হেরম্ব চরিত
হাটগঞ্জকোরাস
ধারাবাহিকতা
থাকে না। ধারাবাহিক হয়ে উঠবার তীব্র আর্তিতে ধারাবাহিকতার ধারা বর্ণনার মধ্য দিয়ে
এক ধরনের ধারাবাহিকতাই হয়তো এসে যায়। ঝাপসা সব গোলোকধাঁধার বৃত্তায়নে কবেকার এক কাঠপুল আর পুল
থেকে নেমে এসে হাটগঞ্জের ভিতর যাওয়া। ধুলো ওঠার ব্যঞ্জনাময়তায় আটকে থাকা বিষণ্ণ
বিবর্ণ ইটচাপা ঘাসের মায়াবন থেকে ভেসে আসে মোরগলড়াই পর্ব। এইসব ঘটনাক্রম থেকে
জটজটিল ধাঁধার মতো এক পৃথিবী আবহমানের কালখণ্ড হয়ে জেগে উঠতে থাকে। মোরগলড়াই শেষ
হয়, তবে মোরগডাক থামে না। হাটের বিস্তার পেরিয়েও বিস্তারময়তার অচেনা কুয়াশাঘোরে বহু দূর থেকে দূরাগত হাওয়ার অনন্য
নকসার সাজে সেজে ওঠে সব কিছু। ডুবে যাওয়ার অবকাশটুকুও দেয় না, কেবল জল-জলায়
কোরাসের অনবদ্যতায় সন্ধেগুলি রাত্রিগুলি
ভোরগুলি হাতড়ে হাতড়ে তুলে আনতে চাওয়া ব্যাকুল সব পুঁথিপত্র, কতকথা।
কতকথাগুলি তুলোবীজ ফেটে উড়তে থাকে আকাশময়।
আঞ্চলিক ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধানমাঠ
এলুয়া কাশিয়ার ফুল লোকগাথার পুতুল ভগ্ন সব হর্ম্য অট্টালিকা দালানকোঠার বহুস্বরিক
এক ভুবনায়ন বর্ণময় হাটগঞ্জকোরাসের উষ্ণতর উত্তাপের ওম পোহাতে পোহাতে বসন্ত মালির
ঢোল ও বাঁশিতে ঢেউ তুলতে থাকে। এইভাবে গানসমগ্রের মধ্যে এসে দাঁড়াতে হয়। পথঘাট
জুড়ে অনন্যতার ধুলো ওড়ে। ধুলোতে ঢেকে যাওয়া স্মৃতিসকল ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে অংশত
দৃশ্যমানতা অর্জন করতেই কৌম সমাজের যৌথতার লীনতাপটুকু অন্তত টের পাওয়া যায়। রাতের
পাখিরা ডেকে ওঠে বন্ধ চোখের ভিতর। বাঁশবনে সংখ্যাতীত জোনাক জ্বলে। মোমবাতি জ্বেলে
কারা যেন খুলে বসে কবেকার সব ধারাবাহিকতা হারিয়ে বসা মেঘনদীবাজনার গান।
তিস্তাবুড়ি
হেরম্ব হেঁটে যাচ্ছে শূন্য সব মাঠ প্রান্তরের
মধ্য দিয়ে। হেঁটে যাওয়াটা তার নেশা, জীবনের সাথে তীব্র জড়িয়ে থাকা; যেন অন্তহীন এক
ভবিতব্য। হেরম্বর ঝাঁকড়া চুল সুপারিগাছের মতো পেশীবহুল নির্মেদ শরীর। ধারালো
বল্লমচোখ। মঙ্গোলয়েড মুখ। দু’চোখে ঢের মগ্নতা আপাত বিষাদ ছোঁয়ানো। হেরম্ব হেঁটে
যেতে থাকে মাইলের পর মাইল হেলাপাকড়ি বাঁকালী রামসাই জোড়পাকড়ি ভোটবাড়ি রাজারহাট
চূড়াভাণ্ডার পদমতীর চর বরুয়াপাড়া জল্পেশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ধান পাট তামাকের অত্যাশ্চর্য
জনপদগুলির মধ্য দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ধরলা জর্দা বালাসন সানিয়াজান এইসব আঞ্চলিক
নদীর জলে নেমে পড়ে সাঁতার কাটে, আবার কখনো ঘোড়াহাগা বিলে দু’দন্ড নিজের মুখ দেখে আবারো
হাঁটতে থাকে হাওড় বিল কুড়া দহের দিকে। হাঁটাই হেরম্বের নিয়তি, যেন নিশিডাক। হাঁটা শেষ হয় না, তবে একসময় হাঁটাটাই
যেন এসে ঢোকে বিষহরা গানের আসর জল্পেশ মেলা কিংবা ভান্ডানী ঠাকুরের থানে। এইভাবে
উত্তরের এক ভূমিপুত্র শ্রীহেরম্বচন্দ্র বর্মন তার আত্মপরিচয় ও উৎস খুঁজতে শুরু করে
এক ধরনের ঘুমঘোরের বাধ্যবাধকতাহীন
অনিবার্যতায়। তখন পাটখেত গমখেতে বৃষ্টির জমা জলে কিলবিল করে হেলেসাপ জলঢোড়া
সোনাব্যাঙ কোলাব্যাঙ আর লোকজ সুরের বহতায় বেজে ওঠে আদিঅন্তহীন সব গান। তিস্তাপাড়ের
গ্রামে গ্রামে তিস্তার চরে চরে সারাটা বৈশাখ মাস জুড়ে তিস্তাবুড়ির গান জাগে, মেচেনী
খেলায় মেতে ওঠে মেয়ে বউয়ের দল। অলংকৃত ছাতা মঙ্গলকলস দলবদ্ধ নাচের মোহগ্রস্থতায়
সীমাহীনতায় হাই তুলতে তুলতে এগিয়ে আসে নদীজলবাহিত চিরায়ত কুয়াশার দলা পাকানো শূন্যতারা।
এত কিছু ঘটে যায় হেরম্বের আপাত নিরীহ পদযাত্রার প্রায় পুরোটা জুড়েই।
খোসপাঁচালি
হাট বসে হাটের মতো। হাটের পরিসর এসে স্পর্শ
করে মন্দির, বৃহৎ জলাশয়। হাতের মধ্য দিয়ে মেচেনী খেলতে যায় মেচেনী দল। ঢাক বাজে।
মুখাবাঁশি। সানাই। হাটের নিজস্বতায় মিশে যেতে থাকে লোকবাজনার সমগ্রটুকু। এত সবের
যথাযথ হেরম্ব এসে পড়ে। দু’দশ বিশ পঞ্চাশ হাটগঞ্জ ঘোরা হেরম্ব হাটের রকমফের ও
বদলটুকু অনেক অনেক আগে কিছু কিছু হাটে সে দেখেছিল কোচবিহারের মহারাজার
শিকারযাত্রার মিছিল, কামতাপুরের জুলুস, রাণী অশ্রুমতীর জলসত্র উদ্বোধন, নুরুদ্দিন
জোতদারের সফেদ হাতি, ঝামপুরা কুশানীর কুশানযাত্রা,
আরো আরো অনেক কিছু। আবার হেরম্বের সাথে
জলধোয়া বসুনিয়ার প্রথম দেখাসাক্ষাত এরকমই কোনো হাটে। হাটের খন্ড অনুখন্ড উপখন্ড জুড়ে কত রকমের মানুষজন
কথাবার্তা খোসপাঁচালি। হাটের নিজস্ব ভাষায় হাট কথা বলে যায়। কথাবার্তার সূত্র ধরে
না দিলেও কথাবার্তা গড়াতে থাকে যেভাবে রাত গড়ায়। সকালের হাট বিকেলের হাট সন্ধ্যের
হাট সব ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে ভাঙা হাট। হাট ভাঙার অবসরে কূপির ছড়ানো ছড়ানো খন্ড
আলোর দোলাচলে হেরম্বর মনে পড়ে জলধোয়া
বসুনিয়ার গরুর গাড়িতে চড়ে আরো আরো পাইকার ব্যাপারীর সাথে ভাঙা হাটের ধুলো ও বিষাদ
মেখে গন্তব্যহীন কোনো গন্তব্যের দিকে চলে
যাওয়া। হেরম্ব বসে থাকে না, দাঁড়িয়েও না। আসলে থিতু হতে না পারার অনাবশ্যকতায় সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে
শরীরময় শ্যাওলার বহু বর্ণতা নিয়ে আবহমান জীবনের দিকে পা বাড়ায় হেরম্ব। তখন তার কোনো
অতীত বর্তমান থাকে না; ভাবনাস্রোত লুপ্ত হয়ে যায়। হাটের চারপাশে ধানমাঠ সর্ষেবাগিচা
পুকুরদহ সবই গ্রাস করতে এগিয়ে আসে গাঢ় এক
অন্ধকার, যা চিরায়ত। হাট থাকে হাটের মতো। হাটের গভীর থেকে গহন এক হাটই যেন উঠে
আসে।
(পরবর্তী কিস্তি আগামী সংখ্যায়)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন