অভিষেক
তারপর তিনি বললেন - ঐ উজ্জ্বল অথচ অনাড়ম্বর প্রস্তরখন্ডে গব্য ঘৃত মাখাতে। কল্যাণীর চক্ষু মুদ্রিত। সে তার সমস্ত ভক্তি উজাড় করে ঘৃত মাখাতে শুরু করল দক্ষিণ হস্ত দিয়ে। তার বন্ধ চোখের ওপারে তখন সবুজ বনানী, কল্যাণী দৌড়চ্ছে ক্ষিপ্র হরিণীর ন্যায়। সে এক দুপুর পেরিয়ে বিকেল। হৃৎকম্প দ্রুত। দূরে কোথাও একটা ডোডো পাখি ডাকছে। পাখিটাকে খুঁজে বার করতেই হবে। দৌড় আর দৌড়, কার যেন হাত ধরেছিল সে, সে কোথায় এখন??? কেমন যেন
অসহায় লাগছে ভীষণ।
তিনি বললেন - আলোক বিচ্ছুরিত ঐ প্রস্তরখণ্ডকে মধু সহযোগে আবৃত করতে। বাম হস্ত দ্বারা দক্ষিণ হস্তকে স্পর্শ করে নিষ্ঠাভরে মধু দ্বারা প্রলেপিত করতে লাগল। তার মুদ্রিত চক্ষু বেয়ে নেমে আসছে অশ্রু। বন্ধ চোখের ওপারে তখন বৃষ্টি পড়ছে অঝোর। জলে জল মিশলে কখনো অগ্নুৎপাত হয়! সে জলজ জীবনে বড় আবিল আর্দ্রতা। আর আগুনও একই সাথে। জল বাড়ছিল। বাড়তে বাড়তে গলা অবধি। সে জলে নৌকো ভাসলো ঠিক তখনই। তর তর করে বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রবল তুফান। পাল ছিঁড়ল, কান্ডারি কই? পালিয়েছে?
তবু যাত্রা। হোক এলোমেলো, তবু সে উদভ্রান্ত যাপনের বর্ণ ছিল গাঢ় লাল।
তিনি বললেন - এবার পুস্প দ্বারা আবৃত কর। কল্যাণী সহস্র বর্ণময় পুষ্পে আবৃত করল প্রস্তরখন্ড। মুদ্রিত চক্ষুর ওপারে তখন কত ফুলেল প্রান্তর। মালিকা গাঁথার বিষয়ে কল্যাণীর ছিল প্রভূত আগ্রহ। তীব্রতাও ছিল, তবু তার বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য তাকে শিখিয়েছিল সংযম। পুষ্পবনে কী করে যেন প্রবেশ করেছিল দুষ্ট-দংশক কীট। যদিচ এ রঙ্গমঞ্চে কীটও ছিল ক্রীড়ার অংশ বিশেষ। দংশন কখনো ঋদ্ধতাও দেয়, তবু তা বড়ই পীড়াদায়ক। কল্যাণী বিভ্রান্ত হয়নি। স্থির ও নিস্তরঙ্গ এক নিশ্চিত অনিশ্চয়তায় প্রবেশ করছিল ধীরে ধীরে। নির্জন একাকী এ দংশিত ফুলেল যাপনের বর্ণ ছিল বিষবৎ নীল অথচ প্রিয়। তিনি বললেন - এবার দুগ্ধ, ধারাস্নান, তা যেন ছেদহীন হয়। চক্ষু উন্মীলন করল কল্যাণী। এ প্রকৌশলে চক্ষু উন্মোচনই দস্তুর। তার অন্তর্চক্ষু যদিচ তখনও ছিল অস্থির সকালের ন্যায়। ন্যাশপাতি বর্ণের সকাল। সে সকালে ছিল গোল্লাছুট, লাফানো দড়ি, কুমির ডাঙা, লুকোচুরি।
সেখানে পর্বত ছিল, ছিল আরোহণ; প্রতিটি আরোহণ ছিল আর্তিময়, বেদনাবিধুর।
ছিল খাদ যা ভয়াল অথচ প্রিয়। পর্বত যা কিনা পতনকেও তো নির্দিষ্টই করে! পিচ্ছিল অথবা রুক্ষ এ অভীষ্ট ইচ্ছার সকাল ছিল পুরু হলুদ।
এবার মুক্তি। মোহ হতে। মাধুর্য হতে। শর্করা দিয়ে মার্জনা করুন। কল্যাণী ঘৃত, মধু, দধি মুক্ত করতে দুগ্ধ সহযোগে স্নান সম্পন্ন করার পর শর্করা দ্বারা মার্জনা করতে শুরু করল। মোহ মুক্ত হও, কলুষতা মুক্ত হও। চক্ষু আবার মুদ্রিত। দুপুরের রোদ, সকালের অস্থিরতা, বিকেলের অবাঞ্ছিত তরণী বহমানতা এখন সন্ধ্যের স্নিগ্ধতায় প্রবেশিত। এখন রাত। অথচ এ নিষ্কম্প স্নিগ্ধ যাপন শুধু শ্বেত বর্ণময়। যা কিছু বাহ্যিক অথচ আবরণ, এ সময় উন্মোচনের। লজ্জ্বাহীন হও। বাম দক্ষিণ, অগ্র বা পশ্চাৎ-এর দিকে দৃকপাত নিবৃত কর। এ এক আদিম পবিত্র অন্তর উদ্ভাসনের কাল। পক্ককেশ পিতা, দন্তহীন মাতা, অজাত সন্তান রইল এ দৃশ্যের গোপন সাক্ষী। না সেই সব উদভ্রান্তকারী, চটুল ক্রীড়ামোদী ফেলে আসা সাথীদের এ দৃশ্যে আগমন নিষিদ্ধ।
কল্যাণীর কর্ণে এখন অপ্রবেশিত পাখির কুজন, নদীর বহমানতা অপ্রবেশিত, পর্বতের উত্থান অথবা পতন এ দৃশ্যে আসীন নয়। সমস্ত বর্ণের মিলনে এখন শুধুই শুভ্র শ্বেত এক পবিত্র উপস্থিতিই। তার নিশ্বাস এখন নির্দিষ্ট মাত্রায়, অবিচল।
-কল্যাণী!
স্থির নয়নে কল্যাণী তাকালো। তাঁর নির্দেশে সে ঐ প্রস্তরখন্ডে স্থাপন করলো বিল্বপত্র।
কল্যাণীর কর্ণে এখন অপ্রবেশিত পাখির কুজন, নদীর বহমানতা অপ্রবেশিত, পর্বতের উত্থান অথবা পতন এ দৃশ্যে আসীন নয়। সমস্ত বর্ণের মিলনে এখন শুধুই শুভ্র শ্বেত এক পবিত্র উপস্থিতিই। তার নিশ্বাস এখন নির্দিষ্ট মাত্রায়, অবিচল।
-কল্যাণী!
স্থির নয়নে কল্যাণী তাকালো। তাঁর নির্দেশে সে ঐ প্রস্তরখন্ডে স্থাপন করলো বিল্বপত্র।
কল্যাণী সান্যাল। বয়স ৩৮। সিক্স মন্থস - এবর্টেড, মিউচুউয়ালি সেপারেটেড এক প্রস্তরখন্ডকে অভিষিক্ত করল। অভিষেক হলো রুদ্র, প্রবল এবং পুরুষের - এই ধর্ষণ মুখর, তিমিরময় মৃত্যু উপত্যকায়। বড়
স্নিগ্ধতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল এই মধুময় ধরিত্রীর দিকে। বহুদিন পর তাকালো কল্যাণী তার
নিজের দিকেও। সে দৃষ্টি বড় মায়াময়।
চমৎকার
উত্তরমুছুনখুব অন্যরকম লেখা। ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন