ক, অন্ত্র
সহ জননীর আর্তনাদকে। হর্ষোন্মাদ খুনিরা যুবকের লিঙ্গে আগুন ধরিয়ে
না-মর্দ গীধর ভেবে তাকে ফেলে
দিয়েছিল দগ্ধ লাশের স্তুপে। যুবক হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের
করতে চেয়েছিল এত বিনাশেও না মরা সেই হাত, সেই হৃদযন্ত্রের
ধুকপুক। তাকে তুলে
নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের সামনে; মানুষের শুভবুদ্ধির সামনে। নারকীয় যজ্ঞভূমি থেকে ফিরে আসতে পেরেছিল
সে। অসীম মনোবল তাকে ফিরিয়ে এনেছিল।
তাকে এসব লিখে রাখতেই হতো। গোপন অথবা প্রকাশ্য ধ্বংসলীলাকে পৌঁছে দিতেই
হতো পৃথিবীর কোণায় কোণায়। লিখতেই হতো সেই সব মেয়েদের কথা, যাদের বন্দী শিবিরে পর্যায়ক্রমে
ধর্ষণ করেছে বেপরোয়া, বিকৃত
খুনির দল। মাকে ধর্ষণ করেছে পুত্র স্থানীয়
গুণ্ডা, কন্যাকে ছিঁড়েছে পিতার বয়সী
দেববাহিনী। মেরে ফেলার আগে তাদের গা
থেকে খুলে নিয়েছে অলঙ্কার, যা দিয়ে
সেজে উঠবে অন্য কোনো নারী। অপমানিত হবে নারীত্ব। লিখতে লিখতে যুবক ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখে মায়ের কোল আর সেখানে দিগন্ত ছড়ানো সর্ষের হলুদে দৌড়ে চলেছে এক কিশোরী। কিশোরীর
পরনে মেঘলা আকাশের মসলিন। তার ভয়ঙ্কর পোড়া মুখ দেখে আতঙ্কিত যুবক উঠে বসে এবং প্রবল ক্ষিপ্রতায় বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। যুবকটি
গল্পের একটা চরিত্র হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু যে নিজেই একটি পূর্ণ কাহিনী, তাকে কি আর গল্পের অংশবিশেষ রূপে মানায়?
[অনুপ্রেরণা পেয়েছি শ্রদ্ধেয় সুজয়
বিশ্বাসের গল্প ‘প্যামফ্লেট’ থেকে (‘অ্যাশট্রে ৭’)]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন