বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

মেঘ অদিতি

সময়ের ওইপাশে…



রমনার ঘাস বুকসমান উঁচু হয়ে উঠেছে। সে ঘাসের উচ্চতায় নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছে যে কিশোর, তার হাত ধরে আছে জুলাই মাসের বৃষ্টি। চলো মর্মর, কিশোরের হাত  ধরি এসো। এসো তার সাথে সময়ের ওইপাশে যাই।

মর্মর জানে না আর কতদিন এভাবে আগুন দাউদাউ জ্বলে যাবে বুকের প্রাচীর। মাথার ওপর উড়বে বোমারু বিমান। পথে নেমে আসবে জলপাইসবুজ ট্যাংক বহর আর কতদিন! জানে না। তের’র গেরোতে আটকে বুকে ধুকপুক নিয়ে মর্মর কেবল দেখে মার্চের খররোদ কীভাবে সরে গিয়ে মেঘে ঢাকে জুলাই মাসের ঢাকা। বৃষ্টি  আসে। বৃষ্টিতে কীভাবে মাথা উঁচু করে পাট বীজ অফিসের ফেলে যাওয়া বস্তাগুলো  ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা অসংখ্য বীজ। আর নির্বিচারে মানুষ মরে। জীবন থেমে যায়। জীবন কই, চারদিকে তো কেবল আগুন, কেবল রক্ত, কেবল হাহাকার! মর্মর ভাবে,  জীবন আসলে শহরের হৃদস্পন্দন যা থেমে গেলে পুরো শহরটার খুব অসুখ করে। এই যুদ্ধ তো এক অসুখই! সাথে জারি আছে যুদ্ধকালীন কারফিউ যা উঠে গেলে লোকজন  বাজারঘাট, দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনতে বের হয়, কিন্তু খুব দ্রুত বাড়িও ফেরে।  আতঙ্কের এক অবরুদ্ধ শহরে এখন তার বাস, তবু ওইটুকু তো সময় যখন একটু শ্বাস ফেলা যায়। মর্মরও শ্বাস ফেলতে চায়। বাড়ির লোকজনের নিষেধের চোখ এড়িয়ে সে তখন মাঝে মাঝে চলে আসে রমনার এই বুকসমান ঘাসের অরণ্যে।

ওদের বাড়িটাও অরণ্য প্রায়। এমনিতে গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে বাড়ি, তার সাথে  মাটিতে পড়া পাটবীজগুলো বৃষ্টি পেয়ে গায়ে বেড়েছে অনেক। দূর থেকে আজকাল বাড়িটাকে সহজে তাই বোঝা যায় না। মার্চের মাঝামাঝিও কিন্তু এরকমটা ছিল না। অন্তত মর্মর মিছিল চিনলেও জানত না, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন থেকে একাত্তরের  উত্থানে আসতে কতটা ক্ষোভের উত্তাপ জমাট বাঁধতে হয়। স্কুল থেকে ফেরার পথে দূর থেকে দুধসাদা দোতলা বাড়িটা দেখা যেত, স্কুলের ইউনিফর্ম ছেড়ে, স্কুলব্যাগ রেখে একছুটে সে তখন বিকেলের হৈ হৈ খেলার কাছে।
   
কোথা থেকে তারপর নেমে এলো একরাশ অন্ধকার। রাত তখন কত? জানা নেই। মর্মর ঘুমিয়ে। ঘুমের মধ্যে স্লো মোশনে ঢুকে পড়ছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার স্বপ্ন শ্লোগান। আর হয়তো সে দামাল কিশোর এগিয়ে আসা মিছিলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ঢুকে  পড়তে চেয়ে গভীর ঘুমের ভেতর পাশ ফিরছে। হঠাৎ তার সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি। ক্রমে তীব্র হচ্ছে তা। কেউ ডাকছে, শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘুম ভাঙাতে চাইছে। ঘুম থেকে ফিরে আসতে আসতে সে শুনতে পাচ্ছে ভাইজান বলছে, বিছানা ছেড়ে নেমে আসতে, মাথা নিচু করে তার সাথে পিছন বাড়ির দিকে যেতে। সদ্য ঘুম ভাঙা কিশোরমাথা বুঝছেই না - কী কেন কোথায়, অথচ ভাইজান তাকে বোঝার সুযোগ  দিচ্ছে না। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে কোথায়... কোথায় সে চলেছে...
  
আহ্ এত শব্দ কিসের, কেন ভেঙে যাচ্ছে রাতের স্তব্ধতা?

বাড়ির আলো নেভানো। দশ ভাইবোন একে অন্যকে জড়িয়ে। মা ফিসফিস করে দোয়া  ইউনুস পড়ছেন। বিনুর হাত ধরে থাকা মর্মরের হঠাৎ মনে হলো, সামনের বাড়ির দোতলার ঘরে ওর ঘুড়ির লাটাই ও ফেলে এসেছে। নতুন লাটাইটা আনতে ইচ্ছে করছে...শশ্‌ একছুট্টে যদি আনতে পারত, কিন্তু এখন তো রাত, আর বাইরে কী   তাণ্ডব হচ্ছে, ওকে কেউ বেরোতে দেবে কি! গুলির শব্দের সাথে অনেকের একসাথে পা ফেলার আওয়াজ আসছে। মর্মর কান খাড়া করল। শব্দ ঘন হচ্ছে। একসাথে অনেকগুলো পা... দরজায় মুহুর্মুহু করাঘাত... বাবা এগিয়ে গেলেন। ভাইবোন আরও  ঘন হয়ে মায়ের কাছে এলো। বাবা দরজার কাছে কান পাতলেন। রাজারবাগ পুলিশ  লাইন আক্রান্ত। থ্রি নট থ্রি হাতে অসংখ্য পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সে মুহূর্তে হতাহতর সংখ্যা কম নয়। যারা বেরিয়ে এসেছে তারা বাবার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। বাবা ডানপাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে বললেন। সকালে ঘুম ভেঙে মর্মর দেখল উঠোনের কলে ওযু করছে অনেক লোক।

জুলাই থেকে অক্টোবরের দিকে আসতে আসতে মর্মর সামান্য পরিণত হলো। এখন কারফিউ ভাঙলে সে বাজারে যায়। পথে টহলসেনা ডান্ডি কার্ড দেখাতে বললে রেশন কার্ড দেখায়। সেদিন বাজারে ঢোকার মুখে দেখল বেশ কিছু দোকান বোমায় উড়ে গেছে। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া পোড়া আলু তুলে তুলে খাচ্ছে ভিখিরি ও কাক। এসবে কিছুটা অভস্ত কি কিশোর চোখ... বোধহয় না, কেননা সে চোখ ফিরিয়ে নেয় দ্রুত।  অস্থির পা ফেলে হাঁটার গতি বাড়ায়। বড়দের ফিসফিস কথার মাঝে কান পাতে। বুঝতে চায় কী ঘটছে। মুক্তিসেনার বীরত্বের কথা ও শুনেছে, শুনেছে সীমান্ত  এলাকাগুলো ক্রমে মুক্তিবাহিনীর দখলে আসছে, শত্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে সেনানিবাস আর বড় শহরে ফিরে আসছে ভেতরটা থেকে থেকে টগবগ করে। মনে হয় এ অন্ধকার আর বেশি দিন নয়। আলো আসছে। হয়তো সরু অথচ তীক্ষ্ণ  একটা আলো এসে পড়বে সহসা আর এ অন্ধকার থেকে মুক্ত হবে সবাই। মুক্তি দুর্বার গতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এ কথাটা আজকাল ওকে আগ্রহী করে তোলে। ইচ্ছে করে ওদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে।

ডিসেম্বর আসে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে প্রতিটি দিন যুদ্ধের মোড় যেন ঘুরে যেতে শুরু করে। একটা প্রচণ্ড আলোর ঝলকানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা, মর্মর বুঝতে  পারে। ডিসেম্বরের পনের, হানাদার আত্মসমর্পণের জন্য আকাশে ভারতীয় বিমান লিফলেট ছাড়ছে। মর্মর এক দৌড়ে ছাদে। একে একে অন্যরাও। আকাশের দিকে তাকিয়ে আচমকা অমোঘ সেই শব্দ সে উচ্চারণ করে, জয় বাংলা!

পরদিন মর্মর সকাল থেকে কী এক টানে একবার ঘর একবার রাস্তায় নেমে আসে। দুপুর নাগাদ সে বড় রাস্তার মাথায় চলে আসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে লাইন ধরে পাক সেনারা হেঁটে যাচ্ছে আত্মসমর্পণের পথে আর বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি গাড়ির ভেতর থেকে শরীর বের করে দিয়ে বিজয় উল্লাসে কে চিৎকার  করে উঠছে, জয় বাংলা...

পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায়, মিশে যেতে চায় চামেলীবাগ থেকে রাজপথের দিকে এগিয়ে আসা জনতার মিছিলে 
আর তখনই গাড়িটাকে লক্ষ্য করে পরপর গুলি...  
মর্মর কানে হাত দিয়ে বসে পড়তে পড়তে আবার উঠে দাঁড়ায়
হাতের মুঠি আর চোয়াল দৃঢ় হতে শুরু করে ওর...




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন