প্রবাসীর পুজো
আরো কয়েকটা বছরের
মতো এইবারও 'মেঘের ভেলাগুলি ভেসে এলো
বাঙ্গালোরের আকাশে'। সুদূর
কল্পনার কাশফুলের কানে দখিনা বাতাস গাইলো ঘুম-ভাঙানির গান, আর
তারই সাথে ভারতীয় রেলের দাক্ষিণাত্যমুখী কামরাগুলোতে চাপলো রাঙ্গামাটির দেশের ঢাক
ও তাসা। দুর্দিনের বাজারে আই.আর.সি.টি.সি.র ওয়েবসাইটে
লাগলো ভিড়, 'তৎকাল সেবা' আর সেবা নয়, সৌভাগ্য। ঘন-ঘন টেলিফোন আসে বাড়ির লোকের, পাড়ার
প্রেমিকার, দুর্দিনের বন্ধুর, "এবার
পুজোয় আসছিস তো?"... "ঝুমরির
মেয়ে হয়েছে, তুই কবে বিয়ে করবি খোকা? দীপার মেয়ে আসছে পুজোয়, ইউনিভার্সিটিতে
ইকোনমিক্সে অনার্স, তুই আসলে আলাপ করতাম"।
"মা, এসব এখন রাখো, আমার মিটিং আছে, রাখছি", বলে দূরভাষ সংযোগ ছিন্ন করে নামী সফটওয়্যার কোম্পানির
ক্লান্ত কর্মচারী। গহন মানসচক্ষে সে দেখতে পায়,
সেই অর্থশাস্ত্র-প্রশিক্ষিতা গৌরবর্ণার
নীলাম্বরী শাড়ি অষ্টমী সকালের ঝিরঝিরে হাওয়ায় বিজয়ীর পতাকার মতো
উড়ছে, যেন একটা মর্মান্তিক ব্যঙ্গ তার শত চেষ্টার
ছুটির আবেদন নাকচ হওয়ার উপরে। কারো আসার সময় নেই, কারো আসলে সময় নেই...
দিন পনেরোতে অন্ততঃ ষোলোজনের
বাড়ি যেতে হবে। এতকাল বাদে বাড়ি আসা, প্রিয়জনেরা উন্মুখ হয়ে
থাকে সেই অর্ধবিস্মৃত মুখমণ্ডল দেখবার জন্য।
স্নেহের আর প্রেমের ডালি সাজানো থাকে বছরের পর বছর, অপেক্ষমান থাকে
শুধু একটিমাত্র বৈদ্যুতিন চিঠির- " ইওর লিভ ইজ এপ্প্রুভ্ড"।
তিরিশ বচ্ছর ধরে
আসছেন পাল মশায় এবং অন্যান্যরা, বাঙ্গালোরের
পুজোর ঠাকুর গড়তে। গত
কয়েক বছরে প্রতিমার সংখ্যা বেশ বেড়ে গিয়েছে; বাঙ্গালোর এখন দ্বিতীয়
বঙ্গ। 'বেঙ্গলী এসোসিয়েশনে' আর জায়গা হয় না, তাই
টিনের একটা অস্থায়ী চালা বানিয়ে তার নিচে
মৃণ্ময়ী রূপ ধারণ করেন মা দুর্গা।
নানা রূপে নানা সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে তাঁর
বেশবাস। তামিলদেশীয় গৃহস্বামী দেদার টাকা ভাড়া কাটেন, অথচ
সময়-অসময়ে তাঁর
থেকে সাহায্য বলতে কিছুই মেলে না। প্রবাসে তাদের মনে পড়ে কলকাতায়
কুমারটুলীর কথা,
সেইখানে শেষ তুলির টান কবে পড়বে তার কথা, দেশের বাড়ির কথা, মা'র
কথা, স্ত্রীর কথা, ছোট্টটির বায়নার
কথা, "বাবা, তুমি প্রত্যেকবার পুজোর
পরে কেন আসো?"
কে তাকে বোঝাবে যে,
বাঙ্গালোর সেখান থেকে কত দূরে। সেই শ্যামলা গাঁয়ে এখন হয়তো চন্ডী-মণ্ডপে
পাঠ সবে শেষ হয়েছে, হাতে কাশফুল দুলিয়ে ফিরছে ইস্কুল
ছুটির বাচ্চারা... আর গোধুলি
লগ্নে শঙ্খ ফুঁয়ের আওয়াজে মিশে যাচ্ছে নামতা পড়ার সুর। "মা, বাবা এইবার তাড়াতাড়ি আসবে তো?"
"হ্যাঁ বাবা, তাই তো বলেছে"। অস্থির বালকের বাবার চোখ যায় দেওয়ালে ঝুলন্ত ক্যালেন্ডারের
দিকে। মনে মনে দুগ্গা ঠাকুরকে ডাকে। এইবার বাবা আসলেই নতুন
জামা পরব,
মা'র কথা
কিচ্ছুটি শুনব না আমি। আমি যেন এবছর তোমায় অঞ্জলি বাবা মা
দুজনের সাথেই দিতে পারি।
আমার ফোনটা বেজে উঠলো, অপরপ্রান্তে
মা, "পুজোর জামা-টামা একটা কিছু কিনে নিস, তোর
আর জামাই-এর জন্যে টাকা পাঠালাম", "হ্যাঁ
মা, কিনে নেবখন", "মা, আমাকে একটা 'শুকতারা' পাঠাতে পারবে?" মা তো হেসে কুটিপাটি,
"তুই এখনও বড় হলি না... "। 'শুকতারা' চলে আসে,
সাথে 'আনন্দমেলা'ও। তাতে এখন 'সন্তু-কাকাবাবু'র অভিযান নেই বটে কিন্তু 'মিতিন মাসি'র উপাখ্যান রয়েছে। 'অর্জুন'কে স্থানান্তরিত করেছে 'ঝিনুক আর দীপকাকু'। কিন্তু সেই শীর্ষেন্দু রয়ে গেছেন
দেবাশিস দেব-এর চিত্রাঙ্কন সহযোগে, সেই
নারায়ণ দেবনাথও রয়েছেন।
প্রথম পাতার 'বাঁটুল',
যেন এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল পুজোর আগের দুপুরগুলোর। এখন
বাঙ্গালোরের দুরন্ত কর্মজীবনে, সারা সপ্তাহের শ্রান্তি
যেন কেটে যায় শুধু একটি রোববার দুপুরবেলার পুজাবার্ষিকী
তে। 'দেশ', 'সানন্দা', 'আনন্দলোক'
ইত্যাদি বড়দের খপ্পরে থাকত। খুব ছোটবেলা লুকিয়ে
পড়েছি তার লেখা,
কিছু বুঝিনি, কিছু বুঝতে চাইনি, আর বোঝবার যখন বয়েস হলো, তখন উচ্চমাধ্যমিক-অতিক্রান্ত আমি, চলেছি নতুন শহরের উদ্দেশ্যে...
জামশেদপুরের আরও অন্যান্য এক কিংবা দুইমাত্র সন্তানের মতো
উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়ে। মা, আমি তাই আর বড় হইনি,
হতেও চাই না... আমি সেই 'শুকতারা'র
প্রথম পৃষ্ঠাতেই আটকে রয়ে গেছি।
দিন ঘনিয়ে আসে, ষষ্ঠী
কাটে, সপ্তমী কাটে, দেবীর বোধন সাঙ্গ
হয়ে সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে যায়। আমি অফিসে কর্মরত অবস্থায় বরকে একটি মেসেজ পাঠাই,
"আজকে দেরি হবে কি?" জবাব আসে "দেখি"।আমার স্বামী মহাশয়টি নিতান্তই মিতভাষী, অন্ততপক্ষে
কম্পিউটার এবং ফোনের বেলায়। কিন্তু "দেখি"
নিয়ে তো আর অপেক্ষা করা যায় না... মনে
পড়ে যায় এইতো সেদিন (আসলে অনেক দিন) আমরা দুজনে 'সবুজ-সঙ্ঘে'
বসে কত আড্ডা দিয়েছি, তখন হঠাৎ
বন্ধুদের পাল ঘিরে ধরলে অর্ধস্ফুট প্রেমের কুঁড়ি অসমাপ্ত বক্তব্য নিয়ে আবার
লুকিয়ে পড়ত। তারপরে সবাই মিলে সারা জামশেদপুর চষে বেড়ানো, আর ঠাকুর দেখা শেষ হলে 'বেঙ্গল-ক্লাবের' মাঠে এসে বসা। সে সব এখন ইতিহাস।
অন্য বছর হলে, অষ্টমীর
সকালে ম্যানেজারের কাছে খবর যেত, "পেট খারাপ"। দুজনেই হঠাৎ "অসুস্থ"।
কিন্তু এইবার, আমাদের রাষ্ট্রপিতার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার আর প্রয়োজন পড়ল না, গুটি-গুটি পায়ে চললাম আমরা দুজনে কাছের পুজো
মণ্ডপের
সন্ধানে..."ইস্স, অঞ্জলিটা যেন মিস না হয়ে যায়"
... "পুজো কমিটির ওয়েবসাইটে টাইমিংটা
দেখে নিলেই পারতে"
উত্তর দেয় আমার বর। বাঙ্গালোরে প্রত্যেকটি পুজোর
একটি করে ওয়েবসাইট এবং ফেইসবুক পেজ রয়েছে। তাই পুজোর
চাঁদা
থেকে শুরু করে পুজো-কমিটির সদস্য হওয়া,
সবকিছুই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়। ছোটবেলা বাড়িতে
পুজোর চিঠি আসত, তা এখনো আসে হয়্ত,
তবে আমি সেটা এখন পুরোপুরি সমর্থন করি না। 'কাগজ-বাঁচাও'
আন্দোলনের আমিও এক ‘নিষ্ক্রিয়' কর্মী।
প্যান্ডেলে পৌঁছে
দেখি মাঠ জুড়ে লোকে-লোকারণ্য। সাতসকালে সক্কলে মিলে অঞ্জলি দিতে এসেছে। বাঙ্গালোর অবশ্য এই
দিক দিয়ে স্বনামধন্য। স্বাস্থ্য এবং সময়জ্ঞান এইখানে বেশিরভাগ লোকের প্রাথমিকতার
মধ্যে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ভিড় প্যান্ডেলের
ভিতরে, অঞ্জলি হচ্ছে। "তুমি যাও, আমি একটু কিছু খেয়ে আসি", ছুটল আমার বর
কবিরাজী কাটলেট-এর খোঁজে।
জমিয়ে আড্ডা...
শুধু দুজনেই, বাঙ্গালোরের বাঙালিরা কেউ কারো সাথে বিশেষ কথা
বলে না। ফোনের পরে ফোন ছোটে দূর-দূরান্তে বন্ধুদের কাছে, "কেমন কাটছে তোদের পুজো?" ওরা হাসে আর বলে, "যেমন তোদের কাটছে,
তেমনি.."।
দেখতে দেখতে দশমী এসে
গেল। প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ক্ষীণ সুরে বাজে বিদায়ের ঢাক। শব্দ-সীমা পেরোনো মানা। সুদূর জামশেদপুর বাড়িতে শাশুড়িমা একলা হাতে বরণের
ডালা গোছান আর মনে-মনে ভাবেন "ছেলেমেয়েগুলোকে কতদিন দেখিনা..."। বন্ধু
ও আত্মীয়-স্বজনদের দৌলতে হাসি-ঠাট্টায়
পুজোর দিনগুলি কেটে যায় ঠিকই, কিন্তু
বিজয়ার আশীর্বাদী ধান-দূর্বা যেন হাজার মাইল দূরে
সন্তানদের নতমস্তক স্পর্শ না করে তৃপ্তি পায় না।
অজ্ঞাতনামা
সীমন্তিনীর সিঁদুর নিজের শাঁখায় লাগিয়ে শেষ হয় আমার পুজো।
ফোনে ফোনেই
সারা হয় প্রণাম। বিসর্জনের ভিড়
চেঁচিয়ে ওঠে "দুর্গা
মাই কি জয়!
আসছে বছর
আবার এসো"।
আমি
মনে মনে বলি "না, আসছে বছর এখানে না..."।
হাল্কা শীতের চাদর
ছড়িয়ে পড়েছে শহরের সন্ধ্যায়। আমাদের ছোটবেলায় পুজোর
সময় ঠিক
এমনি ঠান্ডা পড়ত,
আর এখন সেইখানে পুজোর ঠাকুর দেখা মানে গলদ্ঘর্ম হয়ে ফেরত আসা। কী
দারুণ সব কিছু বাঙ্গালোরে!
সেই
আমেজি রোদ্দুর,
সেই
ঠান্ডা,
সেই মেঘের ভেলা, আর ঠিক সেই পুজোটাও
আছে। কিন্তু আমরাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছি!
জায়গাটা
ঠিক কোথায়, জানি না!
বোধহয়
শাঁসালো বেতনের
উচ্চাশা আর আমাদের পুতুলখেলার সংসারটার ঠিক মাঝখানে...
Khub valo hoyeche amrita di.... r o anek lekho tumi..... tomr nxt lekhar apekkhay roilm.... Rumpi
উত্তরমুছুন