রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

অলোকপর্ণা

একা চিল



একা চিল

সবাই তখন ঘর খুঁজছে -- অ্যাটাচড্‌ বাথ, দু'কামরা আলো বাতাস, সে এসে দাঁড়াত   অন্যমনস্ক ব্যালকনিতে। উঁচু থেকে সমস্তই এত ছোট দেখায় যে নিজেকে ভুলে যাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। ওরা সবাই যখন ঘুরে ফিরে ওয়ার্ড্রোব, গিজার, সেমি ফার্নিশড --  সে ভুলে যেত। সে ভুলে যেত কোথায় আছে। বেঁচে যে আছে, তাও ভুলে যেত।  উচ্চতা দেখে তার ইচ্ছে হতো -- ইচ্ছে হতো ঝাঁপ দেওয়ার। সেই ইচ্ছে অনেক নিচে      মাটিতে আছড়ে পড়ার, না মাটি ছুঁয়েই ফের উড়ে আকাশে উঠে আসার, সেটা সে এখনও পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। তাই সে আজও বারান্দায়, সে আজও ব্যালকনিতে। রাত দুপুরে যে কোনো বারান্দাতেই অনায়াসে তাকে মানিয়ে যায়। দেখে মনে হয়, রাতের বারান্দাগুলো যেন তার জন্যেই তৈরি, সূর্যের আলো লাগতেই যে সব বারান্দা অল্প অল্প করে উবে যেতে থাকে, সবার ঘুম ভাঙার পর রাতের যে সব বারান্দার কোনো অস্তিত্বই আর থাকে না।

মাথার বালিশ জানে সকল দুরূহ স্বীকারোক্তি

সমস্ত রাত সে কেঁদেছিল। এই তো পাশে শুয়েই, সমস্ত মৃতগর্ভ, অবৈধ স্বপ্নদের নিয়ে। তার বালিশই কেবল জানত সে সব কান ফিসফিস। তাকে বিব্রত করা যে আমার ‘জীবনধর্ম নয়’ -- তা আমার জানা ছিল। তাই ঘুম আসেনি। শুধু ভোররাতে  নেমে এসেছিলাম তার পায়ের পাতায়, মাথা পেতেছিলাম। ক্ষমার মতো ঘুম নেমে  এসেছিল তার চোখ থেকে আমার চোখে।
সে সব অলৌকিক ভোরে, ঘুমের ভুলে চোখ খুলতেই তার চোখ এসে বসত আমার চোখে, পালক খুঁটে খুঁটে স্বপ্ন বার করে আনত, তারপর উড়ে গিয়ে বসত রাতশেষের প্রায় আবছা হয়ে আসা বারান্দার রেলিঙে, সেখান থেকেই তারপর তার অলৌকিক উড়ান।
এখন, বিছানাময় অভিমানী পালক, মাথার বালিশে শুধুই ব্যর্থ নখের আস্ফালন।

মা নিষাদ

তীর এসে বিঁধেছিল তার সেই পায়ে, তারপর অটো করে হসপিটাল, স্ট্রেচারে করে এমার্জেন্সি। ওড়না লাল করে বি পজিটিভ রক্ত এসেছিল। যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরতে দেখি পালক ঝরে ঝরে পড়ছে, পিঠে হাত দিতে বুঝি একা চিলের ডানাদুটো আর নেই, শিরদাঁড়ায় দুরূহ তীর বিঁধে আছে। সাততলা থেকে চেঁচিয়ে উঠলাম, মা নিষাদ! সাথে সাথে বুক বরাবর এসে বিঁধল তীর। কাগজের চিল হাওয়ার সাথে পাক খেতে খেতে, পাক খেতে খেতে নিচে ঝরে পড়ল, মাটির বুকে একা চিল। তার পর পরই আমি  আমাকে ঝরে যেতে দেখলাম, ফুলের শব্দে।
সে সেরে উঠেছিল, ধীরে ধীরে, শুধু পায়ে হাত বোলালে পাঁচটা স্টিচের কাটা দাগ মুচকি হেসে উঠত আরাম পেয়ে।

সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী থাকে? মাসে মাসে কিস্তির টাকা, ফ্রিজের দাম,  ইত্যাদি ইত্যাদি

“কাবার্ডে দেখিস তো মেরুন জ্যাকেটটা ফেলে গেছি কি না...”
“দেখেছি কাবার্ড, কই, পাইনি তো”
“আচ্ছা, তাও দেখিস”
“হুম”
“আর কিছু ফেলে গেছি কি?”
“আর কি?”
“আর কিছু? আর কিছু ফেলে যাই নি তো?” তুই হাতড়াচ্ছিস।

ঘুম ভাঙতে ব্রাশ তুলে নিই, ব্রাশ করি, করা হলে ব্রাশদানিতে ফিরিয়ে দিই।
তৈরি হতে হতে আয়নার সামনে দাঁড়াই।
দরজায় চাবি লাগানোর আগে টবের গাছটাকে বলে যাই, “আসি।” চোখ ঘরময় একপাক ঘুরে নেয়, আমি দেখি -- তুই ফেলে গেছিস -- ব্যস্ততায় তৈরি হতে হতে  ব্রাশদানিতে ব্রাশের একাকীত্ব, ব্যস্ততায় তৈরি হতে হতে আয়নায় একে অন্যের চোখ খুঁজে ফেরা, ব্যস্ততায় তৈরি হতে হতে হাতে চলে আসা চুলের ক্লিপ, ব্যস্ততায় তৈরি হতে হতে বাতিল কাগজের মধ্যে থেকে জেগে ওঠা মাসকাবারির পুরনো হিসেব।

আমাকে, আমাকে, আমাকে, আমাকে, আমাকে, আমাকে -- মাঝরাতে ঘুম ভেঙে  ফাঁকা ফ্ল্যাট চেঁচিয়ে উঠছে -- আমাকে ফেলে গেছিস!

আয়নায় ঝুলে থাকা আমার ছায়া মৃদুস্বরে বলে উঠল -- আমাকেও তো...

“প্রেমহীন - ক্ষমাহীন”

ময়দান ঘিরে দ্রুত ছুটছে ঘোড়ার গাড়ি, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ট্রাম -- গা  ভর্তি এল. আই. সি. ‘জীবনানন্দ’ প্রকল্পের উল্কি পরে। এ কী করুণ শাস্তি দিলেন  ট্রামদের, জীবনানন্দ! আমি চোখে পরে নিই আমার সানগ্লাস, যার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা একই সঙ্গে রোম্যান্টিক আর বিবর্ণও। আজকাল সানগ্লাসের বদলে ডাকা হচ্ছে শেডস্‌ -- ছায়া, সে যে কতটা ছায়া আমায় দিচ্ছে, তা বুঝে উঠতে পারিনি বলেই  সানগ্লাসটা খুলে রাখা যাচ্ছে না। আবার সানগ্লাসের দরকারটা আমার বেশি, না  পৃথিবীর -- সেও এক ভাববার বিষয়।

ঘরে ফিরে মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়াই, দাঁড়াই এসে একা ব্রাশের সামনে, ওকে দেখে মায়া লাগে, এ ঘরে বোধহয় ওর চেয়ে একা আর কেউই নেই। রোজ ভাবি কাল আরেকটা ব্রাশ কিনে এনে ঠিক বসিয়ে দেব ওর পাশে, এমনিই -- অন্তত সে  সুযোগ যখন আছে... 

২টি মন্তব্য: