ফুলের জলসা
ফুল তো ফোটে নিয়ম মতোই। এক এক মরসুমে এক এক ফুল। কত যে তার রূপ, রঙ! একটু
যত্নের ছোঁয়া পেলেই ফুল হাসে খিলখিল করে। আবার জংলা বুনোফুলও ফোটে বিনা যত্নে,
আদাড়ে বাদারে। ফুল ফুটলে, ফুলের মনে কি খুব আনন্দ আসে? যেমন ভাবে আমরা আনন্দে হেসে
উঠি, ফুলও কি সেভাবেই আনন্দ পায় বলে ফোটে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ওদের মনের
কথা। ফুলের মন বলে কিছু নেই বুঝি! যত মনের কারবার শুধু মানুষের! কিন্তু মানুষের মন
যদি ফুলের শোভা দেখে খুশি না হতো, তাহলে
কি ফুল এত খুশি হতো? এই যে
খুশি হওয়ার যুগ্মপালা, এর মধ্যেই হয়তো বেঁচে থাকার গূঢ় কথাটি লুকিয়ে আছে। তুমি খুশি
বলে আমি খুশি। আর আমি খুশি বলে তুমি।
ফুলের কথায় ফিরে যাই। শীতের সকালে শিশির মেখে যে
গাঁদাফুল চোখ মেলেছে, যে ডালিয়ার বুকের ভেতরে শিশির চুপ করে মুখ লুকিয়েছে, আর যে
চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ি জুড়ে শিশির আলপনা দিয়েছে, সেই সব ফুলেদের দেখে আমাদের মুগ্ধ
না হয়ে উপায় নেই। কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে একটু হাত বাড়িয়ে ছুঁতে ইচ্ছে হয় খুব। মনে হয়
সত্যি ফুল তো! নাকি কল্পনার মতো সুন্দর
কিছু? এত রূপ দিয়েছে প্রকৃতি এদের, তা কী শুধু
পতঙ্গদের আকৃষ্ট করবে বলে? ওরা কি
শুধু অপেক্ষায় থাকে পতঙ্গের জন্য? কখন কোনো পতঙ্গের শুঁড়ে লেগে যাবে একটুখানি রেণু, আর
তারপর হবে পরাগমিলন? সব অপেক্ষাই কি শুধু মিলনের জন্য? মিলন
হবে কদ্দিনে...? কিন্তু এই পরম আকাঙ্ক্ষিত মিলনের শেষে যে ফুলকে মরে যেতে হয়! তাহলে কি ফুলের এই অপেক্ষা
মৃত্যুর জন্য? শুধু ফুরিয়ে যাবে বলে তার এত রূপ, এত রঙ, এত বাহার! ভাবলে আশ্চর্য
হতে হয় বারবার। আর এই আশ্চর্যের গায়ে লেগে থাকে ফুলের ঘ্রাণ, ফুলের রঙ।
যদি বল, ফুলের পরিণতি তো ফলে। ফলের বীজ থেকে আবার
নতুন জন্মের উল্লাস হবে বলে ঝরে যায় ফুল। নতুন সৃষ্টি না হলে যে বিনাশ
অবশ্যম্ভাবী। বেশ, না হয়
সৃষ্টিই হলো। কিন্তু
এই সৃষ্টির মধ্যে কেন এত বেদনা লুকিয়ে থাকে? পাহাড় চুরমার করে হিমবাহ ফাটিয়ে নদী সৃষ্টি হয়। পাহাড়ের
যন্ত্রণা লুকিয়ে পড়ে নদীর গর্ভে। তেমনি এক ফুল যেচে মৃত্যু নিয়ে আসে আরেক ফুলকে
সৃষ্টি করবে বলে। যে ফুল মরে গেল, তার পাপড়ি মাটিতে ঝরে গেল, হাওয়ায় উড়ে গেল তার
শুকনো অবয়ব, অথবা মাটিতেই মিশে গিয়ে মাটি হলো সে, তার যন্ত্রণা কোথায় লুকিয়ে রইল? এত সব ভাবার অবকাশ ফুলের নেই বোধহয়। তার কাজ রূপে বা
গন্ধে পতঙ্গকে আকৃষ্ট করা। এর বেশি তার কিছু চাওয়ার নেই, পাওয়ার নেই। আমাদের
মুগ্ধতা, আমাদের অবান্তর চিন্তাভাবনার দায় তার নয়। সে নিজের কাজ করেই খুশি। অন্তত
আমরা তাই ধরে নিয়েছি বিজ্ঞানসম্মত ধারণায়।
তবে এও ঠিক, তুমি যদি ফুলকে কিছু দিতে চাও, সে কি
‘না’ করবে? কি দেবে তুমি ফুলকে! সে তো নিজেই দিতে এসেছে, নিতে জানে না বোধহয়।
প্রাণের টানটুকু দিতে পারো। তোমার খুশি, ভালোবাসা দিতে পারো। ফুল, গাছ এরা তো সুর
বোঝে, সুর শুনে ডগমগিয়ে বেড়ে ওঠে। তোমার সুরটুকু ঢেলে দিও ওদের। তাহলেই ওরা খুশি।
আর এই দেওয়ায় তোমার ভাঁড়ারে টান পড়বে না, বরং প্রাপ্তি বাড়বে। ফুল থাকলেই তার মধু
থাকবে। আর মধুলোভী কীটপতঙ্গও থাকবে। কিছু মধু খেয়ে, রেণু মেখে ওরা যদি চলে যায়,
তবু ভালো। কিন্তু যে কীট বাসা বাঁধে ফুলের বুকে, কুরে কুরে খায় ফুলের গর্ভাশয়,
তাদের যে না তাড়ালেই চলে না! তারা
আসে শুধু ধ্বংস করতে। অগত্যা ভরসা সেই কীটনাশক। দুষ্টু কীট যেমন
মরে যায় এতে, প্রজাপতি মৌমাছিরাও দূরে সরে যায়। আসে না আর ফুলের কাছে। ফুল অযথাই
পরাগমিলন ছাড়াই ঝরে যায়। তার রূপে আমরা ভুলি, কিন্তু তার জন্ম সার্থক হয় না।
আমরা কেন ফুলের স্বার্থ দেখতে যাব! প্রজাপতির
স্বার্থ দেখতে যাব! আমরা ফুল চাষ করি নিজেদের জন্য। হয় সে ফুল পুজোয় কাজে লাগে, নয়
ফুলদানীতে ঠাঁই পায়। আমরা জানি পরাগমিলন খুব জরুরী। নইলে আর ফুল ফুটবে না। তাই
আমরা ফুলে ফুল ছোঁওয়াই। এক ফুলের রেণু মেখে যায় অন্য এক ফুলের গর্ভফুলে। আর যে
বালকেরা ফুল ছোঁওয়ানোর কাজ করে, দু’বেলা
দুমঠো খেতে পায়, তারা কি জানে এত সব
ইতিবৃত্ত? তারা ফুল বোঝে না, তারা ভাত বোঝে। তারা জানে যত বেশিক্ষণ ফুলে ফুল
ছোঁওয়ানো যাবে তত বেশি পয়সা রোজগার হবে।
রঙিন ঝলমলে ফুলগুলোর বাইরে যে ফুল আছে তাদের
সুগন্ধ নিয়ে, তারাও তো হেলাফেলার নয়। ভোরবেলা একটা যুবক গন্ধরাজ গাছকে দূর থেকে
দেখলে তার সাদা হয়ে যাওয়া মাথাটাকে দেখে মনে হয় কোনো বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর পাকা চুলের
অভিজ্ঞতা নিয়ে। অথচ একটু বাদেই ভুল ভাঙে। তার তীব্র গন্ধের মাদকতায় ঝিমঝিম করে ওঠে
অনুভূতির জানালা দরজা। রজনীগন্ধা,
বেল, জুঁইয়ের মিঠে স্নিগ্ধতায় মনে যে শান্তি আসে, তার তুলনা কোথায়! আর গন্ধহীন টগর? তার শুভ্রতা
যেন দেবতার পায়ে স্থান পাওয়ার জন্যই। নিছক জংলাফুল, সেই বা কম কিসে? নীল, বেগুনী,
হলুদ, কমলা, সাদা - কত যে রকমারি ছোট
ছোট ফুল ফুটে থাকে আদাড়ে বাদারে! কে দেখে
ওদের! এটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। আমরা দেখি না বটে,
কিন্তু তাদেরও প্রেমিক পতঙ্গ আছে। এমনকি কাঁটাগাছেরও ফুল হয়। গাছের কাঁটা তো তার
নিজের সুরক্ষার জন্য, ফুল ফুটতে দোষ কী!
তবে তেমন তেমন কাঁটাগাছ, অর্থাৎ ভালো জাতের
ক্যাকটাস হলে আবার তারা পাত্তা পায় আমাদের কাছে। তাদেরকে আমরা টবে জায়গা দিই,
বাগানে জায়গা দিই। কিছুটা হলে মনেও থাকে তারা। হর্টিকালচার সোসাইটি কত উদ্যোগ
নিয়ে, কত কাটাছেঁড়া করে, কত গ্রাফটিঙের পরে একের শরীর অন্যের সাথে জুড়ে দিয়ে এক
নতুন জাত তৈরি করে। সেই গাছেও ফুল ফোটে আমাদের অবাক করে দিয়ে। আর কাঁটা তো
সামান্যই, শুনেছি নাকি পাথরেও ফুল ফোটে! এই সমস্ত বিস্ময় নিয়ে আমরা ফুলের সাথে
থাকি, নাকি ফুল আমাদের সাথে থাকে - এই
দ্বিধা নিয়ে আমরা থেকে যাই। ফুলের শত্রু হয়ে, মিত্র হয়ে, কারবারি হয়ে, বোদ্ধা হয়ে
থেকে যাই। আর ফুল থাকে তার নিজের খেয়ালে। আমাদের কালোয়াতী চলতে থাকে, ওরা
ভ্রূক্ষেপহীন ভাবে হেসে যায়, হাসতে হাসতে ঝরে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন