নার্সিসিজম
তারপর একদিন তুমি এলে। না এসেই বা কী উপায় ছিল;
শিখীপুচ্ছচূড় কৃষ্ণের ন্যায় মনোহর শ্যামরূপ আমার, হেরাক্লিসের ন্যায় দানবদমনকারী
শৌর্য আমার, মহাদেবের ন্যায় রাগপ্রবর্তনকারী সঙ্গীতজ্ঞান আমার, ওদিনের ন্যায়
জাদুকরী প্রজ্ঞা আমার। আমিই সেরা প্রমাণ করার জন্য প্রাচীনযুগে যুদ্ধযোগে হরণ
করেছি প্রতিবেশী রাজার অপরূপা মহিষী, মধ্যযুগে দেশবিদেশের গ্রন্থাগার-সংগ্রহশালায়
হানা দিয়ে স্বহস্তে পুড়িয়ে এসেছি অপরের সৃষ্ট কতশত চিত্রকলা-দুষ্প্রাপ্য তুলোট
পাণ্ডুলিপি; অধুনাকালে যারা ভেবেছে তাদের ঈশ্বর আমার চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান,
ছলেকৌশলে তাদের দাঙ্গায় দিয়েছি ইন্ধন। আমার চাহিদাই বা কতটুকু? অসীম মেধা চেয়েছি
শুধু নিজের প্রশস্তিকাব্য রচনার জন্য, অনন্ত আয়ু চেয়েছি শুধু আরেকটু বেশি কাল
নিজের হাতে হাত রাখার জন্য, সোনার খনি লুট করেছি মাত্র নিজের রাজকীয় মূর্তি গড়ার জন্য।
আমি ভেবেছিলাম আমি তাপের ভয়ে লুকিয়ে থাকলে তুমি বৃষ্টি হয়ে এসে মাটির তলা হতে
জাগাবে আমায় কোনো কিশলয়ের উপমায়; আমি রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্রা গেলে তুমি খোলা
তলোয়ার হাতে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রক্ষা করবে আমায় হিংস্র শ্বাপদের রোষ থেকে; আমি
চেয়েছিলাম প্রতি জন্মদিনে আমায় উপহার দেবে রুপালী আয়না জরির মোড়কে। পরিবর্তে তুমি
চাইলে আমার শরীরী সাম্রাজ্যে সমানাধিকার, কামনা করলে আমার সমান্তরাল স্বর্ণ
সিংহাসন, আশা করলে নিজেকে ভুলে তোমায় একবার আদরের আলিঙ্গন, দাবী করলে আমার মুখ
থেকে শুনবে সর্বসমন্বয়ের বাণী।
এসব কি, বলো, আমি হতে দিতে পারি? হে দত্তাপহারী কন্যা,
মাধ্যাকর্ষণ মায়া ছেড়ে ছায়াপথে বিলীন হবার আগে, একবার শুধু বলো
না গো, ‘তোমার চোখে আজ জল কেন কঠিন? কেঁদো না, নইলে আজ মাঝরাতে শহরের বুকে ঠিক
তুষারপাত হবে কিন্তু!’
সাইকোপ্যাথি
কখনো যদি দেবলোক হতে
ছিনিয়ে আনি তোমাদের ভাগের প্রাপ্য আগুন আবার আমার যকৃৎ
উৎসর্গ করবে শাস্তিস্বরূপ? আকাশের সূর্যকে একবার ছুঁতে চাইলে আমার অকালপতনই
বিধেয় বলবে শুধু? কখনো আমার বিশ্বাস যদি টলে যায় বিধাতার সুবিচারে,
পাতালে দেবে নির্বাসন ? বহুকষ্টার্জিত
অমৃতের ধন যদি কোনো মোহিনীমূর্তি কেড়ে নেয় ছলেবলে, ধিক্কার জানাবে তো
আমার হয়ে? অথবা আমার ত্রিলোক সাম্রাজ্য যদি অধিকার করে
কোনো তুচ্ছ বামন কূটকৌশলে; প্রতারকের জন্য বুকে জমাবে তো একচিলতে ঘৃণার
বাষ্প, আমার প্রত্যাগমনের
পথে জেগে থাকবে তো বছরভর? যে দেবতা ক্রূর প্রতিহিংসায় ডোবায় ময়ূরপঙ্খী ডিঙি, মধুযামিনীর মাঝে
ঢোকায় নাগিনীর নিষিদ্ধ নিঃশ্বাস, তাকেই আবার আরাধ্যা
বানাতে বলবে না তো? সংকটকালে বীণা ফেলে কেমনে রাখিবো বীরধর্ম, যদি ভগিনীর
অঙ্গচ্ছেদের অপমানেও না মেলে ধরি স্বর্ণমৃগের মায়াজাল, না চূর্ণ করি মহাবিহঙ্গের দর্প যে ধৃষ্ট ধর্ম দেয়
না প্রেমের অধিকার; ধূলিসাৎ করি যদি তার স্থাবর সব বিগ্রহ, নির্লজ্জ
নিবেদনস্তম্ভের চূড়া কঠোর কালাপাহাড়
হয়ে? যদি কোনোদিন ঈশ্বরের
অচলতায় অতিষ্ঠ আমি, তার অত্যাচারী কবল থেকে স্বর্গোদ্ধার করি; একটানে সুখ সিংহাসন
সরিয়ে তাতে বসাই কোন মলিন মনুষ্যশাবককে, তবে, অধার্মিক বলো, কিন্তু আমায় অমানুষ বলবে না তো ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন