ওড়িয়া কবির বাংলা কাব্য : বসন্তরাস
শ্রীচৈতন্যের প্রভাব
ওড়িশার ধর্মবোধকে উদ্দীপিত করার সঙ্গে সঙ্গে তার সাহিত্য চেতনারও উন্মেষ ঘটিয়েছিল।
সেইসঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সীমানাও সম্প্রসারিত হয়েছিল। বৈষ্ণব ধর্মের
প্লাবনে সেদিন কেবল নবদ্বীপ ডুবে যায়নি, ওড়িশাও প্লাবিত হয়েছিল। চৈতন্যদেব তাঁর দিব্যজীবনের সুদীর্ঘ
আঠারোটি বছর নীলাচলে অতিবাহিত করেছিলেন। যার প্রভাব সেখানকার সাহিত্য ও শিল্পজগতকে
প্রভাবিত করেছিল। ওড়িশার দার্শনিক-কবি-পন্ডিত চৈতন্যদেবকে ‘সচল জগন্নাথ’ নামে
অভিহিত করেছিলেন। চৈতন্য-দর্শনকে ওড়িশায় প্রচার ও প্রসারে যে ‘পঞ্চসখা’র নাম
উল্লেখ করা হয়, তাঁরা হলেন – অনন্ত দাস, জগন্নাথ দাস, যশোবন্ত দাস, অচ্যুতানন্দ
দাস ও বলরাম দাস। চৈতন্যের ওড়িশা প্রবাসকালে বাংলার বহু ভক্ত পুরীধামে আসতেন।
বিশেষত এই ভক্তমন্ডলীর আগমন হতো রথযাত্রার সময়। এই উপলক্ষ্যে ভক্তদের উভয় মনোকামনা
পূর্ণ হতো – জগন্নাথ-দর্শন ও চৈতন্য-মিলন।
ওড়িশার সাহিত্য জগতে এ
সময় সবার অজান্তে এক নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছিল। চৈতন্যভক্ত ওড়িয়া কবিদের বাংলা
ভাষার প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধা জন্মেছিল। ওড়িশার কবিরা নিজেদের মাতৃভাষায় কাব্য
রচনার অবসরে প্রতিবেশী ব্যবহৃত ভাষায় কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন। ওড়িশা
রাজ্য প্রদর্শশালায় পুথিবিভাগে তালপাতায় রচিত এমন বহু পুথির সন্ধান পাওয়া গেছে,
যার ভাষা বাংলা কিন্তু লিপিরূপ ওড়িয়া। আবার এমন কবিরও সন্ধান পাওয়া গেছে, যিনি
তাঁর মাতৃভাষা ওড়িয়াতে কিছুই রচনা করেননি, বরং নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন
বাংলা কাব্য রচনায়। এমনই এক কবির নাম পিন্ডিক শ্রীচন্দন এবং তাঁর রচিত একমাত্র
কাব্যের নাম ‘বসন্তরাস’। কাব্যটি কবি
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ অবলম্বনে রচিত। অবশ্য ‘বসন্তরাস’এ কবির বহু স্বকল্পিত
কাহিনীও আছে। কাব্যটি তিনি ত্রয়োদশ সর্গে সম্পূর্ণ করেছেন।
ওড়িয়া লিপিতে তালপাতায়
রচিত ‘বসন্তরাস’এর পুথিগুলি আজও Odisha State Museum, Bhubaneswarএ সংরক্ষিত আছে। এ যাবৎ
কবি পিন্ডিকের মোট ৩৬টি পুথি পুথিশালায় এসেছে। আরও কত পুথি এখনও সংগৃহীত হয়নি এবং
কত পুথি লুপ্তপ্রায় – তা অনুমান করা কঠিন। তবে এই পুথিগুলি কবির বহুল ও ব্যাপক
প্রচারেরই অসন্দিগ্ধ প্রমাণ।
খুরদা জেলার (একদা পুরী
জেলার) সানপদর গ্রাম কবি পিন্ডিকের জন্মস্থান। আজও কবির বংশধরেরা এই গ্রামে বসবাস
করেন। গ্রামের প্রায় সকলেই কবি পিন্ডিকের এবং তাঁর কাব্যটির নামের সঙ্গে পরিচিত।
‘বসন্তরাসে’র কাহিনী
‘গীতগোবিন্দ’ অবলম্বনে হলেও উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। কাব্যের প্রারম্ভ
ও পরিসমাপ্তিতে ‘গীতগোবিন্দে’র সঙ্গে কোনো মিল নেই। তাই ‘বসন্তরাস’ কোনো অনুবাদ নয়
‘গীতগোবিন্দ’র, বরং ‘গীতগোবিন্দ’ অনুসরণে রচিত। জয়দেব গোস্বামীর কাব্যটিকে সামনে রেখে কবি
শ্রীচন্দন কবিজনোচিত স্বাধীনতাটুকুকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করেছেন।
‘বসন্তরাস’ মোট তেরোটি
সর্গে সম্পূর্ণ। ‘গীতগোবিন্দে’র সঙ্গে ‘বসন্তরাসে’র মিল-অমিল দুটোই পাওয়া যাবে। ‘বসন্তরাসে’র
প্রথম সর্গে বৃন্দাবনের বসন্তরাসে রাধা গোপনে কৃষ্ণের রাসলীলা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে।
দ্বিতীয় সর্গে ক্রোধ-বিহ্বলা রাধাকে সখীগণ আসন্ন মিলনের আশ্বাস দেয়। রাধাবিরহে কাতর
কৃষ্ণকে ললিতার আশ্বাসের মধ্য দিয়ে তৃতীয় সর্গ সমাপ্ত। চতুর্থ সর্গে ললিতা কৃষ্ণের
কাছে বিরহিণী রাধার দশা বর্ণনা করে। পঞ্চম সর্গে কৃষ্ণ নিজের অপরাধ স্বীকার করে
এবং রাধার সঙ্গে মিলনের জন্য অনুরোধ করে।
ষষ্ঠ সর্গে কৃষ্ণবিরহে রাধার ব্যাকুলতা প্রকাশিত। সপ্তম সর্গে রাধা নিজের ভাগ্যকে যেমন দোষ দিয়েছে, তেমনি সেই রমণীরত্নের
উল্লেখ করেছে, কৃষ্ণ যার বাহুডোরে বাঁধা। অষ্টম সর্গে খন্ডিতা রাধার কৃষ্ণের প্রতি
তীব্র অভিমান প্রকাশ পেয়েছে। নবম সর্গে ক্ষীণা ও দুর্বলা রাধাকে সখীগণ যত্ন করে
এবং রাত্রি জাগরণের জন্য গল্প বলে। প্রথম গল্পটি ললিতার, দ্বিতীয় গল্পটি
চম্পকলতার, তৃতীয় গল্পটি রঙ্গদেবীর এবং চতুর্থ ও শেষ গল্পটি তুঙ্গবিদ্যার। দশম
সর্গে রাধার মন পাবার জন্য কৃষ্ণ রাধার
রূপ বর্ণনা করে এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। একাদশ সর্গে রাধাকে
কুঞ্জে দেখে কৃষ্ণের আনন্দসিন্ধু উথলে ওঠে। দ্বাদশ সর্গে রাধাকৃষ্ণের মিলন এবং
সমস্ত সখীদের সঙ্গে রাসলীলার ইঙ্গিত আছে।
ত্রয়োদশ সর্গের কাহিনী
‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে নেই। এই সর্গের কাহিনী কবি পিন্ডিক শ্রীচন্দনের স্বকল্পিত।
ত্রয়োদশ সর্গের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় রাধাকৃষ্ণের পাশাখেলা। ভারতবর্ষের প্রাচীন
খেলাগুলির মধ্যে পাশাখেলা অন্যতম। পাশাখেলার উল্লেখ ঋগ্বেদের মধ্যেও আছে। কিন্তু
বাংলা ভাষায় রচিত কৃষ্ণকাব্যে রাধাকৃষ্ণের পাশাখেলার ছবি দুর্লভ। তবে ওড়িয়া
সাহিত্যে পাশাখেলার ছবি অজস্র। মধ্যযুগের অধিকাংশ প্রণয়কাব্যে পাশাখেলার ছবি আছে।
ওড়িশার বহু কবি নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে পাশা খেলিয়েছেন। পাশাখেলায় একটা বাজী রাখা হয়।
প্রায়ই দেখা গেছে নায়ক-নায়িকার ক্ষেত্রে একই ধরনের বাজী রাখার কথা – নায়ক পরাজিত
হলে তাকে পার্থিব সম্পদ দিয়ে পূর্ণ করতে হবে, আর নায়িকা পরাজিত হলে তাকে দেহদান
করতে হবে। কবি পিন্ডিক শ্রীচন্দন ওড়িশাবাসী হওয়ার জন্য ওড়িয়া কাব্যের প্রভাবে
রাধকৃষ্ণের পাশাখেলার ছবি এঁকেছেন।
‘বসন্তরাসে’র নবম সর্গে
একটি অভিনব চিত্র আছে। কৃষ্ণ-বিমুখ রাধাকে কৃষ্ণ-উন্মুখ করার জন্য এক অপূর্ব কৌশল
কবি অবলম্বন করেছেন। কৃষ্ণ-বিরহে ক্ষীণা রাধাকে সখীগণ সেবা করে এবং ‘নিশি হরণে’র
গল্প বলে। প্রথমে গল্প বলে ললিতা। ললিতার গল্প শেষ হলে রাধার - “কৃষ্ণে ষোলআনা কোপ
বারোআনা হৈল”। দ্বিতীয় গল্পটি চম্পকলতার।
এ গল্পের শেষে রাধার অবস্থা – “এই কথা হৈতে প্রান্ত কমলিনী আধে শ্রান্ত”।
রঙ্গদেবীর মুখে তৃতীয় গল্পটি শেষ হলে – “এই কথা প্রান্ত হৈতে রাই মনে মনে / বিচারই
কৃষ্ণে মান মুছিব কেমনে”। তুঙ্গবিদ্যার গল্প শেষে রাত যেমন শেষ হলো, তেমনি রাধার
অভিমানও নিঃশেষ হলো – “শুনিয়া শ্রীমতি অত অন্তর্গত আকুলিত / মনে ভাবে বৃথা মান
কৈল”।
এই কাব্যের দশম সর্গে
বর্ণিত আর একটি অভিনব চিত্র রাধার সূর্যপুজো – “সূর্য্য পূজিবারে গেল রসবতী রাই”।
বাংলা সাহিত্যে কোনো কৃষ্ণকাব্যে রাধার সূর্যপুজোর কাহিনী নেই। কবি শ্রীচন্দন
ওড়িশাবাসী হওয়ার জন্যই সম্ভবত রাধাকে দিয়ে সূর্যপুজো করিয়েছেন। একদা ওড়িশার
সূর্যপুজো বিপুল সমাদরে পালিত হতো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, কোণারকের বিখ্যাত
সূর্যমন্দির ওড়িশাতেই অবস্থিত। আজও চন্দ্রভাগায় মাঘ মাসের সপ্তমী তিথিতে শ্রদ্ধালু
ভক্তের সমাবেশ ঘটে। এর একটা কারণ হতে পারে, একদা সমুদ্র তীরবর্তী বৃহৎ অঞ্চলটি
কুষ্ঠরোগী অধ্যুষিত ছিল। আর কুষ্ঠরোগ থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য সূর্যপুজোর বিধান
ঋগ্বেদের সূক্ত থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বিবৃত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের
মধ্যযুগে এক নবতম সংযোজন হলেন কবি পিন্ডিক শ্রীচন্দন। প্রায় অপরিচিত এই কবি ওড়িশার
এক প্রান্তদেশে লুপ্তপ্রায় ছিলেন। তিনি ওড়িয়া লিপিতে বাংলা ভাষায় ‘বসন্তরাস’ কাব্য
রচনা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ওড়িয়া সাহিত্যে কিন্তু তাঁর যথাযোগ্য স্থান নেই,
কেননা তিনি বাংলা ভাষায় কাব্যটি রচনা করেছিলেন। আবার বাংলা সাহিত্যেও কবি পিন্ডিক
শ্রীচন্দনের নামোল্লেখ নেই, কেননা ওড়িয়া লিপিতে তিনি কাব্য রচনা করেছিলেন।
কবি জয়দেবের
‘গীতগোবিন্দ’ অবলম্বনে ‘বসন্তরাস’ রচিত হলেও এটি একটি মৌলিক কাব্য হওয়ার দাবি
রাখে। আর তাই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কবি পিন্ডিক শ্রীচন্দনের নাম
অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বেশ কিছুদিন ধরে ভাষা
এবং প্রাদেশিকতা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ভাষাকে কেন্দ্র করে বিভেদের রেখা সুস্পষ্ট
হয়ে উঠেছে। আমরা একে অপরকে হেয় করার প্রতিস্পর্ধায় নেমেছি। আর তাই এই বিভ্রান্ত
সময়ে বিশেষ করে মনে পড়ে কবি পিন্ডিক শ্রীচন্দনের কথা। পিন্ডিক শ্রীচন্দনদের কথা। সেইসঙ্গে
দুঃখ হয়, ওড়িয়া কবির বাংলা কাব্য রচনার যুগ সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে। আর সেইসঙ্গে
আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন যক্ষের প্রশ্নের মতো তর্জনি তুলছে – ওড়িয়া কবির বাংলা
কাব্য সৃষ্টির পরম্পরা কি ইতিহাস হয়ে যাবে? না কি সেই মহতী প্রয়াসকে প্রাণ ও গতি
দিতে আমরা প্রয়াসী হব! এই ধরনের প্রয়াস ও প্রচেষ্টা ভাষা ও প্রাদেশিক আত্মীয়তার
জন্য প্রয়োজন। জাতীয় সংহতির জন্য প্রয়োজন। জাতীয় একতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য
প্রয়োজন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন