স্বাধীনতার রঙ
দশ বছরের দুই বোন রাবেয়া আর শাকিলা তাদের ভাই সাজাদকে সঙ্গে নিয়ে বিশাল একটা থলে ঝুলিয়ে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়েছে। আজ প্রায় মাস সাতেক হলো ৫৮ নং ন্যাশনাল হাইওয়ের
ওপর খতৌলি গ্রাম ছাড়িয়ে দেওবন্দ যাবার পথে চিতলগ্র্যান্ড নামে বেশ বড় একটা রেস্টুরেন্ট চালু
হয়েছে। বছর তিনেক ধরে ফোর লেন তৈরি করার কাজ চলছিল, তাই এই হাইওয়ের অবস্থা তখন শোচনীয় ছিল। এখন একেবারে ঝাঁ চকচকে। দিল্লি–দেরাদুন করতে রাতদিন
গাড়িগুলো হুস-হাস দৌড়ে চলেছে। অন্যান্য দিনের তুলনায়
সপ্তাহ শেষে গাড়ির চলাচল দ্বিগুন বেড়ে যায়, ফলে চিতলগ্র্যান্ডও খদ্দেরের ভিড়ে উপচে পরে।
আজ সোমবার। গতকাল রোববারের সাথে শনিবারেও কী যেন একটা ছুটি ছিল। দোকানটায় বিক্রি-বাট্টা অনেক হয়েছে,
ফলে সক্কাল সক্কাল গেলে দোকানের পিছনের কুড়াদান থেকে অনেক প্লাস্টিক বোতল পাওয়া
যাবে, সেইসঙ্গে খেয়ে আধা ফেলে দেওয়া খাবার পাবার সম্ভাবনাও আছে। সেগুলোও আরেক
আকর্ষণ। তাই আজ রাবেয়াদের এত তাড়া।
কাওয়াড়ীয়ালার কাছে কুড়োনো জিনিষগুলো বিক্রী করে বাড়ি আসার
পথে বাবলুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
-
তোরা সব হাইওয়ের দিকে
গিয়েছিলি?
-
তুই কী করে জানলি?
-
এত সকালবেলায় তোরা তো বের হোস্ না, তাই বললাম।
বাবলু
গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়া। তারপর মা মরার পর কিছুদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়িয়ে সৎ মায়ের বাক্যবাণে আসিফ চাচার বদৌলতে ঐ রেস্টুরেন্টায় বাসন মাজার কাজে লেগেছে। বাবলুই রাবেয়াদের রেস্টুরেন্টটার কুড়াদানের খবরটা দিয়েছিল। আজ আবার অন্য একটা খবর জানালো।
-
জানিস তো, পুরকাজীতে একটা বড় ইস্কুল আছে। মুজাফরনগর থেকে আমীর ঘরের বাল বাচ্চারা ঐ ইংরাজি স্কুলটায় পড়তে আসে।
আমিনা প্রশ্ন করলো, তাতে কী হবে?
-
আরে বাবা, সামনে পন্দ্ররা আগস্ট। ইস্কুলটায় বহুত ভিড় হয়।
-
উ আবার কী?
- বেবাকুফ! উস দিন আমাদের
আজাদী মিলেছিল। সাহেবরা আমাদের দেশ ছেড়ে ভেগে
গিয়েছিল। আমরা স্বোয়াধীন হয়েছিলাম। তারপর ভারত তারাক্কি
করে। বহুত বড়া দিন।
-
ইস্কুল সে কেয়া লেনদেন?
-
ঐ দিন ইস্কুলটায় ফাংশান হয়, গেটের বাইরে হরেক
কিসম চীজ বিক্রি হয়। পিছলে সাল একটা লোক ভারতের
পতাকা বানিয়ে বিক্রি করছিল। অনেক খদ্দের ছিল। ইস সাল তোরাও পতাকা
বানিয়ে নিয়ে যা। ভালো পয়সা পাবি।
-
লেকিন পতাকা বানাবো কী করে?
-
রহিমচাচার দোকান থেকে
লাল-সবুজ কাগজ আর লেই কিনে নিবি। তারপর চাচীর ঝাড়ু থেকে সরু সরু কাঠি নিয়ে
বানিয়ে ফেল্।
-
আমরা কোনোদিন বানাইনি, তুই দেখিয়ে দিবি?
-
ঠিক হ্যায়, কাল আমার ছুট্টি আছে, তোদের বাড়ি গিয়ে দেখিয়ে দেব।
বাবলু
দেখিয়ে দেবার পর রাবেয়ারা ভাইবোন মিলে অনেকগুলো পতাকা বানিয়ে ফেলে। দু’টাকা করে বেচলেও বেশ কিছুটা লাভ থাকবে। মনে মনে সব্বাই খুব খুশি হলো।
মুজাফরনগরের ‘ব্লু বেলস স্কুল’। ১৫ই আগষ্ট স্কুলটার প্রতিষ্ঠা দিবসও। সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। বেলার সাথে সাথে স্টুডেন্টরা তাদের গারজিয়নদের সঙ্গে আসা শুরু করে দিয়েছে। স্কুলের বাইরে যথারীতি নানান বিক্রেতারা তাদের জিনিষপত্র নিয়ে হাজির হয়ে গেছে।
স্কুলগেটের উল্টো দিকের ফুটে ছেঁড়া একটা চাদর বিছিয়ে রাবেয়ারা তিন ভাইবোন তাদের কাগজের পতাকা নিয়ে বিক্রী করতে বসে। আজ চার বছরের সাজাদ খুব উত্তেজিত। আপা-ভাইজানদের সাথে সেও আজ আসতে পেরেছে। তবে সে জানে, সারাদিন ভিড় দেখলেই হবে না, তাকেও বড়দের মতোন হতে হবে। কিন্তু কাজ না করলে বড় হবে কী করে? অগত্যা বড় হবার জন্য তার বায়না শুরু হলো। সাজাদকে শান্ত করাতে রাবেয়া তাকে একটা কাজ ধরিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর সাজাদও বড় হবার আনন্দে আপার দেওয়া কাজ পালন করতে স্কুলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজের পতাকা নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “লে লো ,
লে লো, দো রুপিয়া মে আজাদী লে লো”...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন