কবিতার চিত্রকথায় রাকা দাশগুপ্ত
প্রবাসী কবি রাকা
দাশগুপ্ত সাম্প্রতিক বাংলা কাব্যজগতের এক দৃঢ়প্রত্যয়ী লেখিকা। তাঁর সঙ্গে আমার
মানসিক পরিচয় ঘটেছিল অকস্মাৎ পাওয়া এক নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘কাগজফুলের বন’এর মধ্যে।
কবিতাগুলি পড়েই মনে হয়েছিল, শুধু আবেগ নির্ভরতার কবি নন তিনি, বরং মেধা এবং
উজ্জ্বলতার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে কাব্যগ্রন্থটিকে
মনে হয়েছিল একটি রত্ন ভাণ্ডার। কিন্তু
তারপরেই নিজস্ব সংগ্রহে রাখার জন্যে কলেজ স্ট্রীটে বইটি কিনতে গিয়েই নৈরাশ্যের
অন্ধকারে ডুবে যাওয়া – বইটি ‘আউট অফ প্রিন্ট’। তারপর ইতি উতি কবিকে এখানে ওখানে খোঁজা এবং
তারপর একদিন হঠাৎ আর একটি বই হাতে পাওয়া – ‘অপরাহ্ণ ডাউনটাউন’। বইটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে
আত্মকথনের শৈলী, অপরাহ্ণের ছবি, কখনো
বিষাদময়তা, কখনো বা আত্ম আবিষ্কারের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
যে কবি
কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই বলেন- “ছদিন সৃষ্টির পর বিশ্রামদিবসে যান / আমাদের নিজস্ব ঈশ্বর”, সেই কবির কবিতা সম্পর্কিত
ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল জাগে এবং সেই সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে একটা
চমকের আভাস তৈরি হয় মনের গহনে। মনে প্রত্যয় জাগে, কবি বিদেশী কবিতা পাঠে গভীর
নিমগ্ন এবং বোধহয় ভূমিকাতে তারই অনুরণন, “On the
seventh day He stopped working on everything that he had done”. বইটি
পড়তে পড়তে একটা শৈলী চোখে পড়ে। এক একটি কবিতা স্বতন্ত্র রূপে চিহ্নিত, আর কয়েকটি গুচ্ছ কবিতাও এখানে
সংকলিত, যা কবির বিশেষ মানসিক অবস্থাকে বোঝাতে সাহায্য করেছে। যেমন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করে যেতে পারে
‘চেরিবসন্তের দিন’ কবিতাগুচ্ছ।চেরিফুল সম্পর্কে কবি বর্ণনা করেছেন, “সমস্ত বৈধব্যবেশ, সমস্ত ওয়েডিং গাউন
থেকে / রঙ চুরি করে নিয়ে ফুটে উঠলো রাশি রাশি ফুল”। চেরিফুলের শুভ্রতার বর্ণনা
থেকে সহজেই বোঝা যায় কবি পরবাসী, শৈত্য শহরের অধিবাসী। চেরিফুলের শুভ্রতা থেকে প্রকাশ পেয়ে ফুটে ওঠা
রক্তিম কুঁড়ি সম্পর্কে রাকা অদ্ভুত দক্ষতায় লেখেন, সে ফুটে ওঠা “দ্বিতীয় প্রেমের
মতো লাজবন্তী। দ্বিতীয় বিয়ের ভীরু চিঠি”। এই বাক্যের পর পাঠক স্বভাবতই হয়ে যান বাকরুদ্ধ, নির্বাক। এমন উপমা কোথায় মেলে? এই কবিতাগুচ্ছেরই আর
একটি প্রসঙ্গ, যা বসন্তের ক্ষণস্থায়ীত্বকে মনে করা। তাই কি বসন্ত
উৎসবের সময় তুলি পেন তুলে নেন প্রাজ্ঞ কবিরা আর “হাইকুর মাপা ছাঁচে লেখা হয় অনন্ত বিরহ”! হাইকুর অনুষঙ্গে মনে পড়ে,
এতে মোট সতেরোটি দল থাকে, যার প্রথম লাইনে পাঁচ, দ্বিতীয় লাইনে সাত আর শেষ লাইনে
থাকে পাঁচটি দল; যা জাপানের কাব্যশৈলীর নিজস্ব একটি বিন্যাস এবং হাইকুতে একটি
লাইনে একটি দৃশ্যই ব্যঞ্জিত হয়। তাই ‘অনন্ত বিরহ’ শব্দটি একটি বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে মনের তারে। লেখিকা
আধুনিক কালের বাস্তববাদী কবি, তাই তাঁর কণ্ঠে অনন্ত প্রেমের ধারণা উচ্চারিত না হয়ে
ধ্বনিত হয় ‘প্রেম বা মনুষ্যজন্ম... যা
সুদৃশ্য, ক্ষণস্থায়ী, চেরিফুল তারই বার্তাবহ’। ‘ডাক’ বর্তমান দ্রুতগামিতার যুগে এক অসাধারণ
ব্যঞ্জনাবাহী কবিতা – মোবাইলের যুগ যেন মানুষের আবেগ, প্রেম, বিরহ সব কিছুকেই বড়
যান্ত্রিক করে তুলেছে। এখানে মানুষকে পাখির
রূপকে চিত্রিত করা হয়েছে আর যে মানুষ এতটা যান্ত্রিক হতে পারেনি এখনো, সে বিষণ্ণতার
ডানায় ভর করে একাকীত্ব ও নির্জনতাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় “কে যেন সে বহুযুগ আগে / বেঁধেছিল তার পায়ে সাবেককালের এক
ছেঁড়াখোঁড়া হাতে লেখা চিঠি”। সত্যি তো তাই। চিঠির মধ্যে মনের যে অনাবিল প্রকাশ,
ক্ষুদ্র এস-এম-এস এ তার কতটুকুই বা ধরা পড়ে?
মনে গভীর দাগ কেটেছে
‘আত্মখননের লিপি’ নামাঙ্কিত কবিতাগুচ্ছ। কবি এই কবিতাগুচ্ছ লিখতে গিয়ে হেঁটে চলেন অতীত থেকে
বর্তমানে। স্মৃতির ভাণ্ডারকে খনন করে যেন সামনের দিকে এগিয়ে
চলা। কিন্তু অতীত মন্থন করে
যা পাওয়া যায় তা যুগে যুগে বিভিন্ন রূপে পর্যবসিত। এক সময়ে যাকে ভাবতাম অভিমান, তা
এখন ক্রোধে পরিণত, অনুযোগের নম্রতা অভিযোগে রূপান্তরিত, “ফলত ইতিহাস বদলে যাচ্ছে
আমাদের হাতে”। এই পর্বেরই আর একটি
কবিতায় ‘নদীরা চলে গেছে অন্যদিকে’ মনে করিয়ে
দেয় সময় বদলের ইতিহাসকে। রবীন্দ্রত্তোর কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন “সব নদী ঘরে ফেরে”; তাহলে কি রাকা এটাই বলতে চান যে,
সময়কাল এতটাই পরিবর্তিত যে, প্রাচীনকালের কোনো নিদর্শনই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কি বেদনার প্রকাশ ঘটে যায় তাঁর
লেখনীতে “চিরটাকাল আমরা এমন খটখটে শুকনো ছিলাম না”। আর বর্তমান মানুষজাতির ওপর তাঁর তীব্র
অভিমান প্রকাশিত “মানুষ তো স্বভাবতই চক্ষুহীন, কর্ণহীন, ওষ্ঠহীন হয়ে থাকে”। এ তো শুধু কবিনির্মিত কয়েকটি পঙক্তি মাত্র নয়, এ
যেন জীবনবেদ। কারণ হিসেবে বলা
যেতে পারে, অতীতের সব কিছুই তো নিষ্প্রাণ ছিল না – সেখানে “অপেক্ষা টাঙানো থাকতো”,
“সন্ধে পোহাতো ভালোবাসারা”।
শৈলীগত বিন্যাসের
দিক থেকে এই কাব্যগ্রন্থের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘ঋতু বিতান’। প্রকৃতির সঙ্গে
মানবীকে এক করে দেখে কবি দুটি আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন এখানে। এ কবিতার মাধুর্য এমনই – “মুখের যে পাশটায়
রোদ পড়ে, সেখানটা চিরসবুজের দেশ। উলটো দিকটা, স্বভাবতই তুন্দ্রা অঞ্চল”। এ কবিতা
বিশ্লেষণের নয়, ব্যাখ্যাতীত। শুধুই অনুভবের। প্রকৃতির সজীবতা, রুক্ষতা, তার
অন্তর্গত আগুন সমস্তই যে কীভাবে মানবীর সত্তার সঙ্গে এক হয়ে গেছে, তা পাঠ করে
তন্ময় হয়ে যান পাঠ।
পাঠকবর্গকেও এই কবিতাটি পড়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানালাম।
‘সফরকাহিনী’ আর এক
পর্ব। মনে হয়, লেখক পরবাসে গেছেন – “নিজেই নিজের সঙ্গে ক্লান্ত সহবাস /
ব্যাকপ্যাকে বয়ে চলি”। প্রথম অক্টেভ, দ্বিতীয় অক্টেভ শব্দের ব্যবহার কবিতায় বিদেশী
অনুষঙ্গ আনে, দিগন্তবিস্তৃত শস্যখেত, নদী, ছোট ব্রিজ, জ্যাজ কিশোরীর কন্ঠস্বর অন্য
দেশের কথা ভাবায়। লেখিকা সেই অন্য দেশের পথভ্রমণকালে
‘নতুন প্যাটার্ন’ খুঁজে পান – একটা বিষণ্ণতার সুর মন্দ্রিত হয়ে বাজে শ্রোতার কানে,
না হলে তিনি কেন এই পর্বেই বলেন “না-ভালোবাসার পাঠ আমরাও আকৈশোর শিখেছি অনেক নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যাব
যাবতীয় দুর্ঘটনা, অসমহৃদয় প্রেম, অভিসার-ডেক” অথবা “নদীর অনেক নীচে অন্ধকারে পড়ে
থাক আমার অতীত... আর নিজস্ব ছায়াটি”। এ
কোন্ কন্ঠস্বর? মনে মনে কবির কি বোঝাপড়া চলছে নিজের সঙ্গে?
এরপর উল্লেখ করা যায়
‘অপরাহ্ণ ডাউনটাউন’ নামক কবিতাগুচ্ছ। অপরাহ্ণ মানে একটা ফুরিয়ে আসা দিন। সূর্য নিভে যাওয়া। শহরের কেন্দ্রস্থলে বিকিকিনি থেমে যাবে
এবার। রাত নেমে আসবে ক্রমে। বিকেলের আলোয় চলে বেদেনির আগুন ও তাস দেখানোর খেলা, কিন্তু লেখিকা
দেখেন না – “কিছু খেলা না-দেখা ও না– দেখানো চিরকালই ভালো”। পথপাশে উজ্জ্বলতার মাঝখানে
বেকারির দোকান কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আবার শহরের জন্মদিনে তরুণ-তরুণীদের আত্মপ্রমোদ পীড়া দেয় চোখকে যখন, তখন হুইলচেয়ারে বসা আশি উর্ধ্ব
তরুণী শহরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে গ্যাসবেলুনের ফোয়ারা ছোটান, “শহরের মুখে তুলে দেন
স্ট্রবেরি লজেন্স”। সেখানেও কি প্রচ্ছন্ন বেদনা প্রকাশ পায় না কবির
চেতনায়?
কাব্যগ্রন্থটি তাই
মনের সেতারে সুর তুলেছে। আরো কিছু কবিতা আছে –
যা অনুল্লিখিত রয়ে গেল। মুখবইতে তাঁর
যে পরিচয় পেয়েছি, বাহ্যিক পরিচিতির দিক থেকেও তা খুব সমৃদ্ধ। বর্তমানে তিনি বিদেশে গবেষণায় রত। আর তাঁর সাহিত্যিক চেতনা সম্পর্কে একটি লেখা থেকে জানতে
পারি – “আমার কবিতা আমার জবানবন্দী হতে গিয়েও কি করে যেন হয়ে যায় আমার হারিয়ে
যাওয়া কোনও যমজ বোনের দিনলিপি, যে খুব আমার মত, কিন্তু পুরোপুরি আমি নয়। তার পা
দুটো যে মাটিতে প্রোথিত, সেই মাটিটুকু আমারই। অথচ হাত দুটো সে মেলতে চায় যে আকাশে,
সেখানে আসল-আমিটার হাত পৌঁছয় না”। (আয়নায় পড়া স্ক্রিপ্ট – রাকা দাশগুপ্ত)। আর সবশেষে
বলা যায়, তাঁরই উদ্ধৃত একটি কবিতার পংক্তি – “I am a rock /
I am an island”. সত্যিই তো তাই,
এরকম কবিতা লেখার জন্য নিজেকে চারপাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন
রাখার কৌশল জানতে হয়। তাই নিজের সম্পর্কে তিনি এমন নীরব, বিনম্র, স্বল্পভাষী। আর অণু পরমাণু নিয়ে গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে
লিখে চলেন এমন হৃদয়সংবেদী কবিতা। অপরিসীম আগ্রহ রইল পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্যে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন