‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া’
মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে। অনেকক্ষণ থেকেই দাঁড়িয়েছিল। আমি
দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। আমারও দাঁড়িয়ে থাকা অনেকক্ষণ হলো। আসলে যথাসময়ে ট্রেন
ধরতে না পারলে নির্ঘাৎ অফিস কামাই, তাই কিছুটা তাড়াতাড়িই স্টেশনে চলে আসি।
মেয়েটিকে আমি প্রতিদিন দেখি। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে
থাকে। একই জায়গায়। কিন্তু মেয়েটি কোন্ ট্রেন ধরে কোথায় যায়, তা জানার উপায় নেই।
মেয়েটির ট্রেন আসার আগেই আমার ট্রেন এসে যায় প্রতিদিন। আমি ট্রেনে উঠে পড়ি। মেয়েটি
দাঁড়িয়ে থাকে। তখনও।
মেয়েটি প্রতিদিন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি
প্রতিদিনই তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মেয়েটিকে স্থির হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু আজ যেন কিছু অন্যরকম মনে হলো। মেয়েটি স্থির হয়েই
দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। বেশ কিছুটা দূর থেকেই আমি দেখছি, তবু বুঝতে অসুবিধে হলো না যে,
মেয়েটি যে কোনো কারণেই হোক খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ছটপট করছে। তাহলে কি আজ আমার
ট্রেন আসার আগেই মেয়েটির ট্রেন এসে গেল! কোনোদিন তো এমন হয় না! আর ট্রেন আসার কারণেই
কি মেয়েটি হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে!
মেয়েটি এখন আর নির্দিষ্ট একই জায়গায় থাকতে না পেরে একটা ছোট্ট বৃত্তের
মধ্যে হাঁটাচলা শুরু করল। বেশ বুঝতে পারছি, মেয়েটির এই আচরণ ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়।
তার স্বভাববিরুদ্ধ। অন্যদিন এমন কোনো আচরণ করতে আমি দেখিনি। মনে হচ্ছে, মেয়েটি
খুবই অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। এবং সময় যত গড়াচ্ছে, ছটপটানি ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিন আমার ট্রেন আগেই এসে যায়। আজ কি আসতে দেরি করছে? হ্যাঁ, ঠিক তাই!
ঘড়ি তো সে কথাই বলছে। হয়তো সিগন্যাল পায়নি! অন্যদিন এতক্ষণে আমি অনেকটা দূর চলে
যাই। ট্রেনে চড়ার মুহূর্তে মেয়েটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই
দেখি। তাহলে আজ কি আমার ট্রেন দেরি করার
জন্য মেয়েটির এই অন্য আচরণ লক্ষ্য করছি? হতেই পারে। দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে
আমি রওয়ানা হবার পর তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসার আগে মেয়েটি নিশ্চয়ই প্রতিদিনই
এরকম চঞ্চল হয়ে ওঠে, ছটপট করতে থাকে।
হঠাৎ কেমন যেন একটা ঝোঁক চেপে বসল। ঝোঁকটা ক্রমে জিদে রূপান্তরিত হলো। আজ
মেয়েটির ট্রেনে ওঠার দৃশ্য আমাকে দেখতেই হবে। তার জন্য যদি আমি ট্রেন ধরতে না
পারি, তাতেও পরোয়া নেই। অফিস কামাই হলেও কিছু যায় আসে না।
আর ঠিক এই সময় দেখি তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ট্রেনটা আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে
স্থির হয়ে দাঁড়াল। আমিও কি এখন ঐ মেয়েটির মতোই রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠেছি? ছটপট
করছি? কিছুতেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি
না? কিন্তু কেন? একটু পরেই ট্রেনটা ছেড়ে দেবে। মেয়েটি এখুনি উঠে পড়বে ট্রেনে।
কোথায় সে যাবে, জানা নেই। কিন্তু মেয়েটি যে এই ট্রেনেই যাবে, তা তো জানা হয়ে গেল!
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি মেয়েটির দিকে। মেয়েটি আরও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তার
ছটপটানি আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু ঐ ছোট্ট বৃত্তের মধ্যেই সে নিজেকে আটকে রেখেছে কেন?
ও কি ট্রেনে চড়বে না? অন্যদিনও চড়ে না? তাহলে প্রতিদিন স্টেশনে আসে কেন? তিন নম্বর
প্ল্যাটফর্মে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কেন? আর ট্রেন আসার আগে হঠাৎ এমন অশান্তই বা
হয়ে ওঠে কেন? তাহলে কি সে কারও জন্য আসে!
কারও আসার প্রতীক্ষায় থাকে!
তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দু’ নম্বর
প্ল্যাটফর্মের ট্রেন এসে ঢুকল। আগের মতো আবার স্থির নিঃস্পন্দ হয়ে যাওয়া মেয়েটির
দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দিল।
তখনও আমার চোখ মেয়েটিরই দিকে। মেয়েটি এবার ফিরে যাচ্ছে। সুশ্রী মুখের যৌবনে
ভরপুর শরীরটা সে যেন অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন