মল্লিকাজীবন
কোথায় গেল! কোথায়! আশ্চর্য! আমি কালও দেখেছি
সবগুলোই ছিল। আজ ভ্যানিশ! কী করে! দেখায় ফিরে যাই। জাল
দেখি, এখানে সেখানে। নাঃ! পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও না। মাথায় হাত। ডানা বেরোলে সবাই উড়বে। এতে আশ্চর্যের কী আছে! দেখো জাল ঘেঁটে ডানার টুকরো টাকরা পাও কিনা! অপরাধী একটা না একটা ক্লু রেখে যায় অজান্তেই। হ্যাঁ, সেই দেখেই কিরিটি
ব্যোমকেশ ফেলুদা ইত্যাদিরা লেগে পড়ে। ধরে ফেলে। কিন্তু জালে বন্দী গল্পরা কী করে! পাখা পেলেও
বা উড়ে যেতে পারে। উড়েছে যারা, অপরাধী বলতে কষ্ট এসে মুখ চেপে ধরে। বাতাস
আমাকে ঠেলে নিয়ে যায় অতীত উঠোনে।
আমিও তো একদিন, সেই জলপাইরঙা দিনে, উড়তে
চেয়েছিলাম। জাল থেকে, বেড়ার জঙ্গল থেকে, কঞ্চির খোঁচায় ক্ষরণের রক্ত নিয়ে। এখন এই
খোঁজের ক্ষণ বড় কষ্ট-কষ্ট বাঁশিসুরে ভাঙছে আমায়। মেঝেয় পড়ে আছে শত টুকরো আমি। শত থেকে সহস্রের
পরমাণু হয়ে আছড়ে পড়তে চেয়েছিল আমার সাইক্লোন কোনো এক সবুজ জলপাইরঙ দিনে। বাতাস ছিল
আমাকে লোফালুফির উন্মত্তে। সেখান থেকে, সেই অন্তর্গত ভাঙনের থেকে আমিও তো ওড়বার
স্বপ্ন দেখেছিলাম!
আবার ইঁদুর নিয়ে বসি। নিরুদ্দেশীদের ওড়া-চিহ্ন
খুঁজতে। পালকের টুকরো টাকরা। দেখি ছেঁড়া জালে রক্তাক্ত যাপন-চিহ্ন তারা রেখে গেছে।
ফেলে গেছে টুকরো সংগ্রাম। না, ‘হোয়ার দেয়ার ইজ উইল, দেয়ার ওয়ে’ - এই মাস্টারমী-মার্কা
মিথ্যেকে আমি মানি না। আমার ইচ্ছেকে আমি উপায়ের পথ করে তুলতে পারিনি, কেউ পথ করেও দেয়নি। জালগুলোর
পোক্ততার কাছে আমার ডানা হেরো ভূত। আমার হার মানার হারে ফুল বা মুক্তো ছিল না। কাঁটা-যন্ত্রণায়
অন্তরীণ আমি বিদ্রোহে ক্ষুদিরাম বিনয় বাদল দিনেশ হতে চেয়েছি, ছারখার
রিভলবারের হাত ধরে। পারিনি। মল্লিকার প্রথম কলিটা বিদ্রোহী ফুটে উঠতে গিয়ে শুকিয়ে গিয়েছে।
সার-জল, না, পারিনি দিতে। কেউ দিতে দেয়নি। একটা বোমার অভাবে আমি...
আরে! পাশের জানালায় একটা যেন খুশির হররা!
জা্নালামুখী আমার চোখ। দারুণ হতবাকে দেখি হারানো গল্পদের
পিঠে স্নিগ্ধ ডানা হল্লা-রোদ্দুরে ঝকঝকে। উড়ছে ওরা। রোদ্দুরে ভিজে, খোলা বাতাসে
গ্লাইডিং, খোলা আকাশের নীল-সাদায়, বৃষ্টিহীন শ্রাবণ মেঘের টৈ-টুম্বুরে। খুশির
ডানায় ওরা ‘পৌঁছে যাবার’ কবিতা লিখছে আকাশময়। আমি হুরর রে করে উঠি। আমার জীবন, আমার যুদ্ধ, আমার অন্তরীণ,
আমার আত্মহত্যা, জাল-অন্তর্জাল কেটে বেরিয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। আমার গল্পরা
সব কী যেন মন্তরে পাখি হয়ে গেছে। কারার লৌহকপাট লোপাট করার স্পর্ধা ওদের ডানায় ডানায়। চাষের
লাঙ্গলে নতুন মাটি খোঁড়ার আনন্দ আমায় পশমিনার ওম পোয়াতে ডাকে।
ওরা কি আমার মল্লিকা-জীবন! ব্যস্ত হয়ে পড়ি...। গান এসে গলা বাজিয়ে দেয়, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’। যা! যতদূর তোদের ইচ্ছে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন