চিত্রকর
পার্কের কোণের দিকের বেঞ্চটায় ওরা বসেছিল। প্রায়ই এসে বসে। যদিও বেশি দিনের দেখা-সাক্ষাৎ নয়। তবু।
তুলি আগে একাই এসে বসত। এই পার্কটা বেশ নির্জন। খুব বেশি যে
লোকজনের ভিড় জমে সকাল বিকেল, তা নয় কিন্তু। আর এই কোণের বেঞ্চটা একেবারেই খালি পড়ে থাকত। তুলি
এসে এই বেঞ্চটায় একাই বসত। হঠাৎ একদিন রং'কে
ওর চোখে পড়ে। রং এদিক ওদিক ঘুরছিল। তুলি হাত নেড়ে কাছে ডাকে। কোণের বেঞ্চটায় বসতে বলে। রংএর যে একটু অস্বস্তি হয়নি, তা নয়। একে
নির্জন পার্ক। তায় কোণের দিকের বেঞ্চ। কিন্তু কী হলো, ঝোঁকের মাথায় গিয়ে বসল তুলির
পাশে। সেই থেকে
মাঝে মধ্যেই ওরা এসে বসে। কিন্তু তুলি প্রায় একাই বকে যায়। রং সবটা শোনে ঠিকই। খুব একটা গা করে না। যা বলছে বলে যাক গোছের করে শুনে যায়। আর হঠাৎ উঠে পড়ে, চলে যায়। শুধু যাওয়ার আগে খুব ভালো থাকতে বলে যায়
তুলিকে। তুলি মন
দিয়ে ভালো থাকে। তুলি আবার পরদিন আসে, তার পরদিন আসে, তার পরদিন আসে। রং উধাও। পাত্তাই
নেই। আবার এক একদিন তুলি দেখে, রং আগে থেকে এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ও
এলেই উঠি উঠি ভাব।
তুলি রোজই ভাবে রংকে বলবে আরো রঙিন হতে। রোজই ভাবে বলবে চারপাশটা প্রচুর রংএ রাঙিয়ে দিতে।
পৃথিবীটা যেন সাদা-কালো ছবি। তাতে অবশ্য খুব যে দুঃখ তুলির, তাও নয়। সাদায় কালোয়
মন্দ কী! ওর যে একঘেয়ে লাগে, তাও নয়। কিন্তু রংকে দেখলেই ও কীরকম যেন উথলে ওঠে। ওর মনে পড়ে যায়, ও তো তুলি, রং ছাড়া ও কোন্
কাজেই বা লাগবে! আসলে ওর অস্তিত্ব তো নির্ভর করে আছে রংএর ওপর। রং যদি না রাঙায়, তো তুলি রইবে পড়ে। ভবের হাটে একা তুলির কি বা কাম! রংএর সেসব খেয়াল নেই। অবশ্য
খেয়াল আছে কী নেই, তাও তুলি ঠিক বোঝে না।
তুলি সেদিন খুব বেপরোয়া। যা থাকে কপালে, ও বলেই ফেলবে কথাটা। রং পাশে এসে
বসতেই ও বলে ফেলল। রংকে বলল আরও রঙিন হতে। রংকে বলল চারপাশটা তুমুল রঙে রাঙিয়ে
দিতে। লাল কমলা হলুদ নীল সবুজ আকাশী, সব রঙে রাঙিয়ে দিতে বলল। রং চুপ করে শুনছিল
শুধুন, দেখছিল তুলি প্রবল উচ্ছ্বাসে বলে চলেছে, উন্মুখ তুলি, শুধু রঙে ডুবিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। তারপরই যেন পুরো পৃথিবীটা লহমায় পাল্টে যাবে। যেন
পৃথিবীটা রঙিন থেকে আরও রঙিন হতে হতে এই মিল্কিওয়ে
গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়বে মহাবিশ্বের অন্য অন্য সমস্ত গ্যালাক্সি পর্যটনে...
এমনই উচ্ছ্বাস তুলির।
এক নিঃশ্বাসে অনেকটা বলে ফেলার পর তুলি
একটু দম নিতে থামল। রং উঠে দাঁড়াল। তুলি খুব অবাক। বিস্ময়ে চেয়ে রইল রংএর মুখের
দিকে। রং খুব শান্ত গলায় স্নেহের সঙ্গে বলল, "কিন্তু চিত্রকর কই, যে আঁকবে?"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন