বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

জিনাত রেহেনা ইসলাম

বই বাজার




আমার লেখালেখি শুরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। সেখানে প্রথম লিটিলম্যাগ কর্মীদের আমি  শ্রদ্ধা করতে শিখি। আমি জানতাম মানুষ দুটি কারণে লেখে এক, সে লিখতে পারে। দুই, তার লেখার প্রতিভা আছে। কিন্তু লেখালেখির জগত এত যে সংগ্রামের, সেটা দু চোখে দিয়ে সেখানে দেখি। যাদবপুরে পড়া সিনিয়র এক দিদি আমাকে নিয়ে যায় এক পত্রিকার সম্পাদকের কাছে। সে প্রথমেই আমাকে একটি গান করতে বলে। আমি সেটা  করে ফেলায় সম্পাদক বুঝে নেয় আমি লিখতেও পারি। তারপর কোন্‌ লেখকের বই পড়া একদম বাদ রাখতে হবে আর কাকে পড়তে হবে, তা ঝরঝর করে বলতে থাকে। আমিও মুদিখানার ফর্দের মতো তা লিখে নিই। কথা হয় আমাকে নিয়মিত  পাঠের আসরে যেতে হবে। আমার লেখা পড়তে হবে। যেদিন আমি সকলের ভোটে নির্বাচিত হব সেইদিন আমার লেখা ছাপা হবে। সদস্য পদের জন্য দিতে হবে কিছু টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হষ্টেল না মেলায়, আমাকে তখন থাকতে হয়েছিল পার্ক  সার্কাসের এক প্রাইভেট গার্লস হষ্টেলে। সেখান থেকে পাঠ সভাকক্ষে সাপ্তাহিক প্রেজেন্ট প্লিজ দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব না হলেও কঠিন ছিল। মহানগরীর জটিল পথ ঘাটের ম্যাপ বুঝে না ওঠার কারণে বিস্তর কাগজ কালির সঙ্গে লড়াই করেও লেখা নিয়ে সভাগৃহে আমার আর পোঁছানো হয়নি। কিন্তু পাশাপশি খুলে গিয়েছিল আরেকটি সরু রাস্তা। শুনলাম একজন পত্রিকা করতে চায়। আমাকে সেই যাদবপুর-দিদি বলল, তোর নিশ্চয় ভালো টাকা আছে? নিরুপায় আমি ছাপার হরফে নিজের নাম জ্বলজ্বল  করা কাল্পনিক সেই দৃশ্যপটে অপলক থেকে বললাম, আমার না, বাবার আছে। ঝটপট দিদি বলে উঠল, তবে কোনো অসুবিধা নেই। তোর লেখা এবারে ছাপবেই। তারপর গেলাম সেই পত্রিকা করার আস্পায়ারিং দিদির বাড়ি পথ একদম চিনি না মিনিট পাঁচেক লাগে হষ্টেল থেকে যেতে। ভাবলাম সব পাঠের আসরে আমি যেতে পারব আনন্দে মন ভরে গেল সেই কব্বে কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানে একটি বার নিজের নাম দেখার সুযোগ হয়েছিল, তাও আবার কুইজ-এর উত্তরদানকারীদের লিস্টে যেটা দাদা সমাধান করে দিয়ে নিজের হাতে পোস্ট করেছিল, যদিও নিজের নামটা জুড়তে ভোলেনি। এদিকে হষ্টেলের ফুড হ্যাবিটে আমি দিনে রাতে অন্নবিসর্জনকে হাতিয়ার করে ফেলি। ঝাঁঝালো পেঁয়াজের গন্ধ, মাংসের আনইউজ্যুয়াল ম ম করা বাতাস, লাগাতার মানিয়ে না নিতে পারা ও তাল তাল ঝোলা মাংসের স্তূপের সামনে দিয়ে নিয়মিত হেঁটে যাওয়া আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। আমি ভার্সিটির হষ্টেলের জন্য তখন একদম মরিয়া। ছেড়েছুড়ে পালাবার আয়োজনে মত্ত হলে অনেকে একদা নামী টেনিস প্লেয়ারে বাড়ি দেখিয়ে সেন্টি দেয়, এরা কি করে আছে? এতবড় লোকদের মাংসের গন্ধ লাগে না? এই পথে চলে কি কিরে? একজন তো একটি বাড়ি দেখিয়ে বলেই ফেলে, এইটা উত্তমকুমারের প্রাক্তন বাড়ি সে কি থাকত না? কোনও ব্যঙ্গ, কোনো প্রলোভনই আর আমাকে ধরে রাখতে পারছিল না। আমার সিদ্ধান্তে স্থির থেকে একরকম পালিযে আসি আমি বালিগঞ্জ সারকুলার রোডের ক্যাল হস্টেলে। তিমধ্যেই ঘটে যায় দুটি ঘটনা। যাদবপুর-দিদি তার বাড়ি গিয়ে ফেরে না। সেই সাহিত্য জগতের আলো দেখানোর সম্ভাবনাময় দিদির সঙ্গেও সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি জায়গায় নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ত্রিপুরার এক দিদিকে ম্যানেজ করে যাই পার্ক সার্কাসের  সেই বাড়িতে। দিদির বাড়ি থেকে কেউ জানায়, এ বাড়িতে সে আর আসে না। হতভম্ব আমি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে হষ্টেলে ফিরি। নতুন রূমমেট মল্লিকাদি বলতে থাকে, তুই কাদছস? জীবনে মেলা সুযোগ আসবে, এত সামান্য কারণে মেয়েলগের  কাঁনদা ঠিক না জেন্ডার বায়াসনেসে, শ্রেণী বৈষম্যে ঘরে বাইরে ফুঁসে ওঠা বিদ্রোহিনী   আমি নীরবে হজম করি কথা। লেখালেখি না করতে পারার যন্ত্রণা আর্শ্চযভাবে ভ্যানিস হয়ে যায় ইউনিয়ন রুমের পোষ্টার করে আর সোশ্যালিজমের একবজ্ঞা সাধক হয়ে। যতদূর মনে পড়ে, বাবা-মা এমনকি সিলেবাসের পড়াও বেকার লাগত। বিপ্লব কবে আনবো, এই তাগিদেই দিনে পর দিন কাটত। মার্ক্স, লেনিন ৩৩ কোটি দেবতার  চেয়ে বেশিবার পূজিত ও আরাধনার দাবী রাখে আমার কাছে।

আমার মতো ক্ষুদে রাজনৈতিক কর্মীর কাছে তখন লিটিল ম্যাগ কর্মীদের ত্যাগ ও টিকে থাকার লড়াইটা খুব সামান্য হয়ে যায়।
শেষমেশ নীড়ে ফেরার অনিবার্যতার মতো পড়া শেষে হষ্টেল ছাড়লাম, বিয়ে করে ফেললাম এক মেডিক্যাল পাঠরত ছাত্রকে। সেই ছাইচাপা আগুন একদিন সব ইচ্ছাকে জ্বালিয়ে দিয়ে প্রকট হয়ে ধরা দিল ২০১২ সালে ছাপল ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার ২০০ পাতার কবিতার বই। প্রকাশক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কেউ বলে ২০ হাজার টাকা নিয়ে আসুন, কেউ বলে মিরর ট্রেসিং করে পাঠান, আবার কেউ বলে পাতা কমান। ফর্মা কি জিনিস তাও বুঝলাম প্রাপাত করে। জেলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীহারুল ইসলামের সহযোগিতায় ও পরামর্শে পেলাম প্রকাশক। আমার পারিবারিক বন্ধু  ও আমার প্রাক্তন ঘনিষ্ট পুরুষ আমার বই কলকাতা থেকে নিয়ে আসা, প্রুফ কারেক্সন, বইমেলায় উদ্বোধনের যাবতীয় কাজ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করলেন। বই উদ্বোধন হলো জেলা বইমেলাতেই। করলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য, যাঁর  ‘মেমসাহেব পড়ে আমার সহপাঠীরা চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছিল বলে গল্প  করলেও আমি সেটা পারিনি। সব আক্ষেপের কবিতায় ছন্দ না জানা, সোজা ভাষায় বোকার মতো কবিতা লেখা, নিছক সংলাপ এমন একাধিক অভিযোগ তুড়ি মেরে আমার কবিতার বই মৃত জীবনএর রিভিউ বেরিয়ে গেল আজকাল পত্রিকায়। হজম করতে না পারা কলমপেষা প্রাক্তনীদের কাছে আমি ব্রাত্য থাকলাম ক্যাচ লাগিয়ে রিভিউ বার করার জন্য। জেলা বইমেলায় গোটা আটেক বই বিক্রীর পর হতোদ্যম না হয়ে আমি সাবডিভিশনের বইমেলাতেও বই রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কথা ছিল ২০টি বই নিয়ে যেতে হবে। বন্ধুর পরামর্শে ৫০টি নিলাম। আমার নিজের গাড়ি  সেদিন মেয়েকে নিয়ে তার স্কুল প্রোগ্রামে গেল। শেষে আমাকে সেই ৫০টি ভারী বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাস ধরে ছুটলাম ৬০ কিলোমিটার দূরের সেই  বইমেলায়। অনভ্যস্ত হাত প্রায় দেহ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, তবু উঠতেই হবে বাস্‌ তাই ছুট লাগালাম। বাস থেকে নেমে দেখি খুব জ্যাম কোনো রকমে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে ধাক্কা খেলাম থেমে থাকা এক লরির বেরিয়ে থাকা লোহার রডে। ঝর ঝর করে বৃষ্টির মতো রক্ত পড়তে লাগলো বুকে, গায়ে। স্কুলে ফোন করলাম, সেখানে যেন ডাক্তার ডাকা হয়। বইগুলি একটি নিরাপদ আশ্র্য়ে রেখে ইনজেকশান নিলাম। অপেক্ষা কখন ৪টে বাজবে, আমাকে ফোন করে ডাকা হবে মেলায় বই রাখার  জন্য। ডাক এলো না। ৪.৩০ মিনিটে স্কুল ছুটি হয়ে গেল একবুক মনখারাপ আর একমাথা মূর্খামির জন্য নিজেকে পিষতে পিষতে বাড়ি ফিরলাম। কবি সাহিত্যিকদের জগতটা বুঝি খুব ভঙ্গুর। এদের বিশ্বাস করা মহাপাতকের কাজ। কিন্তু সেই ব্যক্তির ওপর কোনো অভিমান ছিল না আমার। যে সুবাদে তার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই সম্পর্কটায় যে কোনো জোর নেই, তার দূরদৃষ্টিতে সে বুঝেছিল তাই সে ভেবেছিল আমার সঙ্গে এমনটা করা যেতেই পারে। তার জন্য কোথাও তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। বইমেলা শেষ হয়ে গেলে চুপিচুপি সেই ব্যাগ ফিরিয়ে নিতে আসি। বইগুলো বন্ধু, পরিবার ও আত্মীয়দের বিলি করে দিই। একদা প্রভাবশালী মিডিয়াব্যক্তিত্ব যার সুবাদে আমার লেখা যেটুকু জায়গা দখল করে অনেকটা জোর করেই এই দাবীকে নস্যাৎ করতেই  লেখা চলতেই থাকে।

তারপর আবার ২০১৪ সালে বেরিয়ে যায় আমার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ আমি ও ইবলিশ যে সম্পর্কের শুরু ধরে লেখার পথ ধরেছিলাম সেই মানুষটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে। সবটা তাই আমার একা্র কাঁধে এসে পড়ল। প্রকাশক খুঁজে নিলাম আমার পছন্দ মতো এবারে প্রকাশক শেষ মুহূর্তে এসে গোঁ ধরে বসে, তসলিমাকে বই উৎসর্গ করা যাবে না। নানা প্রবঞ্চনা, রকমারি বাতেলার পর আমি বদল করতে বাধ্য হই তসলিমার নাম। আসে বেগম রোকেয়া ও আমার মাতৃস্থানীয় আরেকজন  নারী। তারপর প্রকাশক কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে থাকার কারণে সে প্রেস থেকে বই নিয়ে যেতে পারবে না জানায়। নিরুপায় আমি ২০১৪ ৪ই ফেব্রুয়ারী সরাসরি ২০০ কপি বই নিয়ে কলকাতার শিলালিপি প্রেস থেকে বইমেলায় যাই প্রকাশক যে স্টলে  যেতে বলে সেখানে ভীষ কষ্টে হাঁটতে হাঁটতে দুই ব্যাগ বই নিয়ে মেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত গলদ্ঘর্ম হতে থাকি অবশেষে মেলে ঠিকানা। সেখানে গিয়ে বইগুলো রেখে নিজের হাতদুটি থেকে যেন হিমালয় নামিয়ে  ফেলি। একটুখানি বসে ডাকি প্রকাশককে। লাগাতার তার স্যুইচ অফ-এর একনাগাড়ে ঘোষণায় নাকাল হতে থাকে কান, মাথা। সামনে বসে থাকা স্টলের মানুষটি বিরক্তিভরে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, নাম্বার মিলিয়ে দেখেছি কিনা। এই স্টলটি আমার সেই প্রকাশকেরই নয়। কোনোরকমে এক কোণায় আমার বইগুলি ঢিপ করে রেখে দিই। বলি, আসলেই সরিয়ে ফেলবো। তারপর প্রাক্তন এক আই পি এস সেই স্টলে প্রবেশ করলেন বিনা বাক্যে বুঝে ফেললাম, স্টলের মালিক তিনিই। আমার এইভাবে বসে থাকায় তিনি বারবার ল্যাপটপ থেকে মুখ উঁচিয়ে আমাকে দেখতে থাকলেন। এবারে ফোন বেজে উঠল আমার। প্রকাশক বলল, লিটিল ম্যাগের টেবিলে আসুন। তার আগেই ওই স্টল থেকে জানিয়ে  দেওয়া হয়, আমার প্রকাশক ওই সংস্থার একজন কর্মী। তার নিজের কোনও ষ্টল নেই, টেবিল আছে মাত্র। কোথাও কী যেন ভাঙতে ভাঙতে ঝুলে রইল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গিয়ে হাজির হলাম। অবশেষে রেখে এলাম ১০০টি বই। বলেছিল, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবে বই উদ্বোধন হবে বিরাট লোকদের উপস্থিতিতে। মিনিটে মিনিটে নাম আনাউন্স হবে। লাগবে ৫০০০ টাকা। সেখানে গিয়ে দেখলাম অনুষ্ঠানটাই আলাদা,  তবে ছবি উঠল বিশিষ্ট সমাজসেবীর সঙ্গে। ছবি তুলে রাখলাম। কাগজে বেরলো দুটি লাইন। কিন্তু খুব সততার সঙ্গে আমার প্রকাশক আর চাইলো না ৫০০০ টাকা। তার কাছে আজও রয়ে গেছে আমার ৮০টি বই প্রশ্ন করলেই বলে, বাড়িতে আছে বইগুলি, দিয়ে দেবে খুব শীঘ্রই ওই অনাথ বইগুলি কোনো ঘুপচিতে পচে যাচ্ছে  ভাবলে নিজের অভিভাবকত্বের প্রতি অনীহা আসে। এদের উপযুক্ত সুরক্ষা করতে পারলাম না, অকার ভুমিষ্ট হলো বেওয়ারিশ ফুটপাতিদের মতো 



পরিচিত মানুষের কাছে প্রতারিত হলে মানুষের বুঝি ভুলতে কষ্ট হয় না। আমি সব ভুলে গিয়েছি সহজেই জীবনে যেস হিংস্র আর হেনপেকড জন্তু জানোয়ার দেখেছি  তাদের চেয়ে আমি মানুষদের ভয়, ঘেন্না বেশি করি। রবীন্দ্রনাথের সেই কথা, মানুষের পর বিশ্বাস হারানো পাপ, এই লাইনটাকে আমি লাল কালি দিয়ে বহুবার কেটেছি জীবনে। কিন্তু বাজারের সব স্তরেই আমি নিজেকে খুব বোকা ব্যবসায়ীর স্থানে পেয়েছি। হিসেবের খেলায় আমি বরাবর খরচের খাতায় নিজের নাম তুলেছি। আমার আমি আর আমার লেখা দুটি বই‍ ছাড়া জমার খাতা শূন্য রয়ে গেছে।  

   


                              

২টি মন্তব্য: