নির্যাতিতা ও ধর্ষক
অবশেষে পাশ হলো জুভেনাইল জাসটিস আক্ট। ভারতবর্ষের এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই আইনি বদল। বিশ্বের দরবারে নারী সম্মানের প্রতীক, পরিবারতন্ত্রের পিতা বলে সমীহ পাওয়া অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ নিজের মুখ পুড়িয়ে ফেলে ১৬ই ডিসেম্বর রাত্রি ৯-৫৪ মিনিটে ২৩ বছরের এক প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীর তার বন্ধুর সামনে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর মৃত্যু বরণ করলে। অভিযুক্তরা হলো রাম সিং, মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা, পাবন সিং, অক্ষয় ঠাকুর আর সতেরো বছর ছয় মাসের আফরোজ। ২০১৫ সালে ২১ বছর বয়সে সে মুক্তি পেল। তারপর পরিবর্তন এলো আইনে। ভাবছি কালোব্যাচ পরব নাকি অনশন করব নাকি পথে নেমে চিৎকার করব ১৭ বছর বয়সী নাবালক ধর্ষকের ২১ বছরের যুবক হয়ে ওঠার গর্বিত ও সুসংরক্ষিত ঐতিহাসিক মুক্তির দিনে। আমাদের দেশের সংবিধানমান্য কর্তাদের কী বিষম দায়! এক নাবালক শয়তান একটি মেয়ের শরীর থেকে ছিঁড়েখুঁড়ে বার করে দেহাংশ, তবু নাবালকত্বের ঊর্ধসীমা সংশোধনের বিল পাশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। স্বাধীনতার এতদিন পরেও নাবালক কাকে বলে, তা স্থিরিকৃত হয় না। ঘটনার অপেক্ষা হয়তো আরো। জ্যোতি সিং পান্ডের মায়ের জন্য গর্ব হয়। মা এমন সাহসী হোক সব মেয়ের। অত্যাচারিত সন্তানের হাত ধরে দাবী উঠুক ধর্ষকের বিরুদ্ধে সাজার। ধর্ষকের বাঁচার অধিকার আছে আমি বিশ্বাস করি, কেননা সে আমাদেরই একজন, কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়ে গেলে তার পুনর্জন্ম অসম্ভব। পাশবিকতাকে সুযোগ দিলে তার রূপান্তর খুবই কষ্টকল্পিত একটি ভাবনা। ইভিলস-এর মরে যাওয়ার ঘটনা সমাজে, বাইরে বিরল। যে কোনো ফর্মে তার ফিনিক্স পাখির মতোই ভস্ম থেকে জন্ম নেওয়া দেখেছি আমরা বারবার। গণধর্ষণের বিকল্প কোনো কিছু হতে পারে না, একমাত্র মৃত্যুদন্ড ছাড়া। এই বিকৃতির কোনো মাপ কোনো সংবিধান, কোনো আইন বলে সভ্য বলে খ্যাত গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না। এর পরিবর্তন খুব জরুরী ছিল অনেক আগে। দেশের ক্রাইম রিপোর্ট বলছে অন্য কথা। আসলে নথীভুক্তীকরনের ক্ষেত্রে অত্যাচারিতার সামনে প্রধান হয়ে পড়ে সেই রক্ষক, যারা দেবে সুরক্ষা। তাদের সহযোগিতার অভাব এবং নানা অপমানজনক প্রশ্ন, বিবাহের অনিশ্চয়তায় নীরব হয় রেপ ভিক্টিম। খুব অবিশ্বাস্য ভাবে ভারতীয় পুরুষের মানসিকতার মিল পাওয়া যায় ১৯৯৯এ তার্কিদের এক রিপোর্টে। এখানে প্রকাশ করা হয় ৩৩% পুরুষ বিশ্বাস করে কিছু মহিলা ধর্ষণ ডিজার্ভ করে। বাকি ৬৬% বিশ্বাস করে কিছু মহিলার চেহারা ও পোশাক পুরুষদের উৎসাহিত করে।
মধ্যপ্রদেশে তিন হাজার চারশো ছয় (3406) রেপ ভিক্টিমের মধ্যে মাত্র ছয়টি নথীভুক্ত হয়। বাংলা এই জঘন্যতম অপরাধের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে। এখানে ২০১১তে দু’ হাজার তিনশ তেষট্টি জন (2363) রেপ ভিক্ট্মের নাম নথীভুক্ত করে। উত্তর প্রদেশের দু’ হাজার বিয়াল্লিশটি (2042)
ঘটনা নথীভুক্ত হয়। রাজস্থানে হয় আঠেরোশটি (1800), মহারাষ্ট্রে সতেরোশো এক (1701) এবং আসামে সতেরোশ জন (1700) রেপ ভিক্টিমের নাম পাওয়া যায়। অন্ধ্রপ্রদেশে চোদ্দোশ বিয়াল্লিশ (1442), কেরালায় এগারোশ বত্রিশ(1132), ওড়িশায় একশ বারো (112), বিহারে নয়শ চৌত্রিশ (934), ঝাড়খন্ডে সাতশ চুরাশি (784), গুজরাটে চারশ উনচল্লিশ (439)l এছাড়া সিকিমে ষোলো (16), নাগাল্যান্ডে তেইশ(23), গোয়ায় উনত্রিশ (29), মণিপু্রে তিপ্পান্ন (53)। বিগত দু’ বছরে নথিভুক্ত হিসেব অনুযায়ী রেপ ভিক্টিমের সংখ্যা দেখানো হয় তেইশ হাজার পাঁচশো বিরাশি(23582)। ২০১১ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দপ্তর থেকে এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়।
২০০৯-২০১৩ ধর্ষণের গ্রাফের একরকম উড়ান ঘটে। প্রত্যেক দিন ৮৪৮ জন মেয়ে হয় হ্যারাসড, নয় নিহত, বা পাচার নয়তো বিক্রী হচ্ছে। ২০১৩তে ধর্ষণের সংখ্যা ৩৪০০০, যা ২০১২ থেকে ৩৫.2% বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধর্ষিতার এক কাল্পনিক নাম দেওয়া গেল। ধর্ষক পুরুষ থেকে গেল, তাকে আলাদা করে বাছাই করা গেল না। গেলেও শাস্তি দেওয়ার বিধানে তেমন কঠোর হওয়া গেল না। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধর্ষকদের কঠোরতম শাস্তির বিধান আছে। আমিনা ফিলালি ইঁদুরমারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে, যখন তার ধর্ষণকারী সাজা থেকে মুক্তি পেতে নির্যাতিতাকে বিবাহ করতে রাজী হয়। শাস্তির বিধানের ভিতকে এভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায় আইনের ফাঁকফোকর বিভিন্ন দেশে। আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে অনিচ্ছুক স্ত্রীদেরও শাস্তির বিধান আছে। তাছাড়া খারাপ রেপু্টেসন বা দেহব্যবসায়ী নারীদের ধর্ষণে ধর্ষকের শাস্তির আইনগত ছাড়ও আছে। রাশিয়ায় ৩ থেকে ২০ বছর কারাদন্ড, আমেরিকায় আজীবন কারাদন্ড, নরওয়েতে ৪ থেকে ১৫ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
কঠোর শাস্তি নাকি নারী শরীর চর্চার এক অবাধ অনুকূল পরিবেশ, যা যুব সমাজের একদম হাতের মুঠোয়, ঘরের বিছানায় তা নিয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরী। ধর্ষণ শুধু পথে ঘাটেই হয় এমন নয়, বৈবাহিক বন্ধনেও এই বিষ মাথাচাড়া দিয়েছে। ধর্ষক জন্মায় এই পরিবেশে, এই সমাজে। এক সুরক্ষার বলয় গড়ে না তুললে তা কন্যা বা পুত্রসন্তান সবার পক্ষেই ক্ষতিকর। রেপ অ্যাঙ্গার হোক, বিকৃতি হোক, গণ হোক, একক হোক – এর একটিই মৌলিক চরিত্র। নারীকে অসম্মান করা। তাকে জব্দ করার এক মোক্ষম উপায় যে পুরুষের হাতে আছে, তা নিয়ে একটি ভুল ভাবনা প্রতিপালিত করা। কিন্তু সেই পুরুষকে কেউ শেখায় না ব্যবহার কখনো একপাক্ষিক হয় না। নিজেকে ব্যবহার করেই উপভোগ করা যায়। স্বেচ্ছায় নিজের প্রয়োজন, সুযোগ বা আবেগের দাস হয়ে নিজেকে ব্যবহার করেও যদি সম্মানের সঙ্গে নিজেকে আড়াল করে বেঁচে থাকা যায়, তবে যে বায়োলজিকালি প্রতিরোধে অক্ষম, সেই অনিচ্ছুক, অপারগ দুর্ঘটনার সামনে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে লজ্জায় মাথা লুকানোর বিধান কোনো আধুনিক, সভ্য সমাজে থাকতেই পারে না। ধর্ষণ লজ্জার নয়, সামাজিক অপরাধের বিষয়। আইনি সুরক্ষার ব্যবহার করে নারীদের তা সমাজ থেকে নির্মূল করতে তৎপর হতে হবে। এড়িয়ে যাওয়া, বাদ দেওয়া কোনো বিকল্প সমাধান নয়। তবে তা এক ঘৃণ্য অপরাকে প্রশ্রয় দেবার দোসর মাত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন