সহিষ্ণুতা, আধাসহিষ্ণুতা, অসহিষ্ণুতা বিষয়ে কিছু প্রলাপ
গভার্নিং ইন্ডিয়া শীর্ষক একটি আধা-আন্তর্জাতিক
আলোচনাচক্রে চেয়ার করার সময় প্রায়শঃই টলার্যান্স কথাটি ঘুরে ফিরে আসছিল। আসবেই!
কেননা সহিষ্ণুতা/অসহিষ্ণুতা এখন বহু আলোচিত বিষয়, আর আজকের স্মার্ট কর্পোরেট
সমাজবৈজ্ঞানিক ভাষায় তার ‘টেমপ্লেট’গুলিও বহু চেনা। যেমন গরু বনাম ছাগমাংস ভক্ষণ,
গজেন্দ্র বনাম ভালো কেউ পুণে ফিল্ম ইন্সটিটুটে, আমির বনাম অমিতাভ ইনক্রেডিব্ল
ইণ্ডিয়ায়। এক অংশগ্রাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এই আলোচনায় একটা খুব দামি কথাও বললেন —
যে সহিষ্ণুতা কোনো স্থৈতিক (আমার নিজস্ব বাংলায়, উনি বলেছিলেন স্ট্যাটিক) ব্যাপার
নয়। যে কোনো দেশে যে কোনো সময় তার ওঠাপড়া আছে। এটা আমারো খুব পছন্দের কথা। বর্তমান
কেন্দ্রীয় সরকার, তার প্রধান দলের আর তুতো ভাইদের অনেক কথায়, কার্যকলাপে অসহিষ্ণুতার
কথা বারবার উঠছে। সত্যি হয়তো এই কালে অসহিষ্ণুতার দাপট বেড়েছে। এমনকি
প্রধানমন্ত্রীর পরমপ্রিয় ম্যারিকান দাদা পর্যন্ত তা নিয়ে মন্তব্য করতে ছাড়েননি। আর
‘কানগ্রেস’ থেকে বাম অনেক দলই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে অনেক কথা বলছে। এমনকি
সহিষ্ণুতা আর অসহিষ্ণুতা প্রত্যাসন্ন বিধানিক নির্বাচনগুলিতে আর বেশ কিছু দূরে
লোকসভা নির্বাচনে জোটগঠনে বেশ একটু প্রভাব ফেলবে, রাজনৈতিক বর্ণালীর বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে বেশ কিছু অস্বভাবী দলকে চমকপ্রদভাবে কাছে এনে দেবে, এমনও বোঝা
যাচ্ছে।
ছাত্রজীবনে উত্তর মুখস্থ করার থেকে বই পড়ার ভুল সিদ্ধান্ত (যার শাস্তি
বহুভাবে পেয়েছি আর যার জন্য বুদ্ধদেব বসুর নায়কদের ও তাদের স্রষ্টাকে দুষি আর ভালোবাসি)
আমাকে আলোচনাচক্রে, কনফারেন্সে আর লেখার পাতায় চটজলদি ‘কোট’ করার বেশ কিছু সুবিধা
দেয়। তার সাহায্য নিয়ে
আমি ওই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের কথা চেয়ার থেকে লুফে নিয়ে বললাম, যে কোনো দেশে আর যে কোনো সময়ে সহিষ্ণুতা আর অসহিষ্ণুতার একটি গ্রাফ
থাকে। বলা ভালো একটি রৈখিক স্কেল, যার লাইনের একদিকে দু’প্রান্তে
থাকে জিরো টলার্যান্স আর হান্ড্রেড ইনটলার্যান্স, আর অন্যদিকে থাকে ইনটলার্যান্স আর হান্ড্রেড টলার্যান্স। একটা দেশকে, কিম্বা এই
দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশকে এই রৈখিক স্কেলে তার রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে
‘প্লট’ করা যায়। যে পশ্চিমকে বিশেষতঃ ইংল্যাণ্ডকে আমরা টলার্যান্স বা সহিষ্ণুতার
পীঠভূমি মনে করি সেখানেও রাজনৈতিক চিন্তায় কি ব্যবহারিক রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার সীমা
কখনোই অসীম ছিল না।
চেয়ার থেকে বক্তিমা মানায় না বলেই আমার চিন্তার বাকি অংশটি মনে
রেখেছিলাম কোথাও লেখার জন্য। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমার ‘কালিমাটি’র কিস্তি বাকি। লাস্ট ডেট প্রত্যাসন্ন। এখানেই আমার সীমিত পাঠকদের জ্বালানো যাক! তো
যা বলছিলাম। সহিষ্ণুতা/অসহিষ্ণুতা চিন্তায় পশ্চিমি দুনিয়ায় যে সব মাইলপ্রস্তর আছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি ভুল নামেতে বা ভুল মানেতে চলে। আবার কিছু বই আছে যেগুলি
সীমিত পাঠের ভিত্তিতে আংশিক অনুধাবনে চলে। যেমন একটি কথা যা পরমতসহিষ্ণুতার চুম্বক
হিসেবে পরিচিত যথা — I do not agree
with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it — চলে
ভলটেয়ারের নামে। কিন্তু এই বিশেষ কোটটি Evelyn Beatrice
Hall (1868-1956)-এর আত্মজীবনী থেকে এক ‘মিসকোট’। Hall
সেখানে নাকি বলছেন যে Helvetius-এর De L’Esprit
বা On The Mind বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর
তাঁর শত্রুরা যখন তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, তখন Helvetius-এর
অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত সমস্ত অন্যায় মাপ করে দিয়ে ভলটেয়ার নাকি বলেছিলেন, ‘What
a fuss about an omelette! How abominably unjust to
persecute a man for such an airy trifle as that’। এ কথা ধরিয়ে দেওয়ার এই অর্থ নয় যে ভলটেয়ার সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী ছিলেন
না। বরং পরমতসহিষ্ণুতার অন্য নাম বলেই বোধহয় ভলটেয়ারের নামে এই ‘কোট’ চলে গেছে।
ভলটেয়ারের Treatise on Tolerance on the Occasion of
the Death of Jean Calas from the Judgment Rendered in Toulouse (1763) বইতে আছে নিজের ছেলেকে ক্যাথলিক চার্চে যোগ দেওয়া থেকে আটকাতে তাকে হত্যার
দায়ে অভিযুক্ত প্রোটেস্ট্যাণ্ট পাদ্রী Jean Calas-এর বিচার
এবং প্রাণদণ্ডকে নিয়ে আলোচনায় ভলটেয়ারের কিছু অসাধারণ কথা। যেমন:
ইউরোপে প্রায় চল্লিশ মিলিয়ন অধিবাসী আছে যারা চার্চ অভ রোমের সদস্য
নন। আমরা কি তাঁদের সকলকে বলব, “মশায়,
যেহেতু আপনারা অভ্রান্তভাবে অভিশপ্ত অতএব আমি আপনাদের সঙ্গে খাবো না, বাক্যালাপ করব
না, কিম্বা অন্য কোনো রকমের সংস্রব রাখব না?”
ওহে এক শান্তিপূর্ণ ঈশ্বরের বিভিন্ন পূজক! তোমাদের হৃদয় সত্যি
নিষ্ঠুর। কেননা তোমরা সেই ঈশ্বরের পূজা করতে করতে অন্যদের কষ্ট দাও, যেকালে তাঁর
সমস্ত নীতিনির্দেশ এই ক’টি কথা দিয়ে তৈরি “ঈশ্বরকে আর তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”।
আমি দেখি আমাদের যুগের সঙ্গে সমস্ত মৃত অতীত যুগকে তাঁর উপস্থিতির
মধ্যে আবির্ভূত হতে। তুমি কি নিশ্চিত যে আমাদের স্রষ্টা জ্ঞানী এবং পুণ্যাত্মা
কনফুসিয়াস, আইনদাতা সোলন, পিথাগোরাস, যালেউকাস, সোক্রাতিস, প্লেটো, দিব্য
অ্যান্টোনিয়াস, সদাশয় ট্রাজান, মানুষদের সব আনন্দ, এপিক্টিটাস আর অন্য সব
দৃষ্টান্তপ্রতিম মানুষদের বলবেন, “যাও দানবরা, সেই সব নিপীড়ন ভোগ কর যারা
তীব্রতা আর কালিক ব্যাপ্তিতে আমার মতোই শাশ্বত। কিন্তু
তোমরা আমার প্রিয় জন চাতেল, র্যাভেইল্যাক, দামিয়েন্স, কার্তুস ইত্যাদি
যারা আমার আমার বলে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী মরেছো, তারা আমার ডাইনে বস আর আমার
সাম্রাজ্য আর সুখ ভাগ করে নাও”। এই কথাগুলো শুনেই তোমরা ভয়ে শিহরিত হয়ে পিছিয়ে যাও, আর এগুলি আমার মুখ
থেকে নির্গত হয়ে যাওয়ার পর আমার আর কিচ্ছু বলবার নেই তোমাদের। এই সবই পরমতসহিষ্ণুতার,
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভালো ভালো কথা, আর বলার জন্যে ভলটেয়ারকে বাধাই! কিন্তু
পরমতসহিষ্ণুতার আরেক বিখ্যাত দিগ্দর্শক বই
জন লকের A Letter Concerning Tolerance (1689)-তে সহিষ্ণুতাকে
সমাজের সব অংশে, সব ধর্মের প্রতি পরিব্যাপ্ত করা হলেও মহম্মদীয়রা এই সহিষ্ণুতা
বলয়ের বাইরে তাদের রাষ্ট্রাতিগ আনুগত্যের জন্য। লক এমনকি যারা পৌত্তলিক ও পেগ্যান
তাদেরকেও সহিষ্ণুতা দিতে রাজি। তাঁর কথায়, ‘Now, whosoever maintains that
idolatry is to be rooted out of any place by laws, punishments, fire and sword,
may apply this story to himself. For the reason of the thing is equal, both in
America and Europe and neither Pagans there, nor any different Christians here,
can, with any right be deprived of their worldly goods, by the predominant
faction of a court-church, nor are any civil rights to be either changed or
violated on account of religion in one place more than another।’ এমনকি
যদি কেউ পৌত্তলিকতাকে ‘পাপ’ বলে শাস্তি দেওয়াতে চায় সেও সমর্থনীয় নয়। কারণ
ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার নেই ‘to make use of his sword in punishing everything indifferently, that he takes to be
a sin against God’। যেমন লোভ, অ-বদান্যতা, আলস্য, মিথ্যাভাষণ, শঠতা, শপথভঙ্গ এইসব সমস্ত
মানুষের সম্মতিক্রমে পাপ। তবুও তা অন্যদের
অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনা বলে অথবা সমাজের সার্বজনিক শান্তি লঙ্ঘন করেনা বলে
ম্যাজিস্ট্রেট তার বিচার করতে পারেন না।
কিন্তু এই সহিষ্ণুতা
মহম্মদীয়দের বরাতে জুটবে না, যেহেতু যে কোন ধর্মব্যবস্থা যা এমন ভিতের উপর দাঁড়িয়ে
আছে যে যারা এতে প্রবেশ করে তারা নিজেদের অন্য রাজনের সেবা এবং সুরক্ষার সামিল করে,
তার অধিকার নেই ম্যাজিস্ট্রেটের সহিষ্ণুতা পাওয়ার। কারণ তাদের সহিষ্ণুতা দেওয়ার
অর্থ ম্যাজিস্ট্রেট নিজের দেশে বিদেশী এখতিয়ারকে কায়েমি বা থিতু হতে দেবেন। রাজসভা
এবং চার্চের লঘু ও চপল পার্থক্য এখানে অনুমত নয়, যেখানে ‘both the one and the other are subject to the absolute authority of the same person who has not only
power to persuade the members of his church to whatever he lists, (either as
purely religious or as in order thereunto) but can also enjoin it on pain of
eternal fire’। লকের মতে এটা হাস্যকর যে কোনো মহম্মদীয় নিজেকে
কেবল ধর্মীয় ব্যাপারে ‘Mahometan’ আর সব
ব্যাপারে কো্নো খ্রিস্টান ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি
বিশ্বস্ত বলছে, যেকালে একই
সময়ে সে নিজেকে কনস্ট্যান্টিনোপ্ল এর মুফতির প্রতি অন্ধ আনুগত্যে আবদ্ধ বলে
স্বীকার করে নিচ্ছে, যিনি আবার অটোমান সম্রাটের প্রতি বাধ্য আর নিজের ভাণ করা
ধর্মীয় নির্দেশগুলি তাঁরই মর্জিমাফিক জারি করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে লকের
সহিষ্ণুতার ধারণা সমসাময়িক ইউরোপের মহাদেশীয় রাজনীতিতে খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের লড়াইয়ের দ্বারা কতখানি প্রভাবিত, আর তাঁর
সহিষ্ণুতার তত্ত্বও খ্রিস্টীয় ও চার্চ স্টেটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দ্বারা কতখানি
প্রভাবিত ছিল।
ব্রিটেনে সহিষ্ণুতার সীমা কেবল A Letter
Concerning Tolerance বইয়ের এরকম দুয়েকটি
গোলমেলে বাক্যে, কেবল ধর্মীয় সহিষ্ণুতার
মধ্যে না খুঁজে যদি বাস্তব সমাজে, রাজনীতিতে, পরমত বা ‘অপর’-এর ব্যাপারে
সহিষ্ণুতার মধ্যে খুঁজি, তবে দেখব আজকের
ব্রিটেনে পরমতসহিষ্ণুতার বিখ্যাততম টেমপ্লেট, হাইড পার্ক; এবং তাতে যার যা কিছু
বিষয়ে বক্তিমার অধিকার, এমনকি যখন তা কখনো কখনো একটু পারসোন্যাল হয়ে যায়, তখনো
তাতে বাধা দেওয়ার রেওয়াজ নেই! কিন্তু এই অধিকার মসৃণভাবে আসেনি! ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক
শ্রেণির প্রতি ভোটাধিকারের প্রসারণ বিষয়ে বিলের প্রথম খসড়া পার্লামেন্টে পরাস্ত
হবার পর রিফর্ম লীগ নামে এক সংস্থার
নেতৃত্বে যে দেশব্যাপী আলোড়ন হয়, তাতে শ্রমিকরা হাইড পার্কে জমায়েত হতে চাইলে
তাদের ছলে-বলে-কৌশলে আটকাতে সব্বাই সামিল হন। জন স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যস্থতায় শেষ
পর্যন্ত সেই বিশাল মিটিং করা হয় ইসলিংটনের অ্যাগ্রিকালচারাল হলের সীমিত পরিসরে, চরম
বিশৃঙ্খলার মধ্যে। বিখ্যাত ইংরেজ কবি ম্যাথিউ আর্নল্ড তাঁর Culture and Anarchy বইতে
তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেন: ‘just asserting his personal
liberty a little, going where he likes, assembling where he likes, bawling as
he likes, hustling as he likes’। অনেক
আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই হাইড পার্ক আজকের হাইড পার্ক হয়ে উঠেছে! বিশ্বাস না হয়
দেখুন রেমণ্ড উইলিয়ামসের Problems in
Materialism and Culture (1980) বইয়ের ‘A Hundred Years of Culture and Anarchy’ প্রবন্ধ!
এর থেকে অন্য কিছু হওয়ার ছিলো! ‘Survival of the fittest’ নামে
যে ভুল কোট Herbert Spencer-এর হওয়া সত্ত্বেও Darwin-এর আধ-বোঝা ‘natural selection’ তত্ত্বের কারণে
তাঁর নামে চলে আসছে, যার থেকে ‘Social Darwinism’ নামের
ঘৃণ্য তত্ত্বের উৎপত্তি, যার ফলে যারা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বঞ্চনার ফলে বুদ্ধি
তথা মেধা নামের বস্তুগুলির ক্ষেত্রে পিছিয়ে, তাদের ক্ষেত্রে
চরম উপেক্ষা ও অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়েছিলো! Darwin নিজেই
প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে পুরোপুরি মেনে নেননি, যার ফলে একটি চিঠিতে তাঁর
সম্পর্কে এক সংবাদপত্র নিবন্ধে ভুল প্রশংসাকে শ্লেষ করে’ তিনি লিখেছিলেন শক্তিই
যদি সর্বদা ঠিক হয় তবে নাপোলিয়ঁ ঠিক করেছেন এবং প্রত্যেক ঠক দোকানদার ঠিকই করে। তাতে করে কিন্তু
অসহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি ‘Social Darwinism’-এর
বাড়বাড়ন্ত কমেনি। বিখ্যাত মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ W. G. Sumner ১৮৮০-র দশকে বলতে শুরু করেন সভ্যতা যদি ‘Survival of the fittest’ হয় তবে ‘Survival of the
unfittest’ ‘anti-civilization’। John D. Rockefeller
বৃহৎ ব্যবসায়ের বৃদ্ধির স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যবসায়কে সঙ্কুচিত করার
লক্ষ্যে যে যুক্তি দেন তাতে অসাধারণ প্রস্ফুটিত একটি গোলাপকুঁড়ির উপমা দেওয়া হয়,
যার জন্য কাছে ফোটা ছোটোখাটো গোলাপকুঁড়িগুলিকে ছেঁটে বাদ দিতে হবে শল্যবিদের
দক্ষতায়। ‘Social Darwinism’ বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে
মেধাতন্ত্রের নামে একটা প্রবল বৈধতা নিয়ে কায়েমি। এই বাতাবরণে সহিষ্ণুতার অবকাশ
খুউব বেশি আছে?
কেউ বলতে পারেন এই ধর্মীয়
সহিষ্ণুতার, পরমতসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গে আমি এইসব অবান্তর কথা আসছে কেন। কারণ
সহজেই বোধগম্য। তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু
অন্যায় হয়তো চলেছে বহুদিন ধরেই, মূলতঃ তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের ‘creamy layer’-এর মধ্যে সংরক্ষণের সুযোগ আটকে থাকার জন্য।
কিন্তু শিক্ষা ও চাকুরিতে এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের ছেলে মেয়েদের যে তীব্র
ঘৃণা ‘সোনার চাঁদ’, ‘সোনার টুকরো’ কথাগুলোর মধ্যে ঠিকরে বেরোয়, তার কারণ কি কেবল এই
‘creamy layer’-এর মধ্যে সংরক্ষণের আটকে থাকা? সম্প্রতি একটি
‘Kapil Sharma V/S CID Jokes’s
Photo’ নামের পোস্ট ফেসবুকে ভীষণ ভাইর্যাল হয়ে
গেছে। সেখানে একটি গৌরাঙ্গী সুন্দরী এক ভুটকালো বা ভুতকালো বরের সঙ্গে বিয়ের রিসেপশনে
বসে’। পোস্টটির অজস্র শেয়ারে একটির ক্যাপশন হোলো ভালো পড়লে এমনই হয়! ঠাট্টা করে লেখা এই মন্তব্যটিকে ঠাট্টা হিসেবেই
দেখেছি! তবুও এই মাল্টিলেয়ার্ড পোস্টের একটি মানে অবশ্যই এই যে নেকাপড়া করলে একটি ভুটকালো পাত্তরও এমন ফর্সা
সুন্দরীকে পেতে পারে। এক মন্তব্যকারী লিখলেন মেয়েটি নেকাপড়া করেনি বলেই এমন হয়েছে এটা কি বলা যায়না? আমাদের ব্যাপক,
সংখ্যাগুরু কালোদের দেশে কালোদের প্রতি এত অসহিষ্ণুতা কেন? এই নিয়ে সুভাষ
মুখোপাধ্যায়ের একটি অসাধারণ কবিতাই আছে! এই গাত্রবর্ণের অসহিষ্ণুতাই তো তপশীলী
জাতি ও উপজাতিদের শিক্ষিত অংশের প্রতি ঘৃণায় দৃশ্যমান! প্রাচীন ভারতে তাদের
‘মায়াতি’ বলে বলি দেওয়া হতো। এখন ঘৃণা ছাড়া উচ্চবর্ণের হাতে আর কিবা আছে?
আবার মোদির ভারতে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আরো বড় পাখা মেলেছে
তার বিরুদ্ধে চিৎকৃত রাজনৈতিক প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলের ও শাসক
দলের অবিসংবাদী নেত্রী অগ্রগণ্য/গণ্যা! কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকেই এই রাজ্যেই যে
প্রধান বিরোধী দল ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল, আজ কেবল ২০০৮ সাল থেকে একাদিক্রমে বিভিন্ন
স্তরের নির্বাচনে ভোটে হারায়, তার নেতাদের
মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাতে বলেছেন প্রধান নেত্রী। অন্যান্য বড়, মাঝারি, ছোটো, খুচরো
নেতারা বিরোধী দলের নেতা ও সদস্যদের
বাড়িতে চলে আসা কেউটে সাপের মত, ইঁদুরের মত পিটিয়ে মারতে বলেছেন। বিবাহে,
শ্রাদ্ধে, অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের একঘরে, বয়কট ও বর্জন করতে বলেছেন তা
প্রায় সব্বাই জানেন! সব সাপকে মেরে ফেলার জৈববৈচিত্র্যহানিকর কুপ্রস্তাবের কথা না
তুলেই বলছি, এই প্রবল সামাজিক অসহিষ্ণুতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য
লড়াই করা যায়?
এই কথাগুলোর
প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি এই কারণে যে ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে হিন্দুদের
মুসলিমদের প্রতি, আর মুসলিমদের হিন্দুদের প্রতি যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব
বেড়েছে বলা হচ্ছে তা কিন্তু বহুদিন ধরেই, মানে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সামাজিক
অসহিষ্ণুতারই পরিণতি। আর রবীন্দ্রনাথ বারে বারে এই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন যে
এর রাষ্ট্রনৈতিক সমাধান গোড়া কেটে আগায় জল ঢালবার মতই অফলপ্রসূ হবে। বলেছেন
‘আমাদের রাষ্ট্রসমস্যার ... একটা কঠিন গ্রন্থি রয়ে গেল, হিন্দুমুসলমানের ভেদ ও
বিরোধ। এই বিচ্ছেদটা নানা কারণে আন্তরিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে থেকে রাষ্ট্রনৈতিক
প্রলেপ দিয়ে এর ফাটল নিবারণ করা যাবে না; কোনো একটু তাপ বেড়ে উঠলেই আবার ফাটল ধরবে।’ আমার একটি বইয়ের একটি প্রবন্ধে (‘In the Voice of Cassandra: Tagore on Hindus
and Muslims in India and their Relations’) রবীন্দ্রনাথের হিন্দুমুসলমান সম্পর্ক চিন্তার প্রকৃত, আধুনিক
তাৎপর্যের আমি বিশদ আলোচনা করেছি, সুধী পাঠক ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন [Politics,
Society and Colonialism: An Alternative Understanding of Tagore’s Responses
(New Delhi: Cambridge University Press, Foundation Imprint, 2010),
] কিন্তু এখানে আমার বক্তব্য হিন্দুমুসলমানের প্রসঙ্গ পেরিয়ে আরো একটু আলাদা। এখানে
আমি এই কথা বলতে চাই যে সহিষ্ণুতা শব্দটাই
বড্ড গোলমেলে। তার বদলে সমব্যথা, সহানুভূতি
ইত্যাদি চলবে না? সহিষ্ণুতা কথাটা যে বড় কৃপণ! রফা/ অ্যাডজাস্টমেণ্ট ইত্যাদির মত! আমার এক
ছাত্র বহুদিন আগে আমাকে শুধিয়েছিল সে বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে কিনা। তাকে বিয়ে করতে
বারণ করে’ আমি বলেছিলাম ‘Love expands the sphere of adjustment’। ভুল
জায়গায় শুরু করে লাভ নেই! ঐ যে রবীন্দ্রনাথের
কথা আছে ‘খোকা বলেই ভালোবাসি, ভালো বলেই নয়’! এইটাই আসল কথা! যদি ধনী দরিদ্রকে,
উচ্চমেধা নিম্নমেধাকে, শাদা কালোকে, সুন্দর অসুন্দরকে, উচ্চবর্ণ অধোবর্ণকে, এক রাজনৈতিক দলের মানুষ
অন্য রাজনৈতিক দলের মানুষদের একটু মানুষ হিসেবে ভালো না বাসতে পারে, কেবল
সহিষ্ণুতা দিয়ে এগোবার কথা ভাবে, তবে সহিষ্ণুতা আসবেনা। ভালোবাসাই তো সহিষ্ণুতার
জননী!
ঋদ্ধ হলাম লেখাটি পড়ে
উত্তরমুছুনধন্যবাদ! সাধারণতঃ আমার লেখা থাকে না পড়ার জন্য! ব্যতিক্রমে অবাক!
মুছুন