বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

শিবাংশু দে

সুমনসিম্ফনি এবং




----------------------------------------  
গান ভালো লাগার যে আবেগ বা মনন, তা মগজে গজাল মেরে আনা যায় না। সে তখনই সুখদা যখন সে স্বয়মাগতা 
----------------------------------------


যেমন আমি সুমনকে শুধু তাঁর নিজস্ব গানের মানদন্ডেই মূল্যায়ণ করার পক্ষে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা হিমাংশু দত্তের গান তাঁর শখের ব্যাপার, সেখানে তাঁর কিছু প্রমাণ করার নেই। তাঁর হয়ে ওঠা গান বইটি নিশ্চয় অনেকেরই পড়া আছে। এই হয়ে  ওঠা ব্যাপারটি  আমার মনে হয় শুধু তাঁর নিজের গানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তিনি জানিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিছু তালিম তিনিও নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ কৈশোর পেরিয়ে কঠিন হতে থাকে এবং নমনীয়তা হারায়। আমাদের চেনা গানে সঠিক সুরসংস্থান করতে গেলে কণ্ঠের নমনীয়তা অত্যন্ত জরুরি। তাই তিনি নিজের গানের মাঠটিই পাল্টে ফেলেন এবং গান পরিবেশনের সময় মূলত বিদেশি ছাঁচের স্ট্যাকাটো ধরনটি গ্রহণ করেন। এই পরীক্ষায় যে তিনি বেশ সফল হনতার সাক্ষী ইতিহাস।  
----------------------------------------
তিরানব্বই সালে একটি অনুষ্ঠানের সূত্রে তিনি আমাদের শহরে এসেছিলেন। তখন তাঁর সূর্য মধ্যগগন যাত্রী। একটা সারা দিন তাঁর সঙ্গে নানা আড্ডা, আলোচনায় কেটেছিলতখন বলেছিলেন তিনি একজন একটি বিশেষ সময়কালের গায়ক। হয়তো পাঁচ বছর পরেই তাঁর গান আর কেউ শুনবে না। আমরা তো চমৎকৃত। তখন তাঁকে আমরা সলিল চৌধুরির পর বাংলা গানের মসিহা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছি, তাঁর মুখে এমন কথা? কিন্তু তিনি নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে যে কতটা ওয়াকিফ ছিলেন, তা এভাবেই প্রমাণ হয়ে যায়।  
----------------------------------------


শিল্পী হিসেবে নিজের এই মূল্যায়ণ তিনি আত্মমর্যাদার অঙ্গ হিসেবেই করেছিলেন হয়তো। কিন্তু প্রায় বিশ বছর কেটে যাবার পরেও তাঁর গান মানুষ শুনছে আর এই সব গান থেকে অন্তত পঞ্চাশ ষাটটি গান বাংলা গানের মাইল ফলক হিসেবে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকবে।
----------------------------------------


নচিকেতার সঙ্গে তাঁর গানের তুলমামূলক আলোচনা নিয়ে বহু শ্রোতা আগ্রহী হয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নচিকেতার সুর যোজনার বৈচিত্র্য নিয়ে আমার মতো ইতর লোকও অনেক কথা লিখতে পারে। অকৃপণভাবে ভাংড়া থেকে গজল, রক থেকে রেগি, ভাটিয়ালি থেকে গোয়ান সুর, হির থেকে ব্লুজ, বৈঠকি থেকে বাউল, সবই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর গানে। কিন্তু তার মধ্যে কটা শেষ পর্যন্ত শিল্পমূল্য অর্জন করে উঠতে পেরেছে, সেটাই জরুরি। সাফল্য একটি ঘটনা তো  বটেই। কিন্তু এক সময় ক্যয়সে বনি সিলোরি কে বিনা চটনি, বাজারের ভাষায় ছপ্পর ফাড়কে হিট হয়েছিলঅতএব, শেষ কথা কে বলবে
----------------------------------------


আমাদের ছোটবেলায় দেখতুম সত্যম্বর অপেরার একটি আসরে যত উচ্ছ্বসিত দর্শকের ভিড় থাকে, বহুরূপীর সারা বছরে তত দর্শক জোটে না। তাই এভাবে কে সফল আর কে বিফল, তা  বিচার করতে যাওয়াটা মূঢ়তা।

দিনের শেষে ...ভালো আমার লেগেছে যে, রইলো সেই কথাই... 
----------------------------------------


এখানে একটা গান শুনি আমরা। গানটি সম্পর্কে সুমনের কিছু স্মৃতিচারণ রয়েছে, সেটাও পড়ি। আর পড়ি এর লিরিকটি। কেন সুমনকে নিয়ে লিখতে প্রয়াস পাই, তার কিছুটা প্রমাণ এখান থেকে সংগ্রহ হয়ে যাবে।
----------------------------------------


সিলভার স্প্রিং এর বাসা। বোধহয় ১৯৮৩ সালের গরমকাল। রাতের ডিউটি  সেরে বাসায় ফিরেছি। বসার ঘরটা নানান বাজনা আর যন্ত্রে ঠাসা। এর পাশে একটা ইলেকট্রিক পিয়ানো। সদ্য কিনেছি। নতুন প্রেমের মতো সারাদিন হাতছানি দিয়েছে পিয়ানোটা। ঘরে ঢুকেই আফিসের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সটান গিয়ে বসলাম পিয়ানোয়। ঘরের আলো জ্বালাইনি। মস্ত কাচের জানলা দিয়ে বাইরের আলো যেটুকু ঢুকছে তাতে ঘরটা আবছায়া।

বাইরের আলো মানে রাস্তার স্থিমিত আলো। পিয়ানোয় একটা কর্ড বাজিয়ে জানলা দিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল দূরে একটা তারা। মুহূর্তের মধ্যে কি যে হয়ে গেল। এরকম আর কখনো হয়নি। পিয়ানো বাজিয়ে, ধীরে ধীরে আস্ত একটা গান বেঁধে ফেললাম - কথায় সুরে মিলিয়ে। কথাটা লিখতে হল না। লাইনগুলো গাইতে গাইতে আপনিই তৈরি হয়ে গেল সুর সমেত।

আমার আর কোন গান আমি এভাবে বাঁধিনি। এর আগে বা পরে কখনও গোটা একটা গান কথা বা সুর একসঙ্গে বেরিয়ে আসেনি আমার ভিতর থেকে। কি করে যে এটা সম্ভব হয়েছিল আমি আজও জানি না। এটুকুই শুধু জানি যে গানটা বাঁধার সময় বিশেষ ভাবতে হয়নি আমাকে” (সুমনের গান সুমনের ভাষ্য)

সারারাত জ্বলেছে নিবিড়
ধূসর নীলাভ এক তারা
তারই কিছু রং নাও তুমি

শহরে জোনাকি জ্বলে না - নয়তো
কুড়োতাম সে আগুন নীল - হয়তো,
যা কিছু নেই
নাই বা হল সব পাওয়া
না পাওয়ার রং নাও তুমি।

বড় বেরঙ্গিন আজকাল কাছাকাছি
কোন রং পাই না, তাই
দিতে পারি না কিছু
কিছুই রাঙানো হল না - নয়তো
আগামীর রঙে ছোপাতাম - হয়তো
এই মলিন
আর এ-ধূসর পথ চাওয়া
এ চাওয়ার রং নাও তুমি

----------------------------------------


গান ভালো লাগা না লাগার বহু মানদন্ড হতে পারে। অত্যন্ত সাবজেক্টিভ ব্যাপার। তবে সুমনের মতো অতিস্বল্প প্রকৃত সৃষ্টিশীল সময়কালের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়া  একজন শিল্পীর (বড়জোর সাত বছর) দ্বারা  বাংলা গানের প্রচ্ছদ পাল্টে দেবার ক্ষমতা আমি রামপ্রসাদ সেনের আমল থেকেও যদি ধরি, কাউকে পাইনি। কেন পাইনি, আমার মতো করে যদি তার বিশ্লেষণ করতে বসি তবে হয়তো একটা আলাদা বই লাগবে। ওঁর লিরিক, যন্ত্রানুসঙ্গ, সুরের চলন, মাত্রাজ্ঞান, গভীরতা এবং সর্বোপরি উপস্থাপনা, অর্থাৎ শুধু কারিগরির দিকটুকু নয়, প্রসাদগুণেও ওঁর  সমসাময়িক  কেন, আগে পরের খুব কম শিল্পীই পাল্লা দিতে পারেন। দুনিয়ার সব কিছু নিয়ে চটজলদি মন্তব্য করার ক্রমান্বয় বদ অভ্যেসটুকু উপেক্ষা করে যদি শুধু ওঁর গান নিয়েই ভাবা যায়, তবে সেটাই শ্রেয়তর।   
----------------------------------------


আসলে কী হয় ব্যাপারটা, এই গান নিয়ে লিখতে গেলে যেটা সতত মনে পড়ে, পৃথিবীর সর্বত্র তো কোটি কোটি রকম গান তৈরি হয়, কিন্তু যা টিকে থাকে তা শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল। যন্ত্রসঙ্গীতের কথা বাদ দিচ্ছি, কারণ এই আলোচনায় তার প্রসঙ্গটি গৌণ। তার উল্লেখ থাকছে শুধু সহায়ক সুরস্রোত হিসেবে। কন্ঠসঙ্গীতের  ব্যাপারে সব চেয়ে প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে গলার সঠিক সুরসংস্থান। যে পর্দাটি ধরতে চাইছি সেটিকে ঠিকঠাক গলা থেকে বার করা। বাংলায় যাকে বলে ভয়েস ট্রেনিং। পাতিয়ালা ঘরের অজয়বাবুর কথা ভাবা যায়। ওঁদের ঘরানার সব থেকে জরুরি তালিম হচ্ছে এইটা। কিন্তু এই বিষয়ে বেশি মনোসংযোগ করতে গিয়ে অনেক সময় ওঁরা গানের স্পিরিটটাকে দ্বিতীয় সারিতে রাখেন, এর ফলে গোল লাইনের কাছে এসে কিরানা পার্টি মেরে বেরিয়ে যান।  সবাই তো আর বড়ে গুলাম নন! আর বাংলা ব্যান্ড কোম্পানি প্রায় পুরোটাই  ‘স্পিরিট, সুরের তোয়াক্কা কেউ বিশেষ করেন না। কয়েকজন জনপ্রিয় ব্যান্ডগায়ককে যখন খালি গলায় সামনে বসে গান গাইতে শুনেছি তখন এই সীমাবদ্ধতাটিকে অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠতে দেখেছি। ইক্যুয়ালাইজার, মিক্সার, বাসকন্ট্রোল, সর্বোপরি ধমাধম ধমাধম কৃষ্টির ঢাক ছাপিয়ে অধম শ্রোতাদের কান পর্যন্ত যা পৌঁছোয়, তা নিয়ে বিশেষ আশাবাদী হওয়া যায় না। 
----------------------------------------


এত কথা এই জন্য লিখছি যে গত শতকের শেষ থেকে বাংলা গানের সব থেকে জনপ্রিয় শিল্পীদের মধ্যে স্বল্প দুয়েকজন ছাড়া বাকিরা সুরসংস্থানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে   পিছিয়ে থাকেন। মোদ্দা কথা গলায় সঠিক সুর না থাকলে কিছুদিনের জন্য বাজার কাঁপানো যায় কিন্তু শ্রোতাকে মজানো যায় না। যেমন ধরা যেতে পারে অঞ্জন দত্তের গান। আমার অভ্যেস অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে ভালো না লাগলেও যখন কোনও গায়ক জনপ্রিয় হন, তখন তাঁর গান আমি বার বার শুনি, এই প্রিয়ত্ব  অর্জন করার কারণটাকে খুঁজতে। কিন্তু এখনও অঞ্জনের কোনও চার মিনিটের গানও আমি মনোসংযোগ দিয়ে শুনতে পারিনি। বেসিক সুরসংস্থান এত মলিন যে চমকানো লিরিক দিয়ে তার গতি করা যায় না। 
----------------------------------------


শচীন কত্তা বলতেন, যে সুরটা রিক্সাওয়ালাও গাইতে পারবে তাই জনপ্রিয় হবে।  কিন্তু নিজে গানটা গাওয়াতেন রফি, কিশোর, মান্না, লতা, আশাকে দিয়ে, যাঁরা সুরসংস্থানের ঈশ্বর কোটীর মধ্যে পড়েন। এ ব্যাপারে কোনও আপোস নয়। তাই জনপ্রিয় গান গাইতে গিয়ে যদি আমি জনতার গায়নক্ষমতার অনুকর করি তবে  ‘প্রিয়তা হয়তো আসে, গান আসে না। অঞ্জনের ক্ষমতা বহুমুখী, কিন্তু গায়ক হিসেবে...??
----------------------------------------


সংখ্যার জনপ্রিয়তার দৌড়ে নচিকেতা সুমনের থেকে হয়তো বেশ এগিয়ে। কিন্তু লিরিকের ক্ষেত্রে নচিকেতা অতিনাটকীয়তাকে যেভাবে প্রশ্রয় দেন তাতে তাঁর গান শুধু কানের কাছে নয়, চোখের কাছেও প্রগাঢ় আবেদন নিয়ে আসে। এটা গানের দুর্বলতা। ঐ মিউজিক ভিডিও টাইপ আর কী। ওঁর গানের মধ্যে মুম্বাই এলিমেন্ট   অনেক বেশি, তাই বেশি জনপ্রিয়। আমরা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে যেটাকে বেণীমাধব ইফেক্ট বলে থাকি। কবি জয়ের নেমোসিস যেমন বেণীমাধব’, তেমনিই  নচিকেতার নীলাঞ্জনা বা জগৎটা জুড়ে সোনাগাছি জাতীয় প্রত্যয়।    আর আমি নিজে জাত বিহারি হয়েও বলি, নচিকেতার গানে বাংলা উচ্চারণ    মুহম্মদ রফির থেকেও খারাপ। গত বছর বিশেক ধরে দেখি কলকাতার মূলস্রোতের নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যে এই ভেজাল বাংলা উচ্চারণ বেশ আদর পায়। এটাকে কি মুম্বাই হ্যাংওভার বলা যায়!  জানি না। নচিকেতার স্বঘোষিত গুরু মদনমোহন যখন পঞ্জাবি গান গাইতেন তখন সেটা কিন্তু নিঁখুত পঞ্জাবি হতো। যদিও মদনমোহন বাল্যকাল থেকে দীর্ঘদিনের বিদেশপ্রবাসী পঞ্জাবি ছিলেন। 
----------------------------------------


শ্রোতা হিসেবে এত দীর্ঘদিন ধরে কোনও ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক, বৌধিক সীমারেখার কেয়ার না করে মন দিয়ে গান শুনে আসছি। সহস্র কেন লক্ষাধিক হবে হয়তো। এখন বুঝি গান নিয়ে বিতর্ক করাটা পণ্ডশ্রম। মন চায় না।  গান এখন একটা আশ্রয়শুধু অবসর বিনোদন নয়। এর মানে এই নয় যে আমি গান বেশি  বুঝতে শিখেছি, শুধু নিজের ভালো লাগা না লাগাটা সবিনয়ে জানানোর একটা নিমবিশ্বাস তৈরি হয়েছে কোথাও।
----------------------------------------


প্রসঙ্গ যখন উঠলো-ই, তখন একটু উল্লেখ থাক।
দুটি গান বেছে নিই। নচিকেতার জাগে জাগে রাত জাগে এবং সুমনের  সূর্যোদয়ের রাগে গান ধরে ভীমসেন যোশিএই দুটো গানেরই সুরের স্ট্রাকচার  এক, সুরও প্রায় এক, যন্ত্রানুষঙ্গও (সেই সরোদ আর কীবোর্ড)। যাঁরা দুটো গানই মন দিয়ে শুনেছেন (ব্যক্তিগতভাবে আমি একাসনে বসে অন্তত দশবার পর পর গান দুটি শুনেছি, পার্থক্যটুকু বুঝতে), তাঁরা যদি খুব দীক্ষিত শ্রোতাও না হন, তবু সুমন কোথায় জিতে যান সেটা বলার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয় না।
----------------------------------------


আমি আগেও এই ব্যাপারটি নিয়ে বলেছি এখানে। সুমন একটা মানচিত্র তৈরি করছেন এই গানে। ভোরসকালের সুরে যত রাগ রয়েছে, সবার মধ্যে বেশ কয়েকটি সমান্তরাল পর্দার ফ্রেজ রয়েছে। রাগের চরিত্র অনুযায়ী তারা শুধু জায়গা বদলায়, কিন্তু আমেজটা একই রকম থাকে। এই রকম একটা সুরকে কেন্দ্র করে তিনি তার একদিকে রাখছেন ভীমসেনকে অন্যদিকে রাগ জোগিয়া। তিনি শুধু ছুঁয়ে যাচ্ছেন মেরু দুটিকে। মনে হবে, ভীমসেনের বকলমে কোমল রেখাবের রূপ নিয়ে তিনি উতলা হয়ে পড়ছেন। কিন্তু খেলাটা অন্য জায়গায়। তিনি জানেন, শ্রোতা কোমল রেখাবের শাস্ত্রীয় বা অন্তর্লীন জাদু নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত নয়। তার জন্য জোগিয়ার হাত ধরে প্রবেশ করছেন তৃতীয় মেরু, নজরুল। এবার শ্রোতারা  বালিকাটির ফুল ছড়ানোর খেলায় অজান্তেই গানটির মানচিত্রের চারটি কোণ ভীমসেন, রাগ জোগিয়া, নজরুল আর সুমন, স্পর্শ করে ফেলছেন। একে কি ভুলিয়ে শটকে শিখিয়ে দেওয়া বলা যেতে পারে! যে কোনও কম্পোজারের এটাই চূড়ান্ত স্বপ্ন।
----------------------------------------


অপরপক্ষে নচিকেতা তাঁর গানটি শুরু করার সময় আরোহটি হামিং করেন। যন্ত্রীকে প্রিলিউড বাজাবার অবসর দেন এবং প্রথম তিনটি শব্দ সুরে বলেন। ইতোমধ্যে শ্রোতার প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে ভোরের সুরে নিজেকে ধুয়ে নেবে। সমস্ত  ভোরের রাগে মূলত কোমল বা অন্য রেখাবের যে জাদু শ্রোতাকে তৎক্ষণাৎ মুগ্ধ করে, যদি তার হাল হকিকৎ শ্রোতার জানা নাও থাকে, তবু সে এটুকু অনুভব করে, কুছ বাত বন রহি হ্যাঁয়। এই রকম একটা মোক্ষম সময়ে তিনি বলে ওঠেন  তাঁর আলাপ করার ইচ্ছে  জাগছে, শ্রোতারা কী অনুমতি দেবেন? তিনি যে সুরের  শাস্ত্রীয় তাৎপর্য সম্বন্ধে খুব উত্তম রূপে ওয়াকিফ, সেটা জানিয়ে দেন। সরগম,  পাল্টা, তানকারি গান তৈরির মশলা। সেটা পরিবেশনযোগ্য ভোজন নয়। নচিকেতা একটা শুদ্ধ বাংলা কাব্যসঙ্গীত শোনাতে গিয়ে তাঁর ছাত্রজীবনে মশলাবাটার  কুশলতার কথা শ্রোতার সঙ্গে বিনিময় করতে চান, কিছু অর্ধশিক্ষিত শ্রোতা বেশ হই হই করে স্বাগতও জানায়। কিন্তু গানটির অপমৃত্যু ঘটে।
----------------------------------------


কণ্ঠ বা গায়নের তৈয়ারি খুব জরুরি শর্ত, কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে গানটি শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছোলো। নচিকেতা মধ্য ও তার সপ্তকে বেশি স্বচ্ছন্দ, সেটা তাঁর প্রাথমিকভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার সূত্রে এসেছে। কিন্তু লিরিকের কথা যদি একেবারে ছেড়েও দিই, তবু কণ্ঠসম্পদকে যথাযথ সংযম ও পরিণতমনস্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারার প্রশ্নে নচিকেতা সুমনের থেকে পিছিয়ে থাকেন।

সুমনের গলায় সুরের অনর্গলতা নিয়ে যদি সংশয় থাকে তবে বলি, তাঁর কণ্ঠ মূলত ব্যারিটোন। এই ধরনের কণ্ঠে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগরূপ ফুটিয়ে তুলতে যে মোচড় আনতে হয়, তা সর্বদা আসে না। উঁচু স্কেলে গেলে তীক্ষ্ণতা আসবে, কিন্তু মাধুর্যটা আসবে না। তাই সুমন সে প্রয়াস করেন না। তাঁর যেটা সম্পদ, মন্দ্র সপ্তকে কণ্ঠকে বশে রেখে খেলানোর কৌশল, সেটিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করেন। নিজস্ব দুর্বলতাটি তিনি গায়নের এক্স ফ্যাক্টর হিসেবে প্রয়োগ করে ফেলতে অত্যন্ত দক্ষ। যেমনটি করতেন জর্জদা।
----------------------------------------


বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গায়নপদ্ধতির স্কিলসেট দিয়ে বাংলা গান বিচার একটা অর্বাচীন লক্ষণ। যেমন অনেকে এখন রবিবাবুর গানকেও মূল রাগের সুরসংস্থান অনুযায়ী ভাগ করে গাইতে চান বা পৃথকভাবে তার বর্গীকর করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, গানটি হয়ে উঠছে কি না তা নিয়ে চিন্তা করা অথবা তার সুরের কাঠামো কোন রাগের আরোহ-অবরোহের সঙ্গে মিলছে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। রবিবাবুর পর বাংলা কাব্যগীতিতে লিরিকের সম্মান সুরের উপরে চলে গেছে। কিন্তু গান যেহেতু গাওয়া হয়, আবৃত্তি করা হয় না, তাই সুরের প্রতি তন্নিষ্ঠ না থাকলে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি দাঁড়াবে না। এ একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও সংযমের খেলা। তাই বাংলা গানটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় ভাবে  নিকটতম একটি রাগের আরোহ-অবরোহের বিস্তার করতে থাকি তবে তা বিড়ম্বনার সূচনা করে। যদি আমাকে সেই রাগটিকে জড়িয়ে ধরতে হয়, তবে তার জন্য তো অঢেল মহীরূহদের জাগ্রত সৃষ্টিগুলি আমার শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। নচিকেতা যখন শাস্ত্রীয় বা অন্তত উপ-শাস্ত্রীয় গান করবেন, তখন তিনি আলাপকারিতায় স্বাগত, কিন্তু কাব্যগীতির কাঠামোয় তার আতিশয্য অতিরিক্ত বোধ হয়। কবি বলছেন, যেন আমার গানের শেষে, থামতে পারি সমে এসে...।    এই সমে থামতে পারার ক্ষমতাই সব সৃষ্টির সাফল্যের প্রথম ও শেষ কথা। এটা নচিকেতা পারেন না, সুমন পারেন।
----------------------------------------


বাংলাগানে বড় মাপের শিল্পীদের আকালের দিনে নচিকেতার লোকপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। তাঁর সাঙ্গীতিক কৌশলের মধ্যে খামতি বাকিদের থেকে অনেক কম। তাই তাঁর কাছে শ্রোতার প্রত্যাশা বেশি। পরবর্তী প্রজন্মের শ্রোতাদের রুচি তৈরি করতে তাঁর দায়িত্বও তাই অন্যদের থেকে বেশি। কোনও জীবন্ত সংস্কৃতির জন্য সুরের স্রোত মানবশরীরে রক্তস্রোতের মতো জরুরি। তাই তার প্রতি সনিষ্ঠ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। গান শুধু জনমনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, তা মানুষের বৌদ্ধিক অস্তিত্বের  অঙ্গ। এখানেই সুমনের জিত, এখানেই নচিকেতা প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ম্লান হয়ে যান।
----------------------------------------


দিলীপকুমার রায়ের গান সম্বন্ধে বলা হয়, নিজস্ব গায়নভঙ্গিই তাঁর গানের প্রচারের প্রধান প্রতিবন্ধক বাংলাগানের যে সমস্ত কম্পোজার নিজেরা গান পরিবেশন করার চাইতে অন্য শিল্পীদের কণ্ঠে নিজস্ব সৃষ্টিকে রূপায়িত করতে চেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গীত অনেক বেশি প্রচারিত হতে দেখা গেছে কারণ বিভিন্ন শিল্পীর বহুমুখী গায়নভঙ্গি, কণ্ঠসম্পদ পরিবেশনা একই গানকে নব নব রূপে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিয়েছে ফলতঃ সে সব গান এক প্রজন্মের সীমায় বাঁধা থেকে যায়নি দিলীপকুমার ছিলেন ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক গায়নে বিশ্বাসী তাঁর গান, তিনি ছাড়া আর কেউ তাঁর থেকে ভালোভাবে গাইতে পারবে না কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জন্য তাঁর যশোবৃদ্ধি হয়, কিন্তু কম্পোজার হিসেবে তিনি ফুরিয়ে যান

সুমনের গানের সঙ্গেও ভবিষ্যতে এই বিড়ম্বনাটি ঘটতে পারে তাঁর গান, নিজস্ব ছাত্রছাত্রী ছাড়াও ইদানিং অনেকে গাইবার প্রয়াস পাচ্ছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের পরিবেশন থেকে সেই প্রতিশ্রুতি অমিল, যা সুমনের গানকে একটি প্রজন্মের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে ইতর শ্রোতা হিসেবে সুমনের কাছ থেকে আমরা বাংলাগানে যে আশ্রয় পেয়ে এসেছি, ভাবতেই পারি না তা কখনও অতীত হয়ে যেতে পারে

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানা
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা
কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙ্গে যাবার আগে
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শেকল রে
কবার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভাল করে
কত হাজার বারের পর আকাশ দেখা যাবে
কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে






৭টি মন্তব্য:

  1. মতভেদ রয়েই গেলো। কোথাও মহীনের ঘোড়াগুলি বা নগর ফিলোমেলের উল্লেখ পেলাম না। এরা সুমনের বহু বহু আগেই বাংলা কাব্যগীতিকে অন্য পরিসরে নিয়ে গেছেন।

    উত্তরমুছুন
  2. dhus,

    এই প্রসঙ্গটা নতুন নয়, বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে বারবার আসে। এটা নিয়েও আমার অন্যত্র অনেক আলোচনা আছে। মহীন বা ফিলোমেল, বাংলা গানে 'পরিসর নিশ্চয় সৃষ্টি করেছেন, তা নিয়ে কেউ অন্যমত হবেন না। কিন্তু শ্রোতার পরিধি যদি একটা মাত্রা হয়, তবে তাঁরা এই সব শিল্পীর থেকে পিছিয়ে আছেন। মোকাম কলকাতা বা নিকট মফস্সলের সীমানা পেরিয়ে তাঁদের সৃষ্টি এতোদিনেও খুব একটা পৌঁছোতে পারেনি। লোকপ্রিয়তা মানে পুরোটাই নেতিবাচী লক্ষণ নয়। তাঁদের লিরিক, অ্যারেঞ্জমেন্ট, বৈচিত্র্য অবশ্যই মূলস্রোতের গানের বাইরে একটা সমান্তরাল ধারা সৃষ্টি করেছিলো। তাঁরা কালের হিসেবে সুমনের 'আগে' শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু কেন তাঁরা সুমনের মাপের লোকপ্রিয়তা পাননি। এটাও ভেবে দেখার বিষয়।

    সম্ভব হলে আমি এ নিয়েও পরে আলোচনা করবো এখানে।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. আলোচনার অপেক্ষায় থাকলাম। শুরুর জন্য কিছু ভাবনা থাকলো।
    সময় - মহীন বা নফি ঠিক সময় পায় নি। তখন (১৯৭৫ - ৮০) বাংলা কাব্যগীতির ভুবন মান্না, হেমন্ত, শ্যামল, সুধীন, নচিকেতা ঘোষ-ময়। তখন অমন আধুনিক কাব্যগুণ সম্পন্ন বাণী ও সুরের স্ট্রাকচারে সফট রকধর্মী গান পাত পায় নি। উল্লেখ্য তখন সুমনের বহু গানই (নাগরিকের অ্যালবাম অন্য কথা অন্য গান ১ ও ২) পাত পায় নি। ১৯৮০ - ৯০ এ সময়টা বাংলা কাব্যগীতির অন্ধকার যুগ বললে কম বলা হয়। এরপর সুমনের তোমাকে চাই ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। আমার ধারনা, সে সময় যদি এইচ এম ভি অন্ততঃ নফি আবার বাজারে ছাড়ত বা মহীনেরা যদি তাদের তিনটে ইপির ক্যাসেট করার কথা ভাবতেন তাহলে সেগুলোও জনপ্রিয় হতো।
    আর একটা কারন - মিডিয়া। যে কোন কারনেই হোক ৯০এর একলা সুমন মিডিয়ার সমর্থন পেয়েছেন। নফি নিয়ে আজকালে একটা প্রশংসাসূচক লেখা ছাড়া বাকি মিডিয়া নীরব। মহীন তো প্রচুর অহেতুক গালমন্দ খেয়েছে মূলস্রোতের মিডিয়ায়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. বেরিয়েছিল তো। ৯২-৯৬ ঐ সময় ইন্দ্রনীল-ইন্দ্রজিত আবার নগর ফিলোমেলের পুরনো অ্যালবাম বার করেন। আগের তুলনায় কিছু বিক্রি হলেও মোটেই জনপ্রিয় হয়নি। ৯৫-৯৬ তে প্রকাশ হয় মহীনের বছর কুড়ি অ্যালবাম। যার মধ্যে অবশ্য মহীনের নিজেদের একটা গানও ছিল না। কিন্তু পৃথিবী ছাড়া বাকি কোনো গানই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়নি। মহীনের গানগুলি এখনো আর্বান বাঙালি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কেউ শোনে না। সত্যি কথা বলতে ৯০'র দশকের গানগুলির মধ্যে নচিকেতা বা স্বপন বসুর গান যেভাবে গ্রাম বাংলায় জনপ্রিয় হয়েছিল, সুমনও ততো জনপ্রিয় হননি। অঞ্জন দত্তও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ওই একই সময়কালে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের 'যেতে হবে', মৌসুমী ভৌমিকের 'তুমিও চিল হও' যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। ২০০০-২০০৫ সময়ে ভূমি শহরে এবং গ্রামে সমান জনপ্রিয় ছিল তাদের গানে লোকগীতির প্রভাবের জন্য। লোপামুদ্রা মিত্রও এই সময় বিখ্যাত হন কবিতা থেকে গান করে।

      মুছুন
  5. জাগে জাগে রাত - গানটি কিন্তু সুমনের লেখা ও সুর করা। নচিকেতা কোনো এক লাইভ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন।

    উত্তরমুছুন
  6. অবশ্যই গানটি সুমনের কম্পোজিশন। কিন্তু দুজনের গান শুনলে তবে তফাতটা বোঝা যাবে। এই লেখার উদ্দেশ্য এই পার্থক্যটি চিহ্নিত করা।

    সুমন http://gaana.com/song/jage-jage-raat-2

    নচিকেতা https://www.youtube.com/watch?v=ItyGbyE_AEY

    উত্তরমুছুন