মায়া-মেমসাব
স্নেহ যদি বিষম বস্তু হয় তাহলে মায়া ‘ভীষণ’ বস্তু। জগৎসংসার এই মায়ার টানে পড়ে আছে কেমন, দেখলে খুব আশ্চর্য লাগে। সংসারের ওপর মায়া, টাকার ওপর মায়া, বইয়ের ওপর মায়া, প্রিয় কোনো ড্রেসের ওপর মায়া, সন্তানের ওপর মায়া, পোষ্যের ওপর মায়া – এসব নতুন কিছু না। মায়ার এই ঘনঘটা আকছার দেখা যায় সবার মধ্যে, সাধারণ বা অসাধারণ, তিনি যেই হোন না কেন। মায়া মিথ্যে, মায়া ছলনা – কে আর মনে রাখছে! আমি তো রোজ মায়া দিয়ে ঘরদোর মুছি, রান্নাঘরে মায়ার তরকারী রাঁধি। রাস্তাঘাট আমায় মায়া দিয়ে ভোলায়, পিঁপড়ের চলায় মায়া এসে আমার চিনি খেয়ে যায় আর আমি চুপচাপ দেখি, কিছু বলি না। ‘লক্ষ্মণরেখা’ যেমনকার তেমন পড়ে থাকে, আমার আর দাগ টানা হয় না। মায়া এসে অবাধে সেঁধিয়ে যায় আমার ভাতেপাতে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় – মায়াকে কেমন দেখতে? ওহ, মায়া নিরাকার বুঝি! আচ্ছা মায়া নামের কোনো মহিলাকে কেউ দেখেছ কেউ? এক চেনা পরিচিত মহিলার নাম ছিল, ছায়া। শুনেছি তার বোনের নাম - মায়া। আমার সাথে তার দেখা হয়নি কোনোদিন। যদিও জানি, মায়া নামের হাজার হাজার মহিলা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই পৃথিবীতে। আমার কিন্তু মায়া মনে এলেই ‘মায়া মেমসাব’ সিনেমার কথা মনে আসে। সেই যে - এক ট্রেনে চুল খুলে ফেলছেন মায়া শাহরুখ খানের সামনে! ওই খোলা চুল কেমন যেন গুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার মনটাকে। আমার আর তার পরের দৃশ্যের কথা মনে থাকছে না। শুধু ওই যে ক্লিপ থেকে চুল খুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে স্লো মোশনে… ওই দৃশটায় আটকে থাকছি আমি। কেন এমন হলো, এর কোনো যুক্তি দেওয়া যাবে না, একেই বুঝি মায়া বলে!
সেদিন জীবনানন্দের চেয়ারটির ছবি দেখে কেমন যেন শিউরে উঠলাম! অথচ আগে রবীন্দ্রনাথের চেয়ার দেখে এমন অনুভূতি হয়নি। জীবনানন্দের চেয়ার দেখে আমার নিজের চেয়ারটার কথা মনে এলো। যেটুকু যা লেখালেখি, তার বেশির ভাগই এখানে বসে লিখেছি আমি। অন্য কোথাও বসে কিছু লিখলেও ফাইনাল টাচ কিন্তু এই চেয়ারে এসেই হয়। সকালে এক কাপ চা নিয়ে এই চেয়ারে না বসলে আমার নেশা কাটে না। খুব মন খারাপ হলে এই চেয়ারে ঝুম মেরে বসে থাকি, আবার যখন-তখন অবরে সবরে এখানে এসেই একটু জিরিয়ে নিই। খুব ইচ্ছে হয় – যেন মৃত্যুও আসে এই চেয়ারে! একটা সাধারণ কাঠের চেয়ারের জন্য এই মায়া কেন পুষি আমি? এর কোনো উত্তর হয় না, আমি জানি।
নিজের মোবাইল, নিজের ল্যাপটপের ওপর মায়া কার না থাকে! আমারও কম কিছু নেই। যখন কিছু কাজ বা লেখার কিছু থাকে না, কি-বোর্ডের ওপর আঙুল চালাই মিছিমিছি। ঠিক আঙুল চালানো নয়, একটু একটু করে ছুঁয়ে থাকি ওদের, ওদের চারকোণা এক একটা চেহারার খাঁজে খাঁজে যত ধুলো জমে, মুছে দিই যত্ন করে। আঙুলের ছাপ লেগে আছে যাদের ওপর, তাদের আদর দিই একটু বেশি। ওরা যে আসলে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমারই জন্য! ক্যাপস লককে বলি – অত বাড় বেড়ো না! শিফটকে বলি – আহা সোনা আমার, খেটে খেটে কেমন কালি বর্ণ হয়ে গেছিস! আর সব চেয়ে রাগ করি এসকেপের ওপর – ও আমার চোখের বালি।
আর সেই যে সেই হলুদ বেড়াল – তার কথা আর বাদ দিই কীভাবে! কোথা থেকে আমদানী হয়ে এলো আমার বাড়ির পাশে, আমারই গায়ের কাছে, কে জানে! ও যখন ছোট্টোটি ছিল, রাতে এসে ঘুমিয়ে থাকত আমার ল্যাপটপের ব্যাগের ওপরে। আর কোত্থাও না, সোফা না, বিছানা না, ল্যাপটপের ব্যাগের ওপরেই! রোজ সকালে ব্যাগে আটকে থাকা ওর রোঁয়া পরিষ্কার করা ছিল আমার রোজকার রুটিন। রোজ ভাবতাম, প্রচন্ড মারব ওকে দেখলেই, ব্যাটা রাস্তার বেড়াল… কিন্তু কোনোদিনই সে সুযোগ পাইনি। পাইনি বললে মিথ্যে বলা হবে আসলে, ওকে হাতের কাছে পেলে আমার কেমন হাত ব্যথা করে উঠত, লাঠি ছুঁড়ে মারলে ফস্কে যেত যথারীতি। এখন ও ওসব দুষ্টুমী-টুস্টুমী ছেড়ে বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। খাওয়ার সময় হলে উদাস মুখ করে খেয়ে যায়, কোনোদিন হয়তো নেড়েঘেঁটে কিছুটা ফেলে রেখে যায়। সারাদিনের সফর শেষে, আমার প্রিয় চেয়ারটার পাশে যে জানালা আছে, সেখানে এসে ঝিমোয় বা ঘুমোয়। এই জানালা দিয়ে যেহেতু আকাশ দেখা যায় না, পাশের বাড়ির পাঁচিলে চোখ আটকে যায়, তাই আমি ওকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। ওর কোনো নাম দিইনি, ‘এই’, ‘ওই’ বলেই চালিয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি ও বুড়ো হচ্ছে, যে কোনোদিন হয়তো মরে টরে যাবে… এটাই তো স্বাভাবিক একটা রাস্তার বেড়ালের ক্ষেত্রে।
আর কুকুর! তাদের কথা আর কী বলি! আমার রোজকার যাতায়াতের পথে যতগুলো কুকুর দেখতে পাই, তাদের প্রত্যেককে আমি পার্সোনালি চিনি। মানে কী করে যে চিনলাম, নিজেই জানি না। ওদের সঙ্গে কেউ আমার ফর্মালি আলাপ করিয়ে দেয়নি। একটা এক-কান ঝোলা কুকুর (তার অন্য কান খাড়া) একবার এক নর্দমায় মুখ ঢুকিয়ে মাথা-টাথা আটকে সে কী অবস্থা! তিনটে কালো কুকুর আছে, ওদের তিনজনকেই কিন্তু আলাদা দেখতে। আর একটা থ্যাবড়া-মুখো বাদামী কুকুর আমাকে দেখলেই আমার পিছু নেয়। যত বলি – যা যা, সে আমাকে একেবারে বড় রাস্তা অবধি পৌঁছে দিয়ে তবে ফেরে। গত বছর একটা কুচকুচে কালো-কুকুর (অন্য কালোগুলোর কোথাও না কোথাও সাদা ছিট থাকে) ক্ষেপে গেছিল। অনেককে কামড়ে দিয়েছিল। আমার ভীষণ ইচ্ছে হতো, আয় বাবা, আমাকে কামড়ে দিয়ে যা একবার, দেখি তো কেমন লাগে! কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই, ও আমার দিক মাড়ায়নি ভুলেও।
সন্তানের ওপর স্নেহ-মায়া প্রাণী মাত্রেরই থাকে। কিন্তু গাছের কি মায়া থাকে তার সন্তানের প্রতি! গাছ কি চিনতে পারে তার সন্তানকে! সহজ-সরল হিসেব ধরলে গাছ তার সন্তানকে চেনে না, চিনতে পারে না কিছুতেই। একটা মা-গাছ কোনোদিন তার সন্তানকে কোলে নেয়নি, এটা ভাবলেই সেই মা-গাছটার জন্য আমার মনটা হু হু করে ওঠে। হয়তো এই মা-গাছটার সন্তান তার থেকে একশো কিলোমিটার দূরে জন্মেছে, কেমন ভাবে বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে, কেমন ভাবে সে প্রথম মাথা ঝাঁকাতে শিখেছে, কেমন ভাবে প্রথমবার প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে একটু হেলে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় মাটিতে, এসব আর দেখা হয়নি মা-গাছটার। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখ খুঁটে কালো কাজলের টিপও পরিয়ে দিতে পারেনি সে তারা বাচ্চার!
আমার গ্যাস-ওভেনের বার্নারে যতগুলো ফুটো আছে, তাদের মধ্যে একটা একটু সৃষ্টিছাড়া রকমের চৌকোণো টাইপের, তাই ওটার ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে। কলেজে পড়াকালীন সময়ের একটা সাদা স্কার্ট আজও যত্নে তুলে রেখেছি আমি। আমার ছেলেটার মুখটা মেয়ের মতো লাগত বলে, ছোটবেলায় ওকে একটা ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলাম , সেটাও রেখে দিয়েছি। আমার ছোটবেলার আঁকিবুঁকি রাখা আছে, ছেঁড়াখোঁড়া গানের খাতাও। যেমনটা আর সবার থাকে আর কী! মায়া ছড়ানো আছে এ-সংসারে, টুক করে কুড়িয়ে নিলেই হয়। এখন যেন মনে হয়, মায়া একটা হালকা চাদরের মতো, যাকে অল্প শীতে গায়ে জড়িয়ে রাখতে ভালো লাগে। আবার চড়া রোদ উঠলে চাদরটাকে টান মেরে খুলে ফেলতে হয়। আমি কি মায়ায় জড়াই নাকি মায়া আমাকে জড়ায় – এই জড়াজড়িতে কখনও লেগে থাকে ওম, কখনও বা ঘাম – যার পাকদন্ডী বেয়ে চড়াই উৎরাই ভেঙে একবার ওঠা কিছুদূর পর্যন্ত, শিখর না ছুঁয়েই ফের নেমে আসার পথ ধরা, নামতে নামতে আবার ওঠার পরিকল্পনা করা – একটা অসম্পূর্ণ বৃত্তের মধ্যে আজীবন ঘুরপাক খেতে হয় এই ‘ভীষণ’ মায়া-মেমসাবের হাত ধরলে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন