‘ভাল্লাগে না’
একটা সময় আসে, যখন আর কিছুই মনকে টানে না। এই সময়টা যে কারোর কেন এবং কখন আসে, তার ঠিক নেই। হতাশা বাড়ার, উদ্যম হারানোর কারণ হিসেবে বয়স একটা ভূমিকা নেয়
বটে, তবে
সেটাই মুখ্য নয়। অনেক বয়স্ক মানুষকেই দেখা যায় দিব্বি খিলখিলিয়ে হাসছেন, নাতি-নাতনিদের সাথে জীবন কাটাচ্ছেন। সত্যি সত্যিই তাঁদের দ্বিতীয় শৈশব এসে যায় যেন! আবার অনেক অল্প বয়সীদেরও দেখা যায় হতাশায় ভুগতে। ধুর্, আর কিছু
ভাল্লাগেনা – এই উক্তি কথায় কথায় আজকাল শোনা যায়, যে কোনো বয়স্ক মানুষের মুখ
থেকেই। এখন এই ‘ভাল্লাগেনা’র
উৎপত্তিস্থল যদি একটু খুঁজতে যাই, তাহলে না আবার কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোয়! এই যুগে
অন্যের ভালো না-লাগার খোঁজ আর কে নিয়েছে! আমারও কী ছাই
অত সময় আছে ওসব খোঁজাখুঁজির! নিজের ভালো না-লাগায় নিজেই অস্থির হয়ে আছি দিনরাত, অন্যের ভাবনা এখন
থাক।
আমার ‘ভাল্লাগেনা’ কী একটা! এই যেমন এখন সন্ধ্যেবেলা বেশ গুমোট হয়ে আছে চারদিক, আমার
কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। কেন, গুমোট কেন
থাকবে শুনি! হয় হু
হু করে হাওয়া-বাতাস ছাড়ুক,
না হয় বৃষ্টি পড়ুক, মাঝামাঝি
কোনো ব্যবস্থা আমার সহ্য হয় না। এই গুমোট করা সন্ধ্যে কী
আমি চেয়েছিলাম? চাই নি তো! সেই জন্যই এখন আমার
‘ভাল্লাগছেনা’। কিচ্ছু কাজ করব না এখন, লিখব না
একপাতাও, রাঁধব না, বাড়ব না, গান শুনব না, আমি মুখ গোমড়া করে এই সন্ধ্যের মতোই বসে থাকব শুধুমুদু। যাক, সময় বয়ে
যাক, তাতে আমার কী শুনি! কাল যেমন বিকেল থেকে হঠাৎ মেঘ, মেঘ আর মেঘে আকাশ কালো। গুমগুম সে কী ডাক তার! ঠান্ডা ঠান্ডা
হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছিল দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর। আমার মন যেন প্রজাপতির মতো উড়ছে আর উড়ছে। প্রজাপতি থেকে পাখি হয়ে মনে চলে যাচ্ছে মেঘের পাহাড়ে। কিন্তু তারপর কী হলো! হঠাৎ কোত্থেকে যেন সেই ‘ভাল্লাগেনা’ উড়ে চলে এলো আমার মনের ভেতর। উদাস
হয়ে, গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম চুপ করে। একঘেয়ে একটানা গুমড়ে কাঁদতে থাকল
‘ভাল্লাগেনা’। রাতে যখন বৃষ্টি নামল, তখন পালালো সে।
আমার সাথে আমার ‘ভাল্লাগেনা’র এই ভাব, এই আড়ি। কখন সে আমার কাঁধ বেয়ে আমার
মাথায় চড়ে বসে, কখন সে গোড়ালি বেয়ে নেমে যায় মাটির ছায়াতে, কেউ জানে না। যখন
আমাদের ভাব হয়, আমার মাথায় চড়ে ও কেমন ডুগডুগি বাজায়, আর হাঁক পারে – দেখো দেখো
মাদারি কা খেল দেখো, বান্দর কা শাদি দেখো, বৈজন্তীমালাকি ডান্স দেখো, অমিতাভকা
স্টান্স দেখো... আমি দেখতেই থাকি হাঁ করে ওর সেই খেল। আমার চারপাশে সেই খেলা দেখার
জন্য কত রঙবেরঙের মানুষ জড়ো হয়, তাদের কোনো ভাল্লাগেনা’দের আশেপাশে
দেখি না তখন। আমার
‘ভাল্লাগেনা’রা শুধু আমার মাথায় চেপে খেল দেখিয়ে যায়। আবার যখন আড়ি হয়, আমি সজোরে এক
লাথি মারি ‘ভাল্লাগেনা’র মুখে। ও হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে
পড়ে মেঝেতে। ওর আঙুলের ফাঁক বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত দেখেও দেখি না। পাত্তা না পেয়ে ও হাওয়ায়
মিলিয়ে যায় বেমালুম। আমি তখন স্নান সেরে নিই চটপট, বাড়ি সাজিয়ে
ফেলি ফুলে ফুলে। আমার বাগানের বেল, জুঁই, টগর, করবীরা
গান গায়, কোথা থেকে যেন পাখিরা আসে, কেবল আমাকেই গান শোনাবে বলে। আমি বাড়ি থেকে
বেরিয়ে পড়ি নতুন শেডের লিপস্টিকের খোঁজে।
দোকানী বড় বোরিং লোক। তার কাছে সেই একঘেয়ে রঙ। সে রঙের সব আমার চেনা। আমি
নতুন রঙ খুঁজে না পেয়ে এক বোতল ‘উজালা’ কিনে আনি। সাদাকে আরও ধবধবে করার চেষ্টা
ছাড়লে কী হয়! এই গরমের দেশে, ধুলো, ধোঁয়া, দূষণে সাদা কী আর সাদা থাকে! লালচে,
কালচে হয়ে যা তা অবস্থা তার। ‘উজালা’ কতটা আর আটকাবে, কতটা আটকাতে পারে
অক্সিজেন-ওয়াশ? তবু চেষ্টার শেষ নেই। সার্ফ এক্সেল এলো, এলো ফেব্রিক সফট্নার, তবু
কেন সন্দেহে থাকা? থাকবে কী সাদা সেই নতুনের মতো! এখানে তো অন্য রঙ চাই
নি আমি! মুখ নিচু করে দেখি, কোথা থেকে, যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে ‘ভাল্লাগেনা’র শরীর। আমার দিকে মুখ তুলে একটু হাসে। ওর
হাসির মধ্যে লুকোনো ব্যঙ্গ দেখে নিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখি। ক্রমশ দেখি আমার ঘাড়ে যন্ত্রণা
বাড়ছে, পিঠ ঝুঁকে পড়ছে, মাথায় যেন একপাহাড় ওজন চাপিয়েছে কেউ। আমি মিশে যেতে থাকি
আমার ‘ভাল্লাগেনা’র শরীরের সাথে।
এই অবস্থায় দূর থেকে যদি কেউ আমায় দেখে, চিনতে পারবে না। ভাববে, বুঝি শঙ্খ লেগেছে সাপ আর সাপিনীর। কেউ কেউ প্রণাম করে, কেউ ক্যামেরা
বাগিয়ে ছবি তোলে, কেউ আবার ঢিল ছোঁড়ে নির্দ্বিধায়। ওই ঢিল খেয়ে কপাল ফুলে গেলে,
আমাদের শঙ্খ ছেড়ে যায়। আমি আবার ফিরে আসি নিজের রূপে। ‘নাগিন’ সিনেমার রীণা রায়কে
মনে পড়ে। আয়না দেখি, নাঃ আমার চোখের মণি তো কালোই আছে, কালোই ছিল। নীল কন্ট্যাক্ট
লেন্স আমি কোনোদিনই পরি নি। পরবও না জীবনে। কোন
ফাঁকে আমার
‘ভাল্লাগেনা’ কেটে পড়ে মানে মানে। আমি ডাক্তারের
কাছে যাই চোখ দেখাতে। চশমা পরে বেরিয়ে আসি চেম্বার থেকে। রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার,
ঝকঝকে দেখাচ্ছে এখন, মানুষজনের মুখ দেখে বেশ চিনতে পারছি, কে কোনজন। আগে মুখগুলো
ছিল বড় অস্পষ্ট। এখন আর অসুবিধে নেই। হাসিমুখে বাড়ির পথ ধরি। রাস্তার দিকে চোখ যেতেই দেখি, কত
ঢেউ উঁচুনিচু হয়ে বিছানো আছে রাস্তায়। চশমাটা নাকের ডগায় নেমে
এসেছিল বলে ঠিক করে তুলে ধরি। এরপর একটার পর একটা ঢেউ ভাঙি নির্ভুলভাবে। ঢেউয়ের
মাথায় উঠে যখন টলমল করে ওঠে শরীর, দু’ হাত ছড়িয়ে দিই দু’দিকে পাখির ডানার মতো। ব্যালেন্সের
খেলায় আমি ছোট থেকেই খুব দক্ষ, সেই কনফিডেন্স নিয়ে তরতর করে ঢেউ ভেঙে নেমে পড়ি।
ছোটবেলায় ব্যালেন্স শিখেছিলাম রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে। ঠিক যখন
ট্রেন চলে যেত গুমগুম করে, তার পরেই সেই পিষে ফেলা রেললাইনের চকচকে পাতের ওপর দিয়ে
একপা, একপা হাঁটা শুরু হতো। দুটো হাত
দুদিকে ছড়িয়ে, কখনও ডান হাত ওপরে উঠে,
বাঁ হাত নিচে নামিয়ে, কখনও আবার ঠিক তার উল্টো প্রসেস। যতক্ষণ না সিগনালের লাল সরে গিয়ে
সবুজ-হলুদ জ্বলে উঠত, এই খেলা চলত একটানা। সেই পুরনো দক্ষতা কাজে লাগাতে পেরে বেশ
লাগছিল। এ যেন সেই সাঁতার বা সাইকেলে চড়া, একবার শিখে গেলে কেউ ভোলে না। তবুও তো
বয়স বাড়ছে, বাড়ির কাছে এসে হাঁফিয়ে গিয়ে সিঁড়ির ওপরেই বসে পড়ি। ঘাম মুছতে মুছতে
দেখি আমার পায়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, হাজির হয়েছেন আমার নাছোড়
‘ভাল্লাগেনা’। প্রচন্ড ঘুম পায় আমার, বিছানায় শুয়েই মরার মতো ঘুমোই টানা এক সপ্তাহ, নাকি একমাস, একবছর ধরে, হিসেব রাখি নি।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখনও ‘ভাল্লাগেনা’
দেখি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অনেকদিন বাদে এত ঘুমিয়ে শরীর
ঝরঝরে লাগছিল খুব। সেই মুহূর্তে মনে হলো, বালিশ চাপা
দিয়ে ‘ভাল্লাগেনা’কে খুন করি। আপদ বিদেয় হোক একেবারে। ক্রমাগত ওর এই আছে, এই নেই,
দেখতে দেখতে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বোর্ হয়ে গেছি। এবার যেন আমি নিজেই একটা ‘ভাল্লাগেনা’
হয়ে যাচ্ছি ওর ছত্রছায়ায় থেকে থেকে। এ থেকে বেরিয়ে আসার একটাই
পথ এখন খোলা আমার সামনে, ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। দু’হাতে বালিশ নিয়ে ওর মুখের ওপর চেপে ধরি, ও তখনও ঘুমোচ্ছে, বুঝতেই পারছে না মৃত্যু ওর গায়ের ওপর চেপে
বসছে। শেষবারের মতো একবার ওর মুখ দেখে নিই, এই ভেবে যেই তাকালাম
– কী নিষ্পাপ ওর মুখ! শিশুর সরলতা মেখে ঘুমোচ্ছে
এখনও, আর আমি কিনা নেহাতই একটা পেটি মার্ডারারের মতো হিংস্র হয়ে উঠছি! আমার মানবিক মুখ কই গেল? চাবুক খেয়ে রেখে দিলাম বালিশ। ঘুমের ঘোরে ও পাশ ফিরে শুলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আমি
বেরিয়ে এলাম। তুই ঘুমো আমার ‘ভাল্লাগেনা’, যদি জেগে
উঠিস আবার, যদি আবার আমার কাছে আসিস, যেমন
আসতি-যেতি, আবারও না
হয় আমি তোকে নিয়েই
মেতে উঠব!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন