তিরভা মুদ্রিকা সার্ভিস সিরিজের তিনটি কবিতা
কালিকাপুর
একমাত্র তুমিই পারো সময়কে লাল বাতি দেখিয়ে
দাঁড় করিয়ে রাখতে, তুমিই তাকে বলতে
পারো রাস্তা বন্ধ, অন্য পথ খোঁজো।
অগত্যা গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে দেখি পেরিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের মতো পড়ে আছে নিভন্ত
কৈশোর। একদিকে এইটবি মোড়, অন্যদিকে কলেজ স্ট্রীট, এই দুইয়ের
মাঝখানেই কোথাও একটা নন্দন চত্বর রচনা করেছে এক সংক্ষিপ্ত ত্রিভুজ যার আদিগন্ত
গোলকধাঁধায় আমাদের যাবতীয় বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আর অভিমান আলোর সন্ধান করে করে
ক্রমাগত অন্ধ হয়ে যাচ্ছে... তবু চোখ বুঝলে আমি এখনও তোমার কালো হরিণ
চোখেই নিজের মরণ দেখতে পাই, কংসাবতীর পারের মতো তুমি কোনো এক রুক্ষ দ্রাঘিমায় পরিণতি হারিয়ে এ
বৈশাখে শুকিয়ে পড়ে আছো, তবু জল চাইতে তো তোমার কাছেই যাওয়া, ডুবে মরতেও তোমার ভরা স্রোতে। চল্লিশ দিন
নিরন্তর বৃষ্টির পর উড়ন্ত পাখির ঠোঁটের অলিভপাতা আমি গাঁথতে চেয়েছি ব্যক্তিগত
পরাজয়ের প্রতিটি মুকুটে আর ভেবেছি দেখতে পাবো বিশ্বচরাচরজোড়া রামধনুর উন্মাদনায় সমুদ্রের
ঢেউয়ের মতো প্রেমের বজ্রনির্ঘোষ, তবু সভ্যতার নিয়তিই তো যুগে যুগে আরো ভ্রষ্ট হওয়া। আমি তার
অংশীদার হতে চাই না, তোমাকেও চাইনি ওই কৃষ্ণগহ্বরে ফেলে রেখে যেতে, কিন্তু নক্ষত্রের ধর্মই পতন, পতনের ধর্ম ভালোবাসা... চক্রাকারে ঘুরতে থাকা প্রতিটি সত্যের থেকে আমি কোনোক্রমে
পালিয়ে এসেছি, বুঝিনি সেটাও
আসলে আরেকটা বৃত্ত-- তেমনভাবে প্রেম
ঢাললে আদিঅনন্ত আগুন-বরফ সমস্ত কিছুই এক হয়ে যায়, তোমার থেকে পালানো মানে যে তোমার কাছেই ফিরে আসা
কালিন্দী কুঞ্জ
ইদানীং আমার সেই সমস্ত নদীর সঙ্গে ভাব হয় যারা বাংলা জানে
না, বাংলা বোঝে না, এ জন্মে একবারও
আমার একটা লেখারও মর্ম বুঝবে না। এই অসহ্য
কবিপরিচয় দোমড়ানো কাগজের মতো জিনসের হিপপকেটে ঢুকিয়ে আমি বৌদ্ধ
পূর্ণিমার আশ্লেষে তাদের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়াই, আর তারপর কথা বলি ঢেউ, পাখি, বসন্তের ভাষায়। নিজের শরীর থেকে অদরকারি গয়নার মতো কবির শেকল আর বর্ম খুলে
ছুঁড়ে ফেললে অনেকটাই ভার কমে যায়। অনেকটা মুক্ত লাগে, অনেকটাই স্বাধীন, বেপরোয়া। কবিতা যত লিখতে
শেখায়, চুপ করতে বলে
আরো বেশি। তারাও তো ভালোবাসে
ভাষাহীন, শব্দহীন একজন
পাগল পুরুষ যার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই আগুনে সাঁতার কেটে দিনান্তে ফেরার মতো এক মুহূর্তের বর্তমান
আছে। ক্রমশ বুঝতে পারি সেই সমস্ত ভিনদেশী স্বপ্নদের সঙ্গে আমি
বেড়িয়েছি তেমনই একটি নৌকাবিহারে-- উন্মাদ উত্তাল স্রোত, তীব্র ঝড়, তাদেরই হাতে দাঁড়, পরিস্থিতি ক্রমশ দুঃসহ হচ্ছে আর চিৎকার করে তারা বলছে, খুলে ফ্যালো, খুলে ফ্যালো, বাঁচতে চাইলে ফেলে দাও যা কিছু ভূষণ পরে
আছো... না হলে এ তরী ডুববে, না হলে কীভাবে তুমি ডুবে যেতে পারবে বলো, ব্যক্তিগত ঈশ্বরের বুকে?
সত্যনিকেতন
কেউ একজন ফোনে বলছিল, পৃথিবীর অধিকাংশ কবি
জন্মগত সমকামী। স্যাফো, অডেন, গিন্সবার্গ, সেক্সটন উলফ... তোমার
মনে পড়ল, কেউ কেউ নয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি শিল্পীই তীব্র সমকামে লিপ্ত। আত্মনাং
বিধি, নিজেকে না ভালোবাসলে এক পঙক্তিও
রচনা সম্ভব? নিজেকে না ঘেন্না করলে? অন্য কোনো সঙ্গিনীকে যখন তুমি সোহাগে আপন করছ,
তার মধ্যে কি খুঁজে পাওনি নিজের হারানো টুকরো, নিজের বিচ্ছিন্ন কোনো রূপ? অথবা যখন
তুমি নিজের সঙ্গে নিজে একা, নিজের ভেতরের ওই রসপ্রিয় পুরুষটা আদর দিচ্ছ, তুমি তো
তখনও পুরুষ। নিজের স্বপ্নে ধারণ করছ ব্রহ্মাণ্ড ত্রিকালজ্ঞ ত্রিভুবন... এক ও
অদ্বিতীয় তুমি সমস্ত জীবন ধরে অন্যের স্থিতিতে নিজেকে আর নিজের ভেতরে অন্য কিছুর
সন্ধান করে যাচ্ছ, মাঝেমধ্যে বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছ, সেই ফাঁকে লিখে রাখছ ব্যক্তিগত
সভ্যতার অজানা ইতিহাস। এক হাতে লিঙ্গ আর অন্য হাতে ব্যবহার গুঁজে দিয়ে কেউ বা কারা
তোমাকে একটি ক্লীবত্বে স্বাধীন পুতুলের মতো নাচিয়েই চলেছে নাচিয়েই চলেছে... তুমি
নিজের থেকে দূরে পালাতে পালাতে নিজের আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছ, খাচ্ছ দাচ্ছ, ঘুম তাড়াচ্ছ,
অসতর্কতায় খুঁজে যাচ্ছ না পাওয়ার মার্গদর্শন আর অপেক্ষা করছ পাশের সীটে তেমন কোনো
ঈশ্বরীর, যার হাতে নিজের ধ্বংসের চাবি অনায়াসেই বন্ধক রাখা যায়, অনেকক্ষণ ধরে
ভাবছ, প্রতিটি কবিতাই তো আসলে ভীষণভাবে একা, এক প্রকার নিবিড় আত্মরতি
অসামান্য কবিতাগুলো। এক নতুন ভাষা। নিজের এই ভাষা ধরে রাখিস। এইটুকু আমার বাড়তি লাগল - "কবিতা যত লিখতে শেখায়, চুপ করতে বলে আরো বেশি। তারাও তো ভালোবাসে ভাষাহীন, শব্দহীন একজন পাগল পুরুষ যার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই আগুনে সাঁতার কেটে দিনান্তে ফেরার মতো এক মুহূর্তের বর্তমান আছে।"- এইসব বলে দেয়া হয়েছে অন্যান্য পংক্তিতে। অন্য ভাবে। [নিজের চিন্তাটুকু প্রকাশ করলাম মাত্র। ] ভালো থাকিস। আরো লেখা পড়াস।
উত্তরমুছুনকবিতাগুলি খুবি মনের কাছাকাছি। আনন্দ পেলাম।
উত্তরমুছুনকবিতাগুলি খুবি মনের কাছাকাছি। আনন্দ পেলাম।
উত্তরমুছুন