মুখাবয়ব : বহমান সময়ের ভাষ্য এবং রিয়ালিটির আত্মদর্শন
(৩)
১৯০৬ সালে
পিকাসোর প্রতিকৃতি তথা আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে যে ভাঙচুর শুরু হয়েছিল, চার বছর
পর ১৯১০ সালে অ্যামব্রয়েসি ভোলার্ড-এর প্রতিকৃতিতে কিউবিজিমের চূড়ান্ত প্রকাশ
নতুনভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ভোলার্ড হলেন পিকাসোর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
মানুষ যিনি ১৯০১ সালে প্যারিসে প্রথম পিকাসোর ছবির প্রদর্শনী করেন। প্রতিকৃতিতে
ব্যবহৃত রঙ ও তার বিন্যাস এই ছবির সম্পদ। বক্ররেখার বদলে সরলরেখার ব্যবহারে যে
ছবিকে এত সাবলীল রূপে প্রকাশ করা যায়, তা কিউবিজিমের উন্মেষ না ঘটলে জানা যেত না;
যদিও নিগ্রো ও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পে সরলরেখার ব্যবহার ছিল প্রচলিত। কিউবিজিমের
মধ্যে দিয়ে এই সময় পিকাসো তুলে ধরেছেন সামাজিক ক্ষেত্রে ও শিল্পে ঘটে যাওয়া সেই সব
টুকরো সময়গুলোকে, যে সময়গুলো
বহুত্বের মধ্যেও সংরক্ষিত করেছে নিজের নিজের স্পেস। নানান রকম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
সময়কে ত্বরাণ্বিত করেছে, আর বদলে যাওয়া সময়ের খন্ড চিত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশ
পেয়েছে পরিচিত প্রতিকৃতি আঁকার মাধ্যমে।
এর
পরবর্তীতে পিকাসো প্রতিকৃতি করলেন এক নর্তকীর, ওলগো খোখোলাভা। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৭ সালে নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙে এক নতুন আঙ্গিকে; কিন্তু এ কোন্ রিয়াল? বড় প্রশ্ন জাগে মনে, কেন যুদ্ধের
টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি সম্পূর্ণ ক্ল্যাসিকাল ইমেজকে ফিরিয়ে এনে আঁকলেন পোর্ট্রেট অব ওলগা ইন অ্যান আর্মচেয়ার, সেখানে প্রতিকৃতির পাশাপাশি চেয়ার ও তার নক্সা
কোন্ বাস্তবকে তুলে ধরেছে? এই প্রশ্ন মনের ভেতর থেকেই যায়। নাকি পিকাসো
বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করতে চেয়েছেন রিয়ালিটিকে? পলায়ন
প্রবণতার এ কোনো শৈল্পিক পথ, নাকি বাস্তবকে মানতে না পারার ফলে ফ্যান্টাসিকে আশ্রয়
করে সাময়িক বাঁচতে চাওয়ার তাড়না প্রসূত কাজ? আর এখানেই পিকাসোর জীবন হয়ে ওঠে
বর্ণময়, বিতর্কিত অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন।
***
যুদ্ধের পরবর্তীতে তখন শিল্পে আত্মপ্রকাশ করেছে পোস্ট
ওয়ার কমিউনিস্ট পিরিয়ড। এ সময় পিকাসো যখন তাঁর কমিউনিস্ট বান্ধবী হেলেনী পারমেলিনের
(যিনি নিজেও একজন লেখিকা ও চিত্র সমালোচক)
প্রতিকৃতি আঁকলেন, তখন ব্যক্তি পিকাসোও পালটে গিয়েছেন অনেকখানি। এই প্রতিকৃতিতে
লাল রঙের ব্যবহার কেবলমাত্র পারমেলিনের প্যাশনকেই প্রকাশ করছে তা নয়, পিকাসোর
কমিউনিস্ট জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ও মতাদর্শের প্রতি গভীর আস্থাকেও প্রকাশিত
করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে নিওরিয়ালিজম প্রবলভাবে ইতালিকে কেন্দ্র করে
ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। পিকাসোর কাজেও এই অতিবাস্তবতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
পাওলো পাসোলিনির কবিতা ‘আপেন্নিন-এ নিওরিয়ালিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গীর যে চিত্ররূপ পাওয়া
যায়, তার আবেশ লক্ষ্য করা যায় পিকাসোর কাজের ধারাতেও—
হাওয়ার
শব্দ... তারপর। ইলেরিয়ার
ভারী চোখের
পাতায় ঘুম ছাড়া
আর কিছুই
নেই। এই মেয়েটির মৃত্যুর রূপ
দিয়েছে
সকাল, পূর্বকল্পিত, মার্বেল পাথর
হয়ে যাবে।
ইতালির আর কিছুই নেই অবশিষ্ট
শুধু তার
মার্বেল মৃত্যু ছাড়া, তার ঊষর
বাধাপ্রাপ্ত
যৌবন...
(অনুবাদঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে এই সব কিছু থেকে পিকাসো সরে এসে ১৯৫৪ সালে আঁকলেন পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্টস ওয়াইফ, জ্যাকুইলিন কেনীলিঙের
প্রতিকৃতি। জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি কাটিয়েছেন কেনীলিঙের সঙ্গে। এই লেট পিরিয়ডে
পিকাসোর ছবির মুখ্য বিষয় বারবার হয়ে উঠেছেন কেনীলিঙ। কিউবিজিমের ভাঙাগড়া
নিওরিয়ালিজমকে ছুঁয়ে শেষ পর্যায়ে এসে অনেক বেশি সরলীকৃত হয়ে উঠেছে। রেখা ও রঙের
ব্যবহারের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতা ও একমুখিনতা দেখা দিয়েছে গভীরভাবে। সাদা পোশাকে
দীর্ঘ গ্রীবার এক নারীকে এঁকে চলেছেন শিল্পী জীবনের শেষ সময়ে। শিল্পীর প্রেমের
কাছে এমন আত্মমগ্নতা সময়ের আর কোনো ঘেরাটোপে ধরা সম্ভব হয় না। সময় অতিক্রম করে সব
বাস্তব অনুভূতিকে, এ ছবির মুখ হয়ে যায় দেশ-কাল-সীমানার বাইরে চিরন্তন, যেখানে
ভালোবাসা দেবতার বয়সের মতোই পুরাতনী ও সার্বজনীন।
***
প্রযুক্তির
উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পেও পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতি ছবির বাজারকে, মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত
করেছে। যেখানে বাস্তবের মধ্যেও অনেকগুলো স্তরভেদ ধরা পড়েছে। যে রিয়াল ওয়ার্ল্ড
শিল্পীর তুলিতে প্রথমে পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলস থেকে শুরু করে নানান আন্দোলন, ভাঙাগড়ার
মধ্য দিয়ে ইমেজারি রিয়াল ও অ্যাবস্ট্রাকশনের হাত ধরে নানা চড়াই উৎরাই পার করে এসে
দাঁড়ালো, তা যেন একটা খাড়া পাহাড়ের পাদদেশ। আর এই খাড়া পাহাড়ের ঢাল এক কথায়
সুপার-রিয়ালিজম। এই সময়ের ছবিও ব্যক্ত হয়েছে নানান শিল্পীর প্রতিকৃতির মধ্য দিয়েই।
ক্যামেরা আবিষ্কারের পরবর্তীকালে প্রতিকৃতি বা পোর্ট্রেটের তুলনায় মুখকে ক্যামেরাবন্দী করাই অনেক বেশি সহজলভ্য।
যদিও প্রতিকৃতির গুরুত্ব শিল্পীর জীবনে সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।
চক ক্লসি
১৯৭৫-৭৬ সালে আঁকলেন লিন্ডার প্রতিকৃতি। আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞাপন এক বিশেষ জায়গা
করে নিয়েছে এবং বাণিজ্যায়ন শিল্পের অন্যতম আঙ্গিক হিসেবে মিশে গিয়েছে ওতোপ্রোতভাবে।
লিন্ডার প্রতিকৃতিতে ফটোগ্রাফির ডিটেলিং-এর পাশাপাশি শিল্পীর তুলির টান বাস্তবকে
ছাড়িয়ে সুদূর পরাহত এক সময়কে পরিস্ফুট করেছে, মুখের প্রতিটি ভাঁজ যেন সময়ের গভীর
যন্ত্রণার সাক্ষ্য বহন করছে। ১৯১২ সালে নলডি এমিলের আঁকা প্রফেটের অভিব্যক্তিময় মুখটির
থেকে লিন্ডার ট্রিটমেন্ট সম্পূর্ণ আলাদা হলেও আবেদনের দিক থেকে দুটি মুখই ভয়ানক
শক্তিশালী। লিন্ডার ছবির সময়কালের প্রায় সত্তর বছর আগে আঁকা জর্জ ওয়েসলির ছবি
প্যাডি ফ্ল্যান্নিগন-এ যে মুখের প্রকাশ ঘটেছ, তা বিদ্রুপাত্মকময় সময়ের সঙ্গে
অভিযোজিত সময়চেতনার প্রকাশভঙ্গিমা; সেখানে
ভয়, আঘাত, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের ব্যঞ্জনা প্রকট। ব্যালোওস এই নিউইয়র্ক
রিয়েলিজমকে প্রকৃত অর্থে প্রকাশের জন্য এক সময় বলেছিলেন – “I don’t know anything about boxing, I’m just painting
two men trying to kill one another.” এইভাবেই সাবজেক্টিভিটি থেকে বেরিয়ে এসে ভাবনার, কল্পনার
বা বাস্তবের প্রধান গুরুত্ব আরোপিত হয় নির্বিশেষ কার্যক্ষণটিকে বা মুহূর্তের
ব্যঞ্জনাটিকে উদ্ঘাটিত করতে এবং তাকে প্রকাশিত করতে। লিন্ডার কাজের প্রসঙ্গ আসলে
একটি ইন্সটলেশনের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করে; হাক্সনের হোমলেস পার্সন। সুপার
রিয়ালিজমের এক অনবদ্য কাজ। প্রতিকৃতি না হলেও, পেন্টিং না হয়েও, মিশ্র মিডিয়ার এই
ইন্সটলেশন এবং সেখানে ব্যবহৃত ফিগারটির মুখের অসহায়তা বিপন্নতা সময়ের চলনকে প্রকাশ
করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। লুসিয়নের প্রতিকৃতিতে যে রঙের ব্যবহার, যে প্রকৃতির
অভিব্যক্তি, আবেগের প্রকাশ আলোচিত হয়েছে, জেনি সাভেলির শিরোনামহীন একটি
আত্মপ্রতিকৃতি অনেকটাই সমপ্রকৃতির হলেও, খুব কম সময় আগের এই কাজ প্রতিবাদের ভাষাকে
নতুন ভাষা দেয়। পুরুষ জগতের বাইরে নারী মননের বিশ্লেষণে এই প্রতিকৃতির স্থান
উল্লেখযোগ্য ।
সময়ের
যান্ত্রিকতার যন্ত্রণাকে ছবিতে তুলে ধরেন রেনো ম্যাগরিত্তি, যেখানে প্রতিকৃতির
মুখটি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় আপেলের পেছনে। এ যেন সবুজ
সতেজ একটি আপেলের আড়ালে বৈজ্ঞানিক অগ্রসরতার প্রবঞ্চনাময় আবিষ্কারের নিদারুণ
স্বীকৃতি। ফিরে আসি লিন্ডার প্রতিকৃতিতে, আধুনিক জীবনের টানাপোড়েন দুই চোখের উদ্বিগ্ন
দৃষ্টিতে। চুলের প্রতিটি বক্রতা, আবছায়া সব কিছুই অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে দেখা
যাচ্ছে, ধরা দিচ্ছে কিন্তু যন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়ের ছাপ মনকে নাড়িয়ে দেয়। গুমরে ওঠে
বুক অজান্তেই, মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে – এ কোন্ বাস্তব? কোন্ সময়ের মধ্যে বাস করছি
আমরা? যা দেখছি, তা আদৌ দেখছি তো?
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন