বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

তমাল রায়

মায়া 


একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা মাঠ, একটাই গাছ, আর তাতে ভীড় করছে পাখির দল। না, পাখিও নেই। একা মাঠ আর একটা গাছ ব্যস, ওটুকুই। এই স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে। কেন কে জানে!  জানালা দিয়ে রোদ্দুর আসে না। ইলিনাও। বেলা গড়ালে আসত একটা পাখি, নিয়ম করে। আর আসে না। আসে না ইলিনাও। 
মিনি বেড়ালটা  দুপুরে, খাওয়া শেষ হলে আসবেই। যা এঁটো কাঁটা, সেগুলো খাবে নিশ্চিন্তে। তার পর আড়মোড়া ভেঙে দু বার হাই তুলবে। খুব ধীরে সুস্থে পার হয়ে  যাবে দালান চৌহদ্দি। আর আসে না। ইলিনাও। 
পুটুর মা আসত, বাসন মাজত। আসে না। হোম সার্ভিসের ছেলেটাও ডুব মেরেছে। ছেড়ে দিলো বুঝি চাকরি। আসে না। আসে না ইলিনাও। 
আঁধারের বারান্দায় একলা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ধূলো মাখা, বিবর্ণ কিছু কথা টুপ টুপ করে খসে পড়ে, সে কোনো পূর্ণতার অভিলাষ নয়। ব্যথা ভুবনে হাত রেখেছ কি আঙুল স্পর্শ করবে সরোদ! ইলিনা তাকে ভালোবেসেছিল কিনা জানে বনসাই। হ্যাঁ, একটা বনসাই। বসে আছে সে কবে থেকে এই বেডসাইড টেবিলে, যেমন থাকে নিরুক্ত কথারা, একা সঙ্গোপনে। ইলিনা হয়তো জানত কথাদের এই একলা যাপন, হয়তো জানত না। 
বস্তুত এ পড়ন্তবেলায়, সে ছিল একক। টেবিল ছিল, জায়গা ছিল না। খাবার রাখবে কই? ফলে সে খেত না। বিছানা ছিল, কিন্তু বই আর বই, সারাটা বিছানা জুড়ে। তাই শুতো না। ট্রেন চলে যেত। লম্বা একটা ট্রেন যেতে সময় লাগে প্রায় মিনিট তিন, জীবন আর একটু বেশিই হবে।  ট্রেন চলে গেলে পড়ে থাকে রেল লাইন, একাই, অথবা সমান্তরালে পাশাপাশি, স্পর্শ করবে না কেউ অপরকে। 
একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা মাঠ, একটাই গাছ, আর তাতে ভীড় করছে পাখির দল। না, পাখিও নেই। একা মাঠ আর একটা গাছ ব্যস, ওটুকুই। চোখে বুঝি পড়ত ইঁট,  কাঠ, সুরকি অথবা একটা গোটা কড়িবরগা। আর নেমে আসা অকাল অথবা ক্রমিক শ্রাবণ। সে পোড়াত নিজেকে রোজ। দহন যেখানে যতটা, পোড়াবেই। জল আর আগুনের সর্বনাম আসলে সর্বগ্রাস। সারা রাত জুড়ে আঁধারের বারান্দা জুড়ে, আগুন বড় আর ছোট হতো ক্রমশ। আ র ধোঁয়া যা প্রকৃত অমোঘ অনিশ্চয়তাকে নির্দেশ করে, উবে যেত বেমালুম। 
তাই সে জোগাড় করেছিল দড়ি। পাহাড় পেরোতে লাগে দড়ি। কাঁটা দেওয়া জুতো। পায়ে কাঁটা নিয়েই তো জীবন তোমার, আমার, তারও। জীবন যা যতটা অনতিক্রম্যতা তা পাহাড়ই তোসে নেয়নি স্লিপিং ব্যাগ। ঘুমনো সভ্যতায় ঘুমহীনতা জরুরী ভীষণ। কর্পূর নেয়নি, ভোলাটাইল কনসেন্স, থাকুক কিছুটা মানবতাও। সে নেয়নি ছোট করাত। আর কত কর্তিত হবে জীবন এ বেলাশেষে!  

তখন সকাল হয়নি বা হবে। সে বেরিয়ে পড়ল, তার টেবিল, বিছানা আর অপ্রিয় বনসাইময় ঘরদোর দুনিয়া ছেড়ে। উত্তরে যেতে গিয়ে থমকালো খানিক। উত্তুরে বাতাস তখন গায়ে কামড় দিচ্ছে, কিন্তু সে তো পাহাড়ের উচ্চতা অতিক্রম করতেই শুধু চায়নি। সে দক্ষিণে যেতেও থামলো। সমুদ্র কিছুই নেয় না, তবু ফিরিয়ে দেয় লোনা বাতাস, সে বাতাসে দু:খ মিশে থাকে। বেলাশেষের ভায়োলিনে এমনিতেই নুন মিশে থাকে, আর কি হবে অতিরিক্ততায়। সারাটা পশ্চিম জুড়ে ছিল নিরক্ত মরুভূমি। এ নিদাঘ তৃষ্ণায় আরো আর্তি? অসম্ভব। তাই পশ্চিমেও যাওয়া হয়ে উঠল না। পূবে তখন সূর্য উঠছে। পাপবিদ্ধ মধ্যবয়স্কর  তোই সে রওয়ানা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কে  যেন আসছে। কুয়াশা গায়ে মেখে। কে? চুল খোলা, দ্রুত চলাচল, চোখ দেখা যায় না এ কুয়াশায়, মুখে কি তাচ্ছিল্যর হাসিইলিনা? তবে কি ইলিনা 
না। ইলিনা আসেনি, আসে না। প্রকৃত এ মায়া দর্পনে, বিছানাকে টেবিল, টেবিলকে বনসাই, আর বনসাইকে বিছানা বানিয়ে সে উঠে গেল সোজা ছাদে। আকাশ তাকে ডাক দিয়েছে। হাত মেললো, ডানা জুড়ে গেলে ভালো হতো মানুষ প্রকৃত পাখি, দাঁড়ে বসে নড়াচড়া, পাখি হুস 
একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা মাঠ, একটাই গাছ, আর তাতে ভীড় করছে পাখির দল। না, পাখিও নেই। একা মাঠ আর একটা গাছ ব্যস, ওটুকুই। 
ল্যাটিচুড বা লঙ্গিচুড এক রেখে, চলে যাবার আগে বনসাইকে স্পর্শ করে সে লিখল টেবিল বিছানা বা বনসাই - এ জীবন আসলে মায়া, ইলিনা আসে না। এ মায়ার খেলার অংশ হিসেবে সে নিজেও কিছুটা প্রাকৃত, অপ্রাকৃত এবং মায়া হয়ে গেল, অংশত। আসলে এবসলিউট বলে কিছু কোথাও কখনো ছিল না।

1 টি মন্তব্য: