ফেক-আইডির মানুষ
ঘুম থেকে উঠে রোজকার মতো ফেসবুকটা খুলেছিলাম। জ্বলজ্বল
করছে, একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। কে পাঠালো কে জানে! আদ্ধেকের ওপর তো অচেনা অজানা;
শুধু ফ্রেন্ড-লিস্টে যোগ ক’রে চুপচাপ ব’সে থাকে – না কোনো কথা, না কোনো আদানপ্রদান। মানুষের ক্ষমতা টাকা-পয়সা এইসব বাড়ানোর
শখ আছে, জানতাম। অকারণ ‘বন্ধু’-তালিকা
বাড়ানোর শখ, ফেসবুক না থাকলে জানা হতো না।
যাইহোক, লাল রঙের সেই নোটিফিকেশনের ওপর ক্লিক করতেই,
রিস্ট-ওয়াচের ছবি দেওয়া এক প্রোফাইল। নাম, ‘হাতঘড়িতে কটা বাজে’। ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে
–
কনফার্ম / ডিলিট।
শালা, আবার ফেক আইডি! উফ! পারা যায়
না এদের নিয়ে। বারোজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ডও দেখাচ্ছে। একবার কারো
বন্ধু হতে পারলেই, এরা তার ফ্রেন্ড লিস্ট ধ’রে
মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে সবার বন্ধু-তালিকায়। এর আগেও এসেছে এরকম, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’, ‘সততার
সীমা’, ‘অবিবাহিত মানুষ’, ‘ক্ষুধাতুর প্রাণ’ আরও কত! সবগুলোই ডিলিট ক’রে দিয়েছি। কে না কে, জানা নেই
শোনা নেই, প্রোফাইল পিকচারের জায়গায় কখনো ফুল কখনো বিবেকানন্দ... অ্যাড ক’রে বিপদে পড়ি আর-কী!
আমি ডিলিট টিপি। কাঁটা ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে –
মোডেমের দিকে তাকিয়ে দেখি, নেট কানেক্সন কেটে গেছে। অগত্যা। কম্প্যুটার বন্ধ ক’রে উঠে পড়লাম। ‘হাত ঘড়িতে কটা বাজে’ – এসব নাম কার মাথায় যে আসে!
নিজের মনেই ভাবতে ভাবতে স্নান খাওয়া সারি, অফিস যাই।
নানা কাজের চাপে ভুলে গেছিলাম ব্যাপারটা। সন্ধ্যেয় ফিরতেই দেখি,
অর্জুনের স্ট্যাটাস। লিখছে, “কতরকম
ফেক আই-ডি দেখলাম। ইনি কিন্তু, ক্রিয়েটিভিটিতে সব্বাইকে টেক্কা দিয়েছেন। চলতে
ফিরতে বাসে ট্রেনে, এনার নামটি আপনাদের স্মরণ করতেই হবে। ইনি সাক্ষাৎ – ‘হাত ঘড়িতে কটা বাজে’...’
তার মানে অর্জুনকেও রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আমারটা ডিলিট হয়নি
সকালে। এখন আরেকবার খুলে দেখি, যথারীতি, যা ভেবেছিলাম, সকালে ছিল ১২, এখন ৬৭ –
মিউচুয়াল ফ্রেন্ড। এর মধ্যেই এতটা ছড়িয়েছে। আর বেশ হিটও হয়ে গেছে দেখছি। অর্জুনের
স্ট্যাটাসেই তো কত লোকের কমেন্ট। অধিকাংশই বিরক্ত, কেউ কেউ মজা দেখছে, জানাচ্ছে
তারাও ওই অদ্ভুত আই-ডি থেকে বন্ধুত্বের অনুরোধ
পেয়েছে। কয়েকটা ফেক আই-ডি দেখলাম আবার ‘হাতঘড়িতে কটা বাজে’-র পক্ষ নিয়ে লড়ছে। জ’মে গেছে ব্যাপারটা। নকল
আইডেন্টিটিগুলোর কি একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি থাকে? নাকি সবকটা আই-ডিই অলক্ষ্যে একটা লোক চালাচ্ছে?
বেশ ভগবানের মতো ব্যাপার-স্যাপার। একলা এক ঘরে ব’সে গোটা
ফেসবুক জুড়ে নানান কল্প-চরিত্র ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ – ভাবতে মজা
লাগে।
কমেন্টগুলো পড়ছিলাম।
‘সততার
সীমা’ লিখছে, “আপনারা নিজের নামে আই-ডি
বানিয়েছেন ব’লে কি আমরা উবে যাব? অত অহংকারের কোনো মানে হয় না।
সমস্যা আছে বলেই না ফেক আই-ডি নিয়ে ফেসবুক করছি।”
‘ঘড়িতে
কটা বাজে’ নিজেও কমেন্ট করেছে দেখলাম, “আমি তো কাউকে মারিনি, কামড়েও দিইনি। তবে এত রাগ কেন আপনাদের? সামান্য
বন্ধু হতে চেয়েছি। সেটা কি খুব বড় কিছু? মানুষের আসল নাম না জানলে কি তাকে সম্মান
দিতে মানা?”
অর্জুনের স্ট্যাটাস থেকে বের হতেই, চোখ পড়ল, সুবিমলের
স্ট্যাটাসে। সেখানেও প্রবল তর্ক, ঝামেলা ওই ‘কটা বাজে’কে ঘিরেই। কান্ডটা
একটু অদ্ভুত। রাণুদির স্ট্যাটাস প’ড়ে,
হাতঘড়ি সেখানে কমেন্ট করেছিল, কী ভালো লিখেছ দিদি! ব্যাস। ওমনি চারদিকে হল্লা প’ড়ে
যায় – চেনা নেই, জানা নেই, একজন ফেক আই-ডি কী ক’রে
কাউকে দিদি ব’লে ডাকে? বিপদে প’ড়ে
হাতঘড়ি জানায়, সে রাণুদিকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে। এতে জল আরও ঘোলা হয়। রাণুদিকে জেরা করলে, তিনি সপাটে চেনার বিষয়টা
অস্বীকার করেন। সবাই ঘিরে ধরে হাতঘড়িকে। ফেক হয়ে মানুষের সাথে সম্পর্ক পাতাতে
যাওয়া? সে এক তুলকালাম। হাতঘড়ির বয়েস, লিঙ্গ, গায়ের রঙ সব নিয়েই সাফল্ চলতে থাকে আলোচনায়। নানাভাবে একটা মানুষ দাঁড় করানোর
চেষ্টা ক’রে
চলেছে সবাই। নিরাকার এক আই-ডি তাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াবে, কাউকে দিদি ডাকবে
কাউকে ভাই, এ’ সহ্য করা যায় না।
মানুষের এই নাছোড়বান্দা মানবপ্রেম, হাতঘড়িকে বিপদে ফেলেছে
বোঝা গেল। ওই আলোচনার শেষদিকে সে দেখলাম, ঘোষণা করেছে, “আমি
আর আপনাদের মধ্যে থাকতে চাই না। আমি ভালোবাসা নিতে এসেছিলাম, দিতে এসেছিলাম,
কিন্তু আপনাদের ব্যবহারে আমি চ’লে যাচ্ছি। চব্বিশ ঘন্টার
মধ্যে আমার এই একাউন্ট বন্ধ ক’রে দেব। কাল থেকে আমাকে আর
আপনারা আপনাদের মধ্যে পাবেন না।”
ভালোবাসা-বাসির অংশটা নজরুল
থেকে ঝাড়া না? শালা ফেক আই-ডির ইমোশনটাও ফেক! হাসতে থাকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন