মুখুজ্জে-বাঁড়ুজ্জে-বেবী ও প্রসাদ
কবিগুরু শ্রীরামপ্রসাদ সেন-এর শ্রীচরণে
কলামন্দির ও একটি গান
শীতের কলকাতা। আলমারিতে সারা বছরের জমে থাকা
গরম জামা বের ক’রে গায়ে চাপাতে শুরু করেছে শহুরে বাঙালি। এরকমই এক শীতের সন্ধ্যায়,
ভিড়ে ঠাসা কলামন্দির। কবীর সুমন মঞ্চে। ষাটোর্দ্ধ প্রৌঢ়। গীটার হাতে চেয়ারে আসীন।
মঞ্চের আরেকদিকে রাখা কি-বোর্ড। গাইতে গাইতে, কথা বলতে বলতে উঠে যাচ্ছেন। গাইছেন।
কথা বলছেন।
‘‘আলোগুলো সব নিভিয়ে দাও হে। সামনে আমার
সন্তান প্রতিমেরা। অন্ধকারে বাঙ্ময় হয়ে উঠুক ওদের মুখ। আমি চোখ বন্ধ ক’রে ওদের মুখ
দেখতে চাই।...’’
কি-বোর্ড ছেড়ে গীটার তুললেন সুমন। গাইছেন—
‘রামপ্রসাদের ভিটের কাছে
আমার গীটার স্বপ্নে নাচে
বল মা তারা দাঁড়াই কোথা’র তালে...’
‘আমার গীটার স্বপ্নে নাচে’, এই অব্দি ঠিকই ছিল সব। ‘বল মা তারা’-র জায়গাটায় যেই না এলেন, অমনি রামপ্রসাদের আসল গানটা গাইতে শুরু করলেন সুমন। নিজের
গান গাইতে গাইতে অনেক সময়েই তিনি গানের কথা ভুলে গেছেন, অতীতেও হয়েছে। কিম্বা, গাইতে
গাইতে, গানের মাঝখানেই চলে গেছেন অন্য গানে। এদিনই যেমন, শুরুতেই গাইছিলেন, ‘টুক
ক’রে আলো দেখা/টুকি দেওয়া রোদ্দুরে আমি...’। সেই গানেরই মাঝখানে এসে, ‘পাশের বাড়ির মেয়ে/তার
মুখে তোমাকেই জান/খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেছি/শ্যামল মিত্তিরের গান/কি ক’রে গাইতো ভাবি
মানুষটা অমন গলায়...’ এইটুকু গেয়ে চলে গেলেন শ্যামল মিত্রের ‘তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম
ওই কূলে / ওগো যখন তুমি এলে আবার...’ গানে। দু’লাইন সে গান গেয়ে আবার ফিরে এলেন মাঝপথে ছেড়ে যাওয়া নিজের গানে। কিন্তু এ তো সেরকম
কিছু নয় বলেই মনে হচ্ছে। ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা’-র জায়গাটাকে সুমন ওঁর নিজের
গানে অন্যরকম সুরে রেখেছিলেন। কিন্তু আজকে যখন এই জায়গাটায় এসে রামপ্রসাদের আসল
গানটা ধরে ফেললেন, তখন ওঁর মুখ, মাথা নাড়ানো দেখে তো মনে হচ্ছিল উনি নিজের গানটা,
নিজের সুরটাই গাইতে চাইছিলেন আসলে। কিন্তু ভুল ক’রে ধরে ফেললেন রামপ্রসাদের গানটা। এবং কিছুতেই আর কোনোভাবেই
চেষ্টা করেও নিজের গানটায় ফিরতে পারছেন না। দর্শকের আসনে ব’সে ব্যাপারটা কী হচ্ছে পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল না ঠিকই,
কিন্তু খট্কাও লাগছিল। রামপ্রসাদের নিজের সুরে
সেই ‘বল মা তারা’ গানটাই
সুমন গেয়ে চলেছেন। এবং ক্রমাগত মাথা-চোখ-ভুরু নাড়িয়ে যাচ্ছেন। যেন তিনি এ’ গান
গাইতে চাইছেন না, কিন্তু গেয়ে ফেলছেন। নিরুপায়।
‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা
আমার কেউ নাই শঙ্করী হেথা
মা'র সোহাগে বাপের আদর,
এ দৃষ্টান্ত যথা তথা
যে বাপ বিমাতারে শিরে ধরে,
এমন বাপের ভরসা বৃথা
তুমি না করিলে কৃপা,
যাব কি বিমাতা যথা
যদি বিমাতা আমায় করেন কোলে,
দূরে যাবে মনের ব্যথা
প্রসাদ বলে এই কথা, বেদাগমে আছে গাঁথা
প্রসাদ বলে এই কথা, বেদাগমে আছে গাঁথা
ওমা যে জন তোমার নাম করে মা...’
প্রসাদী গানের তিন ভক্ত, আমরা, মানে অনুপম মুখুজ্জে, অমিতাভ প্রহরাজ
উর্ফ বেবী, আর এই আমি বাঁড়ুজ্জে। এই তিন বাউন সেদিন কলামন্দিরে, পাশাপাশি। যুগপৎ
চমৎকৃত। বিস্ময়। গানটি গাওয়া হ’লে, দৃশ্যত বিব্রত সুমন, আধ ঘন্টার বিরতি নিলেন।
আমরা, বাইরে দোতলায়। কফি, স্যাণ্ডউইচ। নিচে, সিগারেট। এবং তিনজনেই চুপ। শিশিরে চুল ভিজছে। প্রহরাজ, ওঁর
পিঠের রাজকীয় উচ্চতা ও প্রস্থশীল প্রচণ্ডতম ভারী ব্যাগটি নিয়ে রাস্তার ওপারে, যেতে
উদ্যত ইতিমধ্যে। বাঁ-হাতে তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে তখনও সিগারেট। ডান হাতটি ডান
পাছার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করতে আপ্রাণ চেষ্টারত। চেষ্টার ফলে ওঁর বিরাট ও
বিপুল ব্যাগ এবং শরীরের ঊর্ধ্বাংশে
যুগপৎ ঝাঁকুনি। এবং সেই অবস্থায়, রাস্তার গাড়িগুলোকে ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে কাটাতে
কাটাতে প্রহরাজ ওপারে, ফুটের দোকানটির দিকে যাওয়ার একটা প্রোজেক্ট নিয়ে ফেলেছে। মুখুজ্জে
সিগারেটের শেষটুকু টানতে টানতে বার-দুয়েক ‘বেবী...বেবী’ ক’রে ডাকলো বটে, কিন্তু
বেবী প্রহরাজ ততক্ষণে রাস্তার মাঝখানে পিঠে অতবড়ো ব্যাগ সমেত একটি ধুন্ধুমার কাণ্ড
ঘটিয়ে ফেলেছে। আমরা দুজন, এপারে, উশখুশ। আধ ঘন্টা শেষ হতে চলল। মুখুজ্জে হঠাৎ, গুনগুন ক’রে উঠলো সুমনের গানটা। ‘রামপ্রসাদের ভিটের
কাছে...’। এবং ঠিক ঐ লাইনটায়, ‘বল মা তারা’-য় এসে সুমনের মতোই একইরকম ভাবে
রামপ্রসাদের মূল গানটা ধরে ফেললো। মুখুজ্জে গান থামিয়ে বলছে—
- কী ব্যাপার অর্জুন? সুমনের গানটা গাওয়া যাচ্ছে না
কেন কিছুতেই?
- গাওয়া যাচ্ছে না মানে?
- আরে আমি তো সুমনেরটাই
গাইতে গেলাম। কিন্তু রামপ্রসাদের ‘বল মা তারা’-টা চলে আসছে খালি
- মানেটা কি
- তুমি গাও তো
ধরলাম গানটা। এবং কী অদ্ভুত! আমারও একই হাল।
প্রহরাজ ইতিমধ্যে শিখর-তুলসী-গুট্খা মুখে পুরে এসে গেছে। আমরা দুজন,
মুখুজ্জে-বাঁড়ুজ্জে, শীতের সন্ধ্যায় শার্লক হোমসের ওভারকোটের পকেটটা খুঁজছি তখন, গান
রহস্যের কিনারা পেতে। আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা-ভোম্বল মার্কা মুখ দেখে, প্রহরাজ মুখ চাওয়া-চাওয়ি
করছে আমাদের। মুখের গুট্খা আর তোত্লামি ঠেলে কিছু যে বলবে, তা-ও পেরে উঠছে না
বেচারা। আমি তখনো গানটা গাইবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মুখুজ্জেই বলল, ‘অর্জুন, এখন
থাক। মানে, এখানে থাক। আর বেবী, আমরা আর ভেতরে যাচ্ছি না। রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। চল,
ডেরায় ফেরা যাক।’ প্রহরাজ বুঝে উঠতে পারল না পুরো ব্যাপারটা। মুখুজ্জে কথাগুলো বলেই
পেছনে ঘুরে একটা ট্যাক্সি ডাকল। ‘নো
রিফিউজাল’। রাস্তার মাঝখানে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে প্রহরাজ ট্যাক্সিতে উঠতে গেলে
সাধারণত ছোটখাটো একটা যানজট সৃষ্টি হয়। ইহাই কলিকাতার ট্রাফিক রুলস্। কেননা, ওর
বিরাট ও বিপুল ব্যাগ এবং ও নিজে, এরা দুজনেই যুগপৎ ট্যাক্সির ভেতর সেধোতে চায়।
ফলে, একটা ধ্বস্তাধস্তি ও আন্দোলন তৈরি হয় ট্যাক্সির দরজায় ও বেবীর শরীরে। এবারও
তার ব্যত্যয় হলো না। কতগুলি যানবহুল একটি জট এবারও তৈরি হলো। সামনের সীটে মুখুজ্জে বসেই, ড্রাইভারকে বলল, ‘চল শাম্বাজার’।
ট্যাক্সি শেক্সপীয়ার সরণি ছেড়ে বেরুতে, প্রহরাজ বলল, ‘আ-আ-আমরা চ্চলে
এলাম কেন?’ মুখুজ্জে জানালার কাচটা নামাতে নামাতে বলল, ‘কবিরঞ্জন’। উত্তরটা মনোঃপুত হলো না প্রহরাজের। কিম্বা বুঝতে পারেনি হয়তো। জিগ্যেস করল, ‘এটা কি ফেসবুকের কমেন্ট অনুপম? কবিরঞ্জন মানে? কবি রঞ্জন মৈত্র?’ মুখুজ্জে— ‘মৈত্র নয়। সেন।’ প্রহরাজ একটা মোক্ষম
কিছু বলতে যাচ্ছিল। পারল না। ফোন বাজছে। কোন পকেটে? এক-তিন-পাঁচ-সাতটা পকেট হাতড়ে ফোনটা
যখন প্রহরাজ খুঁজে পেল, ততক্ষণে রিং থেমে গেছে। কল ব্যাক ক’রে, ‘হ্যাঁ... এই তো
আমরা ট্যাক্সিতে... না না, আগেই বেরিয়ে এসচি... শরীর? শরীর তো ঠিকই আচে... না না,
অনুপম-অর্জুনের কি একটা প্রব্লেম হয়েচে... বুজতে পারচি না... আরে না, তোর কতা
বুজতে পারচি, ... ওদের কি প্রব্লেম হচ্চে সেটা বুজতে পারচি না... হ্যাঁ হ্যাঁ,
আমরা একসাথেই তো... এই তো ট্যাক্সিতে... শ্যাম্বাজার... ওক্কে.. চঃ... টাটা টাটা
টাটা’। ফোনটা ডান পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে প্রহরাজ বাঁপাশে আমার দিকে ঝুঁকে, ‘বাংলা
খাবি তো?’ আমি— ‘খেলে তো ভালোই’।
শ্যামবাজার পৌঁছে এক এক
ক’রে যা কেনা হলো—
১/ তিন বোতল বাংলা। ২টো জয়বাংলা। ১টা লিডার।
২/ গোল্ড ফ্লেক। ছোট। চার প্যাকেট।
৩/ ৬টা রুটি। তর্কা।
৪/ স্প্রাইট। ১টা। বড়।
৫/ ২লি. জল। ২ বোতল।
সুধী ও রসিকজনে অবগত আছেন, প্রহরাজের এই ডেরাটি একটি ভুতুড়ে আবাস। বিবিধ
প্রেতকুল এখানে থাকেন। তাঁদের বিবিধ চিহ্ন ও লেশ ও উপস্থিতি নানাভাবে এখানে প্রকাশ্য।
নিচের গেটের কাছে
পৌঁছে প্রহরাজ লাইটার বের করল। লাইটারের পোঁদে একটি মিনি-টর্চ। জ্বলল। ব্যাগ থেকে চাবি বেরুলো। তালা খোলা হচ্ছে।
মুখুজ্জে— বেবী!
বেবী—হুঁ?
মুখুজ্জে— তোমার কাছে এখানে
রামপ্রসাদ রচনাবলী আছে?
বেবী— কেন?
আমরা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে উঠছি। অন্ধকারে লাইটারের পোঁদ সহায়।
মুখুজ্জে— লাগবে
বেবী— ন্ না, না... লাগবে
না। আমি ট্টর্চ ধ’রে আচি
আমি— ওহ্... সে লাগা নয়
বেবী— বুজেচিরে গাণ্ডু।
কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন
মদ্যপান ও রামপ্রসাদ
একটা খালি জলের বোতলে প্রহরাজ বাংলাটা মেশাচ্ছে। জল ও স্প্রাইট
সহযোগে। ডান হাতে বাংলার বোতলটা ধ’রে ঢালছে।
প্রহরাজ/বেবী— এই,
রামপ্রসাদ কি খুব অহংকারী চিলেন?
আমি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। মুখুজ্জে এক চামচ গরম তর্কা মুখে দিয়ে বলল,
‘টু পয়েন্ট সূচের মতো নয়’।
আমি— খুলে বলো
মুখুজ্জে আরেক চামচ তর্কা
নিল। আরে ‘সেই রোদই তো
আসল যা আলো মেশালে ফিকে হয় না’। ব’লে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালো।
বেবী— এগুলো তো অনুপম
পারসেন্ট অনুপমের লাইন অনুপম
মুখুজ্জে— এগুলো তো
রামপ্রসাদ কি খুব অহংকারী ছিলেনেরও উত্তর বেবী
বেবী— কি ব্যাপার বলো তো
অনুপম? তখন কলামন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলচিলে রহস্য ঘনীভূত হচ্চে। এখন তুমিই কতা বলচো
রহস্য ক’রে...
মুখুজ্জে— আসলে বেবী
ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো
বেবী— আমাকে ব্যাপার বোজাতে
এসো না প্লীজ
প্রহরাজের এ’কথা শুনে আমরা দুজনেই হাসছি এবারে। আমি বললাম— ‘না, আমার মনে হয়, এখন তো আর চাইলে রামপ্রসাদকে
পাওয়া যাবে না। কিন্তু, আজকে শহরে একটা ঘটনা ঘটেছে। অন্তত, আমাদের সাথে তো ঘটেইছে।’
বেবী— ঘটনা? কী ঘটনা?
আমি— একটা গানে কোনোভাবে রামপ্রসাদ ঢুকে
পড়েছেন...
বেবী— ঢুকে পড়েচেন মানে?
আমি— মানে, গানটাকে উনিই চালাচ্ছেন
বেবী— ইয়ার্কি মা—
আমি— বলতে দাও।
বেবী— পেগটা মেরে নে এক
ঢোক। মেরে নিয়ে বল
আমি বাংলাটা দু’চুমুক খেয়ে অনুপমদাকে দিলাম।
বেবী— হ্যাঁ, এবারে বল, কি
গানে রামপ্রসাদ ঢুকে পড়চে বলচিলিস তকোন
আমি— শোনো—
আমি গানটা ধরি। ‘রামপ্রসাদের ভিটের কাছে/আমার গীটার স্বপ্নে নাচে...’।
এবং ‘বল মা তারা’-র জায়গাটায় এসে সেই পূর্ববৎ ঘটনারই যথাযথ পুনরাবৃত্তি হয়। সুমনের
গান থেকে বেরিয়ে, আমি রামপ্রসাদের ‘বল মা তারা’ গানটাই পুরোটা গাইতে থাকি।
বেবী— যাব্বাঁড়া। এটা কী হলো কেসটা? দাঁড়া দাঁড়া...!
বেবী অনেকটা বাংলা মারে এবারে। চোঁ চোঁ। সিগারেট মুখে দিয়ে দেশলাইটা
খুঁজতে খুঁজতে বলে, ‘মালটাকে বুজতে দে।’
আমি— বোতলটা এদিকে পাস করো না
বেবী— উমমম.... দ্যাক্,
এ্যাকটা গানে যকোন তোর মনে হচ্চে কেউ ঢুকে পড়েচে, মানে অন্য কেউ এসে তোর গলার
গানটাকে নিয়ন্ত্রণ করচে, তকোন যদি সেই গানের ভার্বাল মিডিয়ামটাকেই চেঞ্জ ক’রে দিস,
তা’লে? মানে ধর্, তুই এই গানটা গাইতে গেলেই এই ভজঘট কেসটা হচ্চে
আমি— না, না, শুধু আমি না,
এটা অনুপমদা গাইতে গেলেও হচ্ছে। আজকে কলামন্দিরে সুমন গাইতে গেলেও হচ্ছিল।
দ্যাখোনি?
বেবী— হুম্। বেশ। যে কেউ এই গানটা গাইতে গেলেই গানের মাজখানে
রামপ্রসাদের লাইনটায় আসার সঙ্গে সঙ্গে রামপ্রসাদের আসল গানটা সে গেয়ে ফেলচে। চাইলেও সে আর কোনোভাবেই সুমনের গানটায় ঢুকতে পারচে না
মুখুজ্জে— একেবারেই
বেবী— এবারে যদি এই গানটা
আমরা না গেয়ে, মানে এটাকে ভার্বাল মিডিয়াম হিসেবে না রেকে, এটাকে যদি কোনো টেক্সট
ফর্মে ফেলি? মানে সোজা বাংলায় বললে, যদি একে আমি সিম্পিল ওয়ার্ডে টাইপ করি তা’লে
যে ফোর্সটার ফলে এই ঘটনাটা ঘটচে, তকোন সেই ফোর্সটাই একটা ওয়ার্ড ফাইলের মধ্যে আটকে
যাবে? কি? ঠিক তো?
ব্যাপারটা কী লেভেলে যুগান্তকারী হতে যাচ্ছে, এটা টের পেতে পেতেই বললাম, ‘ঠিক’। মুখুজ্জের মুখে-চোখেও উত্তেজনা স্পষ্ট। মুখুজ্জে আধ-শোয়া ছিল
এতক্ষণ। বেবীর এর’ম ভাবনায় উঠে বসতে বসতে বলে— ‘বেবী এটা পসিব্ল্?’ তখন ওয়ার্ড
খোলা হচ্ছে ল্যাপটপে। আমরা তিনজনেই চলে গেছি
ল্যাপটপের সামনে। আমি বললাম— ‘মেশিনটা ফেটেফুটে যাবে না তো?’ আমার কথা শুনে বেবী আমার
দিকে এমন ক’রে তাকালো যেন আমি পাগল না পায়জামা? আর আমার মনে হচ্ছিল, অ্যাজ ইফ ও
যেন এরকম কাজ কতবার করেছে এর আগে। বেবী ওয়ার্ডের পেজ খুলেছে একটা। তাতে টাইপ করা
হচ্ছে—
‘রামপ্রসাদের ভিটের কাছে
আমার গীটার স্বপ্নে নাচে
বল মা তারা দাঁড়াই
কোথা...’
যা ভাবা হয়েছিল, ঠিক তাই। ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা’ লিখে ফেলার পরে,
কি-বোর্ডের কম্যাণ্ড আর মানছে না কম্পিউটার। কি-বোর্ড থেকে যেরকম ইনপুট টাইপ করা
হচ্ছে, মনিটরে-স্ক্রীনে সেইমতো আউটপুট আসছে না। কি-বোর্ডে বেবী সুমনের গানটা টাইপ
করতে থাকলেও, স্ক্রীনে স্পষ্ট এসে যাচ্ছে রামপ্রসাদের ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা/আমার
কেউ নাই শঙ্করী হেথা’ গানটা। একসময় সম্পূর্ণ লেখা হয়ে গেল রামপ্রসাদের এ’ গান। সেভ
ক’রে নেওয়া হলো ফাইলটাকে। ramprosad.doc নামে। মুখুজ্জে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘অর্জুন, গাও তো এবারে সুমনের গানটা’। আমি
গাইলাম। এবং আমরা পেরেছি। দিব্য গাওয়া যাচ্ছে এবারে। এক অপ্রাকৃত শক্তিকে আমরা
কম্পিউটারে একটা ওয়ার্ড ফাইলের মধ্যে সেভ করে নিতে পেরেছি। ভাবা যায়? বেবী ফুটতে
ফুটতে বলল, ‘এবারে ফাইলটা আপলোড ক’রে ছেড়ে দিই ফেসবুকে? হি হি হি... সারা নেটে
ছড়িয়ে যাবে রামপ্রসাদের ভাইরাস’।
মুখুজ্জে— মাথা খারাপ
নাকি? দ্যাখো অর্জুন, বেবী, আমরা খোদ রামপ্রসাদকে পেয়েছি এখানে। ডোন্ট নো হাউ,
কিন্তু আমরা পেয়েছি। আচ্ছা, এই ফাইলে কি ওঁর সাথে আমরা কথা বলার চেষ্টা করতে পারি
না? অবিশ্যি উনি যদি বলেন...
বেবী— এটা কিন্তু ভালো
আইডিয়া অনুপম। কিন্তু এ্যাতো ভালো জিনিসটা দেব না নেটে?
মুখুজ্জে— না না বেবী... এক্ষুনি না
বেবী— আর্রে ঘাবড়িও
না...
বলতে বলতে বেবী ফেসবুক খুলে ফেলেছে। এবং
বৈখরীর গ্রুপে ছেড়েই দিল ফাইলটা। নেটে ওটা নিয়ে এখন কি বাওয়াল হবে কে জানে! আমরা নেট অফ ক’রে বসলাম রামপ্রসাদের ফাইলটা নিয়ে।
আমি—
আমরা ওঁকে কী কী প্রশ্ন করব সেটা একটু ঠিক ক’রে নিলে হতো না?
মুখুজ্জে—
আমার আপাতত একটাই জিজ্ঞাস্য ওঁকে
বেবী—
চলো, অনুপম, তোমাকে দিয়েই শুরু করি
মুখুজ্জে—
বেশ।
ল্যাপটপে ওয়ার্ড ফাইলটা খোলা আছে। মুখুজ্জে
ওর প্রথম প্রশ্নটা রাখল।
মুখুজ্জে—
আচ্ছা, আমার নাম অনুপম মুখোপাধ্যায়। আমি কবিতা লিখি। ‘বাক্’ নামে একটা ব্লগজিন
পরিচালনা করি।
বেবী কি-বোর্ডে আঙুল নাড়িয়ে যাচ্ছে। স্ক্রীনে
লেখা ফুটে উঠলো এবারে। রামপ্রসাদ লিখছেন—
তোমাদের সবার
পরিচয়ই আমার জানা। শুধু ঐ ব্ল— কি একটা বললে বুঝিনি।
মুখুজ্জে—
ওটা একটা পত্রিকা। আচ্ছা, বলছি যে, ইয়ে, আপনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে এড়িয়ে চললেন কেন?
স্ক্রীনে রামপ্রসাদের লেখা—
তা হলে কি চাকরী করব নাকি? অ্যাঁ? আমি সে বান্দা নহি। কার বা কে চাকরী কর,
ওরে তুই বা কে, তোর মনিব কে রে, হলিরে তুই কার নফর। আর ওদিকে ভারত লিখছে—
ভারত কহিছে মাগো এই দশ রূপে।
দশদিকে রক্ষা কর কৃষ্ণচন্দ্ররূপে।।
এসব কথা কি আমি লিকতে পারতাম? আমার দ্বারা ওসব হ’ত নি। আর কূটনীতি,
শাস্ত্রচর্চা, বিলাস ওসব আমার জন্যি নয়।
বেবী— আপনার খুব রাগ বুঝি ভারতচন্দ্রের ওপর?
রাগের কি আছে?
শক্তিশালী কবি। তোমাদের সবার মুখে মুখে ওর একটা লাইন ঘুরে বেড়ায়। আমার সন্তান যেন
থাকে দুধে ভাতে। আমার কত কত গান ছড়িয়ে আছে
সারা বাঙলায়। আমি সাধনা করেছি মায়ের। ভারত করেছে রাজার।
মুখুজ্জে— আপনার আর
কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দর নিয়ে লিখে যে উনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন, আপনার রাগ হয় না এই
চুরির জন্য?
আমরাই তো লিখেছিলেম বররুচির কাব্যকে অবলম্বন ক’রে। আর, দ্যাখো হে ছোকরা, আড়াইশো বছরের ভূতেদের মধ্যে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা ক’রো
না। ভারত কবি হয়েই জন্মেছিল। ওর মাথাটা খেয়েচে অলঙ্কার শাস্ত্র। আমি খেয়েছি কালীর
মাথা। ঘন্ট রেঁধে। আবার নিজের মাথাও দিয়েছি কালীকে। বনের পুষ্প, বেলের পাতা, মাগো
আর দিব আমার মাথা। আমি তো কোনোখানেই কৃষ্ণচন্দ্রের নাম নিইনি আমার কাব্যে! সেরেস্তার জমিদারের নামও নিই নি। নেহাৎ রাজকিশোর
মুখুজ্জে বলেছিল, কালীকীর্ত্তন লিখতে, তাই লিখেছিলেম,
শ্রীরাজকিশোরাদেশে শ্রীকবিরঞ্জন ।
রচে গান মোহান্ধের ঔষধ অঞ্জন ।।
আমি—
কিন্তু, কৃষ্ণচন্দ্র যে আপনাকে ১০০ বিঘে নিষ্কর জমি দিলেন, লিখে দিলেন, ‘গর
আবাদী জঙ্গল ভূমি আবাদ করিয়া পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগ দখল করিতে রহ’...
কিন্তু মন তো কৃষি কাজ জানে না। আমিও তো
লিখে দিলেম, এমন মানবজমিন
রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।
বেবী— আপনি তো কবিই হতে
চেয়েছিলেন। নইলে বিদ্যাসুন্দর তো লিখতেন না। তাহলে গানে ভিড়লেন কেন? আবার সেভাবে
তন্ত্রসাধনাও করলেন না। কালী বলতেই যের’ম একটা হা রে রে রে ডাকাতদল চোখে ভাসে।
আপনি সেরকম কালীর কথাও বলছেন না। এ কালী কেমন কালী!
বিদ্যাসুন্দর পড়েছ? মন দিয়ে
পড়েছ? গ্রন্থ যাবে গড়াগড়ি গানে হব ব্যস্ত, এরকম একটা লাইন লিখেছিলেম ওখানে। আর, যোগসাধনা
করতাম তো। কুমারহট্টে করতাম না? কিন্তু, ধন্য দারা, স্বপ্নে তারা, প্রত্যাদেশ
তারে। আমি কি অধম এত বিমুখ আমারে। জন্মে জন্মে বিকায়েছি পাদ পদ্মে তব। কহিবার নহে
তাহা সে কথা কি কব।
আমি— রবীন্দ্রনাথকে কে একজন
একবার বলেছিলেন, আপনি নিজের গানের সুরগুলো এতো ভুলে যান কেন। আগে একরকম সুর
ভেবেছিলেন, পরে সেটা ভুলে গিয়ে আরেকরকম সুর দিয়ে দিচ্ছেন। তাতে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন, ভাগ্যিস আমি
ভুলে যাই, নইলে আমার গানের সুরগুলো সব রামপ্রসাদের গানের মতো একইরকম হতো।
ভাগ্যিস আমি ভুলে যাই না। তাই
আমার গানের সুরগুলো আমারই নিজের সুর হয়।
মুখুজ্জে—
দেখুন, আমার তো মনে হয়, কবি সমর সেনের চেয়ে কবি রামপ্রসাদ সেন বাঙলা কবিতায় কোনো
অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নন। বরং বেশিই।
বলো কি
গো! আমি তো গীতিকার হে। লোকে তো তাই-ই বলে। আমি আবার কবি হলেম কবে? তবে কি জানো, আমার
সাধনা, সহজিয়া তন্ত্রসাধনা। ধাতু পাষাণ মাটি মূর্ত্তি কাজ কিরে তোর সে গঠনে, তোমাদের
রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ প্রচারের আগেই আমি লিখে গেয়ে গেছি এ’ গান। আর, ভেবে দ্যাখো,
আমি যখন লিখছি, বেদে দিল চক্ষে ধূলা, ষড়দর্শনের সেই অন্ধগুলা। বাউল জেগে উঠেছে তার
একশো বছর আগেই। আবার দ্যাখো, আমার গান, মন তোমারে করি মানা, তুমি পরের
আশা আর করো না। তুমি বা কার কেবা তোমার ভেবে মরো কার ভাবনা। কতো পরে লালন লিখছেন,
আমি কার, কেবা আমার, বুঝেও বুঝলাম না এবার। কিংবা, তুমি কার কে বা তোমার এই
সংসারে। মিছে মায়ায় মজে কেন এমন করো রে।
আমি—
‘খাব খাব বলি মাগো উদরস্থ না করিব’, আপনার এই লাইন যখন পড়ি, আমার তো সুকুমার রায়
মনে পড়ে যায়। ‘ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’। আপনি অনেক কিছুই আগে
করে ফেলেছেন।
তোমাদের
ঐ পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয় কাগজের নামটাও সেরেস্তার এই মুহুরিরই দেওয়া। এ
সংসার ধোঁকার টাটী। ও ভাই আনন্দ বাজারে লুটি।
বেবীর লজঝরে ভঙ্গুর ল্যাপটপ
এই সময়েই হঠাৎ শাট ডাউন হয়ে যায়। মোবাইলে, ইন্দ্রনীলের মেসেজ এলো। ‘বেবী এটা
এফবি-তে কিসের ফাইল ছেড়েছে রে? ওটা ডাউনলোড করলেই, মেশিনের সব এমপি-থ্রি ফাইল
রামপ্রসাদের গানে কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে।’ আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে আছি। বেবী
ল্যাপটপটা আবার অন করার চেষ্টা করছে। ঘণ্টা তিনেক লাগার কথা ওর এখন। স্টার্ট আপ রিপেয়ার, ফুল
সিস্টেম স্ক্যান এইসব হ্যাপা পেরিয়ে আমরা রামপ্রসাদকে আবার পাব কিনা জানি না। মুখুজ্জে,
মোবাইল থেকে এফবি খুলে মাঝরাতের স্টেটাস দিল। ‘‘আসলে ছন্দ কবিতার
একটা উপকরণ মাত্র। যে কবি শুধু ছন্দের জোরে নিজের অমরত্ব বা প্রবলতা প্রতিপাদন
করতে চান, তিনি
ভ্রান্ত। একটা মাত্র উপকরণ কোনো কিছুকেই চরিত্র দিতে পারে না, অস্তিত্ব তো অনেক
দূরের ব্যাপার। আমার তো মনে হয়, ভারতচন্দ্র আমাদের সময়ে বেঁচে থাকলে সীমন্তিনী
পুরকায়স্থ’র মতোই একজন সাহিত্যিক হতেন। আর রামপ্রসাদ হতেন রমেন্দ্রকুমার বা
মণীন্দ্র গুপ্ত।’’
ঋণ ও কৃতজ্ঞতা :
রামপ্রসাদ রচনাবলী
‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, দীনেশচন্দ্র সেন
কবীর সুমন
অনুপম মুখোপাধ্যায়
অমিতাভ প্রহরাজ
‘বিদায় গুলসারি’, ‘অনুপম % মানুষরা’, অনুপম মুখোপাধ্যায়
‘পুনরাধুনিক কবিতা এবং ছন্দ-অলঙ্কার’, ঐ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন