হেরম্বচরিত
আত্মগত
বড় কোনো নদীর মুখোমুখি এসে একসময় হেরম্বকে একা একাই
দাঁড়াতে হয়। নদী নদীর মতো। নদীর উদাসীনতায় লুপ্তপ্রায় পাখিদের কবেকার
ছায়াবিস্তারী ডানার গন্ধে ডানা ঝাড়বার শব্দে ন্যায়সঙ্গত সব গল্পগুলি জমাট বাঁধতে
থাকে। হেরম্ব কি গল্পের পর
গল্প হাতড়ে বেড়াবে! সে কি
গল্পের রেখা ধরে ধরে নদীর ব্যক্তিগতে খাত বদলে বদলে পলিমাটির উর্বরতায় বারবার
নির্মিত হতে থাকা শস্যময়
ঘ্রাণমুখর প্রাণচঞ্চল জনপদগুলির খুব গোপন কিছু তুলে ধরবে! অনিশ্চিতের নিরাপত্তাহীনতায় হেরম্ব কিন্তু বিচলিত
বিব্রত হয় না; সে তো প্রকৃতই এক ধরনের নির্লিপ্তি, ঔদাসীন্য
অর্জনই করে ফেলেছে। অর্জিত
অনুভূতিগুলি অতিক্রম করে আসবার প্রয়াস তাকে সক্রিয় করে তুলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট
সংশয় থাকলেও হেরম্বের ব্যক্তিগতে, নিভৃতিতে
সংকট থাকে না। সে কেবল উত্থিত
সতর্কতার দিকে সরাসরি চোখ তুলে তাকায়। এইভাবে
পুনরুত্থান ঘটতে থাকে সতর্কতারই। আলো
অন্ধকারের বহু ব্যবহারে জীর্ণ
বিদীর্ণ সময় ও নিসর্গকে হেরম্ব তার সমগ্র অস্তিত্ববাদ দিয়ে নানারকম দার্শনিক
প্রশ্নের জটিলতায় পৌঁছে দিতে চাইলেও বড় বড় নদীর নিঃসঙ্গতা পালা পার্বণের সঙ্গলাভের আশ্চর্য আকাঙ্ক্ষায় হেরম্বকেই
যেন দ্বিধা দ্বন্দের অপরূপ
মহাপৃথিবীতেই টেনে আনে। তখন বড়
নদী সংখ্যাহীন নদী টুকরো হয়ে মহাজীবনের
বিন্দুগুলিকে থরে থরে যেন সাজিয়ে দেয়; সাজিয়ে
দেবার অমোঘ প্রয়োজনীয়তায় এইসব স্বতঃস্ফূর্ততার
চৌম্বকশক্তি গতি হারিয়ে ফেললে হেরম্ব বড় নদীর, বড় বড় গাঙের ভিতর সহজাত ঢঙে আঁকতে থাকে মহাজীবনের
মহাপৃথিবীর আত্মগত জলরঙের ছায়াছবি। তবে কি
নতুন কোনো পথযাত্রার জন্য
নিজের প্রস্তুতিটুকু সেরে ফেলবে সে!
যাদুবাস্তবতা
দৃশ্যকে কি আর দৃশ্য
থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়! দৃশ্যের
বাস্তবতাতেই তো দৃশ্যকে আটকে রাখতে হয়। খড়ম জোতদার ধনবালা বর্মণ জলধোয়া বসুনিয়া মোল্লাবাড়ির ফজরের নামাজী জমায়েত মোরগ লড়াই সব কিছুই তো অনিবার্যভাবে
দৃশ্যের অতিপ্রয়োজনীয় দৃশ্য হয়ে আদ্যন্ত এক জীবনের গূঢ়গোপন বাস্তবতায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। তখন নদী বল কাদামাখা খেতখামার বল; বড় কোনো জোতদারী বিলে হাওরের বিশালতায় মানুষজনের সমবেত মাছ ধরবার ‘বাহমারা’
উৎসব পরব বল, সবই অতীত বর্তমান বাহিত দৈনন্দিন হয়ে
দৈনন্দিনতার বিষাদ কুয়াশা মিশ্রিত এক পর্বান্তরের দৃশ্য থেকে ছিটকে যাওয়া
দৃশ্যগুলির দৃশ্যের কেন্দ্রেই ফিরে আসবার বাস্তবতায় স্থির হয়ে বসে। তখন কলাবাগিচা নারকেলবাগান কফিখেত সরিসাবন
বন্যাপরবর্তী পর্বে হেঁটে যাওয়া চরাঞ্চলের চাষি জঙ্গলের গন্ডার বাইসন হাতি হরিণ
অন্তহীন পাখিদল বিষধর সাপ দৃশ্যের নির্ধারিত সংজ্ঞা ভাঙতে ভাঙতে দৃশ্যবিষয়ক আপাত সমর্থনযোগ্য নবীন বাটার পানের সাযুজ্যে বিস্মিতপ্রায় এক দৃশ্যায়নের সংজ্ঞাই লিখে ফেলতে থাকে। নিঃসঙ্গতায় বেঁচে থাকতে থাকতে ভোরের পৃথিবীর
অতীন্দ্রিয়তায় বিদ্ধ হতে হতে নিঃসঙ্গতাই জরুরী এক আশ্রয় হয়ে উঠতে চায়। চাওয়া না চাওয়ার সামান্য বৈধতা থাকলেও লোক মানুষেরা তাদের বসবাস যাপন ঘরবাড়ি নাচগান নিয়ে
অনবদ্য লোকজীবনকেই পুনঃস্থাপিত
করে; মেলা মহোৎসব ঘিরে সে এক অন্যরকম বাঁচা, জীবনযাপনের সেই স্বাদটুকু পাবার আকুলতায় ধনীবাড়ির
ভিতরখোলানে বৌ-ঝিদের গানের সুর স্থির থাকতে পারে না; আছড়ে পড়ে বাহির এগিনাতেও। এটাও কি তবে দৃশ্য থেকে ছিটকে আসা দৃশ্য যা ঢুকে
পড়বে দৃশ্যের ভিতরেই!
অতিপ্রাকৃতিক
প্রকৃ্তিকে তো
হেরম্ব কেবলমাত্র প্রকৃ্তি হিসাবেই ভাবতে, দেখতে পারে না। কেননা সে
তো নিজেই প্রকৃ্তির অংশ। হেরম্ব
হাজার হাজার মাইল দৃশ্যখণ্ডের লতাগুল্ম জড়িয়ে প্রকৃতির চিরদিনের চিরকালীনতা হয়ে
সদাজাগ্রত থাকে। তখন নদীর ওপর ঝুঁকে
পড়া মেঘমুক্ত আকাশ, নদীর
নীলজলের পাশে বাজনা বাজে; দোতরা
সারিন্দা বাজে। দলবদ্ধ নাচ হয়। নাচ ও গানের সেই মায়াময়তা নিয়েই তো প্রকৃতির
প্রকৃত এক প্রকৃতি হয়ে ওঠা। হেরম্ব
এইভাবে বলরামপুরের বাঁশপূজার মেলায় চলে যায়। কাতিপূজার গান শোনে। আদিবাসীদের ধামসা মাদল তাকে আর উন্মনা করে তুলতে
পারে না। সে তো জানেই নিজের
প্রাকৃতিক হয়ে ওঠার প্রয়াসের ফোঁকড় থেকেই সে বুঝে নিয়েছে বঞ্চনা শোষণ অধিকার হারানো ভাষা ভূমি সংস্কৃতি শেকড়ের সমূহ সংকটগুলি। সংকটজাত
অস্তিত্বলুপ্ত আত্মপরিচয় হারানো জীবনযাপনকে সে চূড়ান্তভাবে প্রাকৃতিক করে তুলতে
চায়। এখানেই তার
স্বাতন্ত্র। সেই
শ্রেণীস্বাতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই জীবন ও মৃত্যুর কালচক্রে সে লিপ্ত
করতে চায় মহাজগতের এক বিবর্ণ তন্ত্রপুস্তক। হেরম্ব তার প্রতিটি দেখা ভাবনা অনুভবকে অস্ত্বিতের সাহায্যকারী
উপাদানগুলিকে সঙ্গ-নিঃসঙ্গতায় জারিত করে এক জায়মান পৃথিবীকেই উপস্থাপিত করে। সংকট কেবলমাত্র সংকট হিসাবেই থাকে না তখন। প্রকৃতির বহমানতায় ধারাভাষ্যের আদলে ফিরে ফিরে
আসে নশ্বরতামুগ্ধ অতিজীবিত এক প্রকৃতির ক্যানভাস হয়ে। হেরম্ব প্রকৃতির অংশ নয় সমগ্র হয়ে ওঠে কোনো
একসময়। তখন সে আর হাটগঞ্জ, নদীবন, লোকায়তের মানুষজন, পথপ্রান্তর
সব কিছুই একাকার হয়ে
পড়ে। প্রকৃতির এই
অতিপ্রাকৃতিক হওয়ার মধ্যে হয়তো রহস্য থাকে, রদবদল থাকে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন