শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

জিনাত ইসলাম

অশনি সংকেত

খবর শুনেই খুঁজতে থাকে মনে মনে পথ চলতে চলতে সুদেষ্ণা। না কিছুতেই ভাবতে পারছে না চেহারাটা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়? মিতাভ? ১৯৯৮ ব্যাচ? না তো! কেউ তো পড়ত না এমন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে তাদের সঙ্গে? কে জয়েন করবে তবে? মনকে বোঝায় সুদেষ্ণা, আরে কালই তো দেখা যাবে কে সে! বাড়ি  ফেরার আগে একরকম মনস্থির করে ফেলে সে যে কাল কলেজে না যাওয়া পর্যন্ত আর কিচ্ছু ভাববে নারাতে যথারীতি ডিনার করতে করতে টিভি দেখে সুদেষ্ণা,  কিন্তু একটা অস্বস্তি ধাওয়া করতে থাকে তাকে। জয়দীপের সঙ্গেও কথা বলার ইচ্ছে হয় না। ইউনিভার্সিটির আলব্যাম ঘাটতে ঘাটতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেই পারেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মনে পড়ে রাতের অস্থিরতার কথা। তাড়াতাড়ি রুমাকে গিজারের স্যুইচ দিতে বলেই শ্যাম্পু করতে ছুট দেয়। আজ আর স্যন্ডুইচ নয়,  এক্কেবারে দালিয়া খেয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। লাইনার, সাজগোজ এমনকি আররন করা ড্রেসও নয়, এমনিতেই যা বৃষ্টি ধুয়ে তো সব সারা। সারা রাস্তায় বৃষ্টিদিনের গাছের সবুজ দেখতে থাকে সুদেষ্ণা কী অসাধার প্রকৃতির রং! এমনি যদি হতো  জীবন! র্ণে বর্ণে পুষ্পে পুষ্পে শুধু সবুজ আর সবুজ ছেয়ে থাকত! আজকাল আর এসি গাড়ি তেমন টানে না এককালে খুব ক্লাস কন্স্যাস ছিল সে। এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষের প্রতি তার চরম ঘৃণা ছিল। এদের সঙ্গে একসাথে পথ চলাতেও তার মন আপত্তি তুলত। বিগত ৬-৭ বছরে স্নান করে বিতৃষ্ণা দূর করতে সে জল অপচয় করেছে একথা ভেবে নিজেকে সে এই সভ্যতার অপরাধীও মানে। জীবন বদলায়। ঘা শুকিয়ে যায়। দাগটুকুও মিটে যায় আজ আবার মনে হয় একটু হেঁটে হেঁটে ঘুরি ফিরি পথঘাট যেমনটা ছিল ছাত্রজীবনে। পায়ে জল লাগলে সুদেষ্ণা পারত না ক্লাসে যেতে পেশার প্রথম দিকটায়। গা শিরশির করে উঠত ঘেন্নায়আজ কিন্তু তেমন সমস্যা হয় না। পেশা ধর্ম-কর্ম আর তো পালানোর পথ নেই, তাই মেনে আর মানিয়ে  নিয়ে চলা।
      
একদম কাঁটায় কাঁটায় ১১টা। প্রিন্সিপল-এর ঘরের দিকে সবার চোখ। ভারী মেরুন পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এলো অমিতাভ দাস। দামী ফ্রেমের স্লিক চশমা, বাদামী কভার ফাইল, সাদাশার্ট, টানটান দেহ, পায়ে কালো স্যু। একদম মডার্ন আউটলুকের এক যুবক। না, একদমই অচেনা এই ছেলেটি সুদেষ্ণার কাছে। সবার সঙ্গে একে একে পরিচয় করার পর এবারে সুদেষ্ণার পালা। সে কিছু বলে ওঠার আগেই অমিতাভ অবাক করে দিয়ে বলে, চিনতে পেরেছ? সুদেষ্ণা এ হেন সম্বোধনে ঘাবড়ে গিয়ে বলে,  আমি আপনাকে চিনি? অমিতাভ বলে, জয়দীপ কোথায় এখন? অহ, আপনি  জয়দীপের বন্ধু? না, না আমি তোমার পূর্বপরিচিত। সেই  সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে দেখা হয় আমাদের। উত্তরপ্রদেশ সুদেষ্ণার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিচ্ছু না শোনার ভান করে বলে, জয়দীপ এখন হেইলসেঙ্কিতে পোস্ট ডক্টরেট করছে। অমিতাভ মৃদু  হেসে সাবাস বলে চলে যায়।

তারপর আর ভালো লাগে না কলেজে থাকতে সুদেষ্ণারহঠাৎ  অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ি ফিরে আসে। এমন ভেঙে পড়া চেহারা নিয়ে দিদিমনিকে অসময়ে ফিরতে দেখে  রুমার বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বলতে থাকে, দাদাকে একটা ফোন করি! এক ধমকে সুদেষ্ণা তাকে চুপ করায় এককাপ চা করতে বলে। ল্যাপটপ খুলে বসে সুদেষ্ণা মাথা  তুলে তাকানোর ক্ষমতা নেই তার। বুকে দলা পাকিয়ে ওঠে অসহ্য এক অতীত। যে  ছায়াকে  ঘৃণা করতে করতে সুদেষ্ণা ভুলেই গেছিল আসল ঘটনার কথা। অমিতাভর মুখশ্রী। ৬-৭ বছর পর তা বেরিয়ে আসায় সুদেষ্ণা তার মিসক্যারেজের যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। জয়দীপের ফটো আকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে সুদেষ্ণা রুমা দরজার বাইরে চিৎকার  করতে থাকে, দিদি দিদি, চা হয়ে গেছে, দাদা ফোন করছে!   
 
এমন চিৎকারে সংজ্ঞা হারিয়ে ছিল সুদেষ্ণা আজ থেকে অনেক বছর আগে। লুটিয়ে পড়েছিল তার দেহ ইউনিভার্সিটির খোলা মাঠের নির্জন চত্বরে কতক্ষ কে জানে! তারপর! এক এক করে দৃশ্য যেন সিনেমার পর্দার মতো চোখের সামনে এসে পড়ে সুদেষ্ণার

বোর্ড পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে সুদেষ্ণা অ্যাডমিশন নিয়েছিল সেন্ট্রাল  ইউনিভার্সিটিতে। ৩+২ কোর্সে। বাবা সব চিনিয়ে দিয়ে হস্টেলে সুদেষ্ণাকে সিফট করে প্রায় পনেরো দিন তার সাথে কাটিয়ে ফিরেছিলেন নতুন জায়গা খারাপ লাগেনি তার। সমস্যা ছিল একটিই। মেইন কাম্প্যাস থেকে ল্যাব ছিল একটু দূরে আর এই জঙ্গল ভরা জায়গাটা ছিল নির্জন। এইটুকুই মানিয়ে নিতে ছিল যা ভয়

প্রায় সাতদিন ক্লাসের পর সুদেষ্ণা বেশ স্বাভাবিক ফিল করছিল। বাবা ফোন করে সোমবার জানান, জয়দীপকে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে্নখুশি ছিল মন। সুদেষ্ণা ডেট মিলিয়ে নিয়ে দেখে, শুধু প্রাক্টিক্যাল ছাড়া তেমন জরুরী কিছু নেই মানে দারু করে ঘোরা আর মার্কেটিং হবে তার। বাবারা নামবে ৩টের সময়,  তখন সে এক ছুট্টে হস্টেল ঢুকে যাবে। ফটাফট প্ল্যান বানিয়ে ফেলে সে।

আজ খুব ভালো করে সাজে সুদেষ্ণা কতদিন পর জয়দীপ আসছে! ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখে বেশ ফাঁকা আছেসে এবার সোজা হাঁটা দেয় ল্যাবের দিকে। দেখে ঘাসগুলো  সব কাটা হচ্ছে। অনেক লেবার লাগান হয়েছে পথ জুড়ে। আনন্দে নেচে ঠে সুদেষ্ণা, বাবা আর কোনো চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরবে না! তার যা নি্যে ভয় ছিল, তা ও সল্ভ এগোতে থাকে সুদেষ্ণা একরকম ঘোরের মধ্যে। তারপর সে লক্ষ্য করে ল্যাবের দরজা  বন্ধ, সিনিয়র যারা থাকে কেউ নেই। খুব অবাক হয় সে। হস্টেলেরও কেউ নেই কেন? কাছে এগিয়ে দেখে নোটিশ ঝোলানো দরজায়। আজ  তো ক্লাস সাসপেন্ড! একমাত্র কাউন্সেলিংএর জন্য আসবে ছাত্ররা। এবার পিছন ফি্রে তার ভয় হতে থাকে। সব ফাকা লাগে তার তাড়াতাড়ি ব্যাগ নামিয়ে ফোন খুঁজতে  থাকে, কিন্তু পেছন থেকে কেউ তাকে খুব জোড়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ে সুদেষ্ণা বুকে ভর দিয়ে ওঠার আগেই অচেনা ভারী হাত তার ওড়না টেনে বেঁধে ফেলে তার দুই চোখ চিৎকার করতে থাকে সুদেষ্ণা। তারপর ছিঁড়ে যেতে  থাকে তার পোশাক। আসিডের মতো টপ টপ করে তার দেহে প্রবেশ করতে থাকে আগুনের কণা জ্বলে পুড়ে ছাই হতে থাকে সুদেষ্ণার দেহ। জ্ঞান হারিয়ে কোথায় পড়ে ছিল সে জানে না, তবে চোখ খুলেই দেখা হয় অমিতাভ দাসের সঙ্গে, হ্যাঁ আজকের অমিতাভ, যে তার নতুন কলিগ। অমিতাভ জেন্টস বাথরুম থেকে তাকে উদ্ধার করে চোখের ঢাকা খুলে। এই অমিতাভ দাসের পা জড়িয়ে ধরে সুদেষ্ণা বলেছিল, প্লিজ! কাউকে বলবেন না! আমার কেরিয়ারের প্রশ্ন আর আমার উড বি হাসব্যান্ড   জয়দীপ জানলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। আমি আজই এই ইউনিভার্সিটি ছাড়ছি। শুধু আপনি কোথাও কিছু বলবেন না।

অসংখ্য মিস কল আর ম্যাসেজ ভরা ফোন সুদেষ্ণার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল,  নিশ্চিত থাকুন, আমি এই কলেজের স্টুডেন্ট নই। আমি ভাইয়ের কাউন্সেলিংএ এসেছি। আপনি হস্টেলে ফিরে যান। স্নান করে তৈরি হয়ে নিন আজ তো কলেজ ছিল না! আপনি তো হস্টেলেইই ছিলেন!   
                    
        


1 টি মন্তব্য: