লিলুয়া
এখানে লোক আসে, আইনক্সে সিনেমা দেখতে। নতুন জিনিস নিয়ে
প্রথম প্রথম শুতে বা প্রেম দেখাতে বা আদিখ্যেতা
করতে সকলের যেমন খুব ভা্লো লাগে, তেমন আর কী! এসব নতুন ফিতেবাঁধা র্যাপড মানুষজন
থেকে দূরে গিয়ে আমি প্রাচীন কিউরিও শপের মতো
স্টেশনে গাছতলা খুঁজে বসি। লোকজন পায়ে হেঁটে চলে, কেউ পাছা রগড়ে... এসমস্ত খুব সাদামাটা
সিনেমা, এবং ফ্লপ। আমি ছাড়া কেউ দেখবে না। ওই যে সিঁড়ি, সেখানেই শেষবার আমার দিকে
না তাকিয়ে উঠে গেছিল বড় হয়ে যাওয়া দ্যুতি।
আমি ট্রেনে ছিলাম। ওর উঠে যাওয়া দেখতে দেখতে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল।
ডাকটা বুকের মধ্যেই আটকে গেছিল। গতি তো সমস্ত সময়েই বদলেছে, এবং আওয়াজ! ধরা হোক,
বড়বেলার গতি বড় বেশি তাই আওয়াজটাও নৈঃশব্দের। এত শক্ত করেও বলতে চাইনি ঠিক। খুব সহজ
ভাষায় বললে, দ্যুতি সেই মেয়ে যে সব সময়
বলত, ওর মাথায় টিউমার আছে। ও খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবে, যাবেই। আমি একদিন ওর
বাড়িতে ফোন করে সত্যিমিথ্যে জানতে চেয়েছিলাম। তারপর দ্যুতির কপালে শনি-রবি-মার
বকুনি ইত্যাদি সব রকমই নেচে উঠেছিল।
এখন দ্যুতির সাথে দেখা হলে জানতাম, এমন কিছু তো করেনি ও,
ঠিকই ছিল। আমরা কী রকম অসহায়! ভা্লোবাসা / অ্যাটেনশান পাওয়ার জন্যে কী না কি করে
থাকি! সারা জীবনের কাছে তার জন্যে বকুনি, তার জন্যে গিল্ট, তার জন্যে মাথা
নিচু। তার জন্যে নিন্দে, বদনাম। তবুও আমরা জাস্ট ‘করে ফেলি’, ‘হয়ে গেল’র দোহাই
দিয়ে। এখন দ্যুতির সাথে দেখা হওয়ার কথা নয়, তাই আমি এখন sinসিনারি
দেখছি, সিনেমা দেখছি। এবং আমি এই মুহূর্তে অপেক্ষা করছি সেই ডাকটার জন্যে, যেটা আমার ডাকা হয়ে উঠল
না কখনও।
দ্যুতি বলত, আমার বাবা স্টেশনমাস্টার। কড়কড়ে দশ হাজার টাকা
মাইনে পায়। শুনে আমার খুব রাগ হতো। আমি
শুধু শূন্যগুলোর হিসেব করতাম। আর কতগুলো শূন্য বেশি হলে আমার বাবাকে ওর বাবার মতো
দেখতে লাগবে। দ্যুতি আমায় সবরকম ভাবে অপমান করত, বুলি করত, ভুলভাল অঙ্ক দেখিয়ে
আমার কাঁচা খাতা আরো কাটিয়ে মেরিট টেস্টে সোনার মেডেল আনতো। রাগে জ্বলতাম। এতকিছু হওয়ার পরও ওকে নিয়ে সব্বাই মজা করত, আমিও
করেছি। দ্যুতি আর ইন্ননীল। মিথ্যে গল্প, মিথ্যে বন্ধুত্ব, মিথ্যে প্রেম নিয়ে
দিনরাত প্যারোডি বানিয়েছি। পোড়া কনুই, গালের সাথে একদম চেপ্টে যাওয়া জন্মগত নাকের
নাম দিতেও ছাড়িনি সকলের মতো।
অনেক বড় হওয়ার পর যখন সব বন্ধুরা ছেড়ে গেছে, সে সময়
জন্মদিনে একবার আচমকা ফোন করেছিল। বেশি আনন্দে আমি ওর ফোন নম্বর চাইতেই ভুলে যাই।
বেশি কথা বলতেই ভুলে যাই আনন্দে। আমার বাড়ি, আমার এক্স, ওয়াই জেড, না-বন্ধুরা এবং আমি - কেউই আমার জন্মদিনে আনন্দ
তো দূর, মর্যাদাও দেয় নি কোনোদিনও। ঠিক এইখান থেকেই বড় হওয়ার সমস্ত জ্বলুনি চোখ হয়ে
যায়। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে শূন্য নামে। শূন্যের কোনো দাম নেই এই সংসারে। শূন্যের দাম শুধু জানে ‘আমার গণিত’, আর পাতায়
পাতায় নতুন কচি আম হয়ে ফুটে থাকে। আমি
অঙ্কে কাঁচা, গাছের নিচে বসে থাকি। ইন্টারমিশন নেমে আসে।
আজ যদি, আজ যদি আমি দ্যুতিকে জুলাইয়ের শেষ দিকে ফোন করে বার্থ
ডে বলি। যদি ফোন নম্বর আজও থেকে থাকে, ওকে
বলি... আমি আর রুদ্র। মিথ্যে গল্প, মিথ্যে
বন্ধুত্ব, মিথ্যে প্রেম – সব চরিত্র কাল্পনিক ছিল! হ্যাঁ, ওটা একটা বেঁচে থাকার
চেষ্টা, একা না হওয়ার চেষ্টা, লাইফ সাপোর্ট, আমিও সব্বার মতো হতে চাওয়ার চেষ্টা, চেষ্টা জাতে ওঠার। তুই কি জানতিস
না?! নাকি জেনে বুঝেই মিথ্যেটাকে সব্বার সামনে প্রশ্রয় দিয়েছিলিস! তুই নাকি আমার
রুদ্রকে প্রাইমারি ইস্কুলে অনেকবার দেখেছিস! আমি একটা মাথা গোঁজার মতো অস্তিত্ব
হয়ে গেছিলাম সেদিন!
আসলে শুধু আমি একা নই। সব্বাই ভাঙা; উল্কাপাত। দূর থেকে যাদের দেখে আমরা আলো আলো ভাবি, তারাও কেউ জীবিত নয়। এবং আমরা এই করে ওই করে তাই
করে ক্ষয়ক্ষতি, ভিক্ষা, নিন্দেমন্দ, বদনাম, অপমান, গ্রুপিজম, চালাকি, অসভ্যতা, মিথ্যে,
ব্লেম সেম, অহংকার, চক্রান্ত করে করে কিসের জন্যে ভেঙে পড়ে আছি? ভাঙা বলেই, এই
ভাঙা রাস্তা দিয়েই একদিন আলো ঢুকবে। দেখে নিস, ভুল রাস্তা ঠিক রাস্তা...
সবটাই ভালোবাসা আর ইনসিকিওরিটি, দ্যুতি!
(ঋণ - আর্নেস্ট হেমিংওয়ে,
কোহেন, কাজল সেন এবং যারা আমায় শত্রু ভাবে, যারা পছন্দ করে না।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন