উড়োমানব
উঁচু উঁচু
বাড়িগুলোকে দু’পাশে ঠেলে সরিয়ে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে গেছে একটা কালো মোটা রাস্তা। উত্তর থেকে দক্ষিণে। অথবা দক্ষিণ
থেকে উত্তরে। আসলে দু’দিকেই। ভাগাভাগি করে। রাস্তাটার ওপর পিস্টনের মতো
উল্লম্বভাবে নেমে আসা আগুনে রঙের রোদ পিষে দেয়
মানুষ, গাড়ি, পিচ। গলে নরম হয়ে যাওয়া কালো পিচের ওপর দিয়ে ছুটে চলে
লাল-নীল-হলুদ-সবুজ ছোট-বড় গাড়ি। কখনো জোরে, কখনো আস্তে। কখনো বিরতি। তখন লাল-হলুদ-সবুজ বাতির নিচে লাগানো ডিসপ্লে বোর্ড-এ স্থিতিশীলতা ছুটে চলে পিছন দিকে। ৬০... ৫৯... ৫৮...
৫৭...। রাস্তার দু’পাশে মেট্রো স্টেশনের হাঁ-মুখ ঠেলে এক সারি মানুষ গুড়ি মেরে
উঠে আসে পাতাল থেকে। পিঁপড়ে বা পোকামাকড়ের
মতো। তারপর মিলিয়ে যায় চলন্ত ফুটপাথে। আর এক সারি নেমে যায় পাতালে। পাশাপাশি।
নিয়মমাফিক ওঠানামা। যন্ত্রের মতো। রাস্তার কাটাকুটির ঠিক মাঝখানে এক ট্রাফিক পুলিস
কোনো না কো্নো দিকে মুখ করে হাত নেড়ে যায়
নিয়ত। গতিশীলতার নির্দেশ।
গতিশীল হওয়ার
নির্দেশ পেয়ে নানা রঙ ও ধাঁচের গাড়িগুলো পেরিয়ে যেতে থাকে রাস্তার মাঝের কাটাকুটি।
সেই কাটাকুটির ঠিক নাভির কাছ থেকে দক্ষিণ-পূব দিকে কোণাকুণি এগিয়ে গেলে থমকে যেতে
হয় বিশাল উঁচু বিল্ডিং-এ ধাক্কা খেয়ে। রাস্তার পাশেই। এলাকার সব থেকে উঁচু বিল্ডিং। সেই
বিশাল উঁচু বিল্ডিংটার একদম টঙে, ঠিক মাথার কাছটায়, লোহার ছোট্ট মাচার ওপর একটুখানি জায়গায় দাঁড়িয়ে
আছে একটা লোক। হাফ হাতা গেঞ্জি, গোটানো ফুলপ্যান্ট। নানা রঙে এমন ভাবে ছোপানো যে, তাদের আসল রঙটাই হারিয়ে
গেছে। নানা রঙের পোঁচ লাগা একটা টুপি আছে মাথায়। সেটার আসল রঙ সাদা
ছিল, হয়তো বা। জামা-প্যান্টের বাইরে বেরিয়ে থাকা কালো চামড়ায় অজস্র রঙ্গীন আঁচড়।
লোকটার কোমরে দড়ি বাঁধা। তাতেও রঙ লেগে আছে। দড়ির অন্য মুখটা ঐ লোহার মাচাকে
বিল্ডিংটার সাথে ধরে রেখেছে যে রডগুলো, তার একটার সাথে আটকানো। মাচার ওপরে দুটি আলাদা কৌটোয় সাদা আর কালো রঙ। লোকটা রঙ করছে। সাদা-কালো। ঐ বিল্ডিং-এর
গায়ে। তার ডান হাত চলছে নাগাড়ে, ক্ষিপ্র গতিতে।
বহমানতার এই সার্বিক
চিত্রকে ফালা ফালা করে, এই ধাবমান মুহূর্তকে হতভম্ব করে দিয়ে, ঠিক এই সময়, হঠাৎ,
আরও বেশি গতিময় এক উড়ন্ত মানুষ উঁকি মারে আকাশ ফুঁড়ে। তারপর সে এগিয়ে চলে, উড়তে
উড়তে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে, রাস্তা, মানুষ, গাড়ি, বাড়ির থেকে আরও খানিক ওপর দিয়ে, সেই মাচাটার খুব
কাছ ঘেঁষে। ঠিক রাস্তা বরাবর। কালো প্যান্ট, হলুদ জামা। হাত
দুটো ছড়ানো দু’দিকে। ডানার মতো। চুলগুলো ওড়ে,
হাওয়ায়। গাড়ি মানুষ মাড়িয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে, এগিয়ে চলে বিশাল, তার প্রকৃত আকারের থেকে কয়েকগুণ বড় এক
দ্রুতগামী কালো ছায়া। গ্লাস ধোয়া বাচ্চা ছেলেটা, আখের রসওয়ালা, পানওয়ালা, সিগারেট
খাওয়া যুবক, মোবাইলে কথা বলা যুবতী, আখের রস খাওয়া বুড়ো লোকটা, ভিখারিনী মা ও তার
হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা, ‘দাম্পত্য সুখের চাবিকাঠি’ বিলি করা লোকটা, ট্রাফিক গার্ড,
মেট্রো স্টেশনে ঢোকা এবং বেরোনো দুটো লাইন, ফুটপাথ ও রাস্তায় ধাবমান সমস্ত মানুষ এবং সমস্ত গাড়ি এক লহমায় স্থির হয়ে যায়।
নিশ্চল, স্থবির। হঠাৎ, আচমকা, খুলে যায় সেই উড়ন্ত মানুষের পেট। তারপর নেমে আসে শয়ে
শয়ে, বোমার মতোই, রঙ্গীন কাগজের টুকরো। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। গাড়ির ফাঁক গলে, গলে
যাওয়া পিচে আটকে গিয়ে, সেই কাগজের টুকরোগুলো কালো রাস্তাটাকে করে তোলে রঙ্গীন।
দৃশ্যের মধ্যে ধরা
পড়া সমস্ত ব্যস্ততাকেই যখন স্থবির বিবশ করে দিয়ে উড়ে চলে ঐ মানুষ এবং তার কালো
ছায়া, তখন, ঠিক তখনই, সেই খাড়াই বিল্ডিং-এর টঙে, সেই ছোট্ট লোহার মাচার ওপর থেকে একটা মানুষ ভাসতে
শুরু করে, শূন্যে। সেই রঙের মিস্ত্রী, পড়ে যায়, মাচা থেকে নিচে, চিৎ হয়ে। কোমরে বাঁধা
দড়িতে আটকে যায় নিচে নামতে থাকা তার শরীর।
গোঁত্তা খায়। তারপর চিৎ অবস্থায় দুলতে থাকে। পেন্ডুলামের মতো। হাত
দুটো ছড়ানো দু’দিকে। ডানার মতো ঝাপটায়। কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। পা
দুটোও ছটফট করে। খানিকক্ষণ। তারপর মাজা ভেঙে, হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়ে,
ফ্লাইওভারের মতো বেঁকে স্থির হয় তার শরীর। ঝুলতে থাকে, স্থবির, বিবশ। সুতো দিয়ে
বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা খেলনা এরোপ্লেনের মতো।
উড়ন্ত মানুষটার পেট
থেকে ফেলা এক টুকরো রঙ্গীন কাগজ সেই রঙের মিস্ত্রীর মাচায় রাখা কালো রঙের ডিব্বায়
পড়েছিল গোঁত খেয়ে। খানিকটা রঙে ডুবে গিয়েছিল। বাকিটা কৌটোর বাইরে বেরিয়ে ছিল। সেই
বেরিয়ে থাকা অংশতে লেখা ছিল: ‘উড়োমানব’— আসছে— উড়তে উড়তে আসছে। দেশকে উড়তে শেখাবে — আপনাকেও উড়তে শেখাবে। আরও গতিসম্পন্ন হতে ভোট দিন ‘উড়োমানবকে’। বাকিটা আর পড়া যায় না। রঙে
ডুবে গেছে। একটু পরে আর কিছুই পড়া যায় না। ডুবে যাওয়া অংশটা থেকে শুষে নেওয়া রঙ
ছড়িয়ে পড়ে গোটা কাগজটায়। ভিজে ওঠে, নেতিয়ে যায় গোটাটাই। কালো হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন