আকাশই ছিল আমার শৈশবের ফেইসবুক
ক্যানবেরায় এসে আমার একটা বড় লাভ হয়েছে - আমি
আকাশটাকে ফিরে পেয়েছি। বাধাহীন দিগন্তজোড়া জলরঙা আকাশ – আমার
শৈশবের আকাশ।
আমার দুধ দাঁতের বয়সে কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যাগুলোতে ঠাকুরমা পুকুরের কোণে চাটাইয়ে শুয়ে রূপকথা বুনতেন। রূপকথায় চরিত্র হয়ে নেমে আসত মাথার ওপরের সপ্তর্ষি, ধ্রুবতারা আর কালপুরুষরা। গল্পে ভেসে ভেসে এরা আমার খেলার সাথী হয়ে উঠত। কিছুদিন পরে কাহিনীতে সপ্তর্ষির বশিষ্ঠ, পুলস্ত্যদের জায়গায় বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথরা চলে এলেন। তখন সূর্য ডুবলেই আমার আকাশে সন্ধ্যাতারা হয়ে ভেসে উঠতেন বিদ্যাসাগর। নিজেকে ভাবতাম এক দরিদ্র-মাতৃভক্ত বালক বিদ্যাসাগর, যে কিনা অতি অল্প বয়সেই দুনিয়ার সকল বিদ্যা আয়ত্ত্বে এনে, অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করে সমাজের জন্য, শিক্ষার জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দেবে। যাইহোক এমন খেলা করতে করতে দিনে দিনে আকাশ হয়ে উঠল ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’। ঠাকুরমা গল্প শেষে প্রায়ই বলতেন – আকাশের মতো বিশাল হতে হবে। বলতে বলতে তিনি নিজেই একদিন আকাশের শুকতারা হয়ে গেলেন, আর বিদ্যাসাগরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বর্গের বিধবাদের বিবাহ দিতে। আমার নিজের জন্য রইল শুধুই আকাশ - শৈশবের প্রত্যেকটা অভিযোগ জমা রাখার নিজস্ব ডেটাবেজ, প্রত্যেকটা আনন্দ শেয়ার করার সাতরঙা মনিটর। আসলে আকাশই ছিল আমার শৈশবের ফেইসবুক।
স্কুল পাশ করে যেদিন লঞ্চে করে ঢাকায় আসছিলাম, পদ্মায় ধুয়ে যাচ্ছিল আমার শৈশব – ভেসে যাচ্ছিল শৈশবকে ছুঁয়ে থাকা আকাশ। ঢাকায় এসে ওই আকাশটাকে আমি আর পাইনি। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে ওপরে তাকালে যা দেখতাম, তাকে আর নিজের মনে হতো না। নটরডেম কলেজ শেষ হলে গ্রাজুয়েশনের জন্য আমাকে টেনে নিল সিলেট। সেশন জ্যাম, ঝুলে থাকা ভবিষ্যত, চিঠিতে করে বাবার ফাঁকা পকেটে ইঁদুর চালান দেওয়া মিলিয়ে সময়টা ছিল বিবর্ণ - একেবারে বাংলাদেশের গতানুগতিক স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রের মতোই। সেই বিবর্ণ সময়ে মুচকি হেসে চোখ টিপে হাজির হয়েছিল আমার শৈশবের আকাশটা। সারাদিন ইলশে গুড়ি বৃষ্টি নিয়ে সিলেটের আকাশ কিছু না বলেই রঙ বদলায়। মেঘ খুবই ঘন ঘন দুগ্ধবতী হয়, আর আকাশও সারাদিনই একটু একটু করে নামতে থাকে প্যারাস্যুট বেয়ে। এই নেমে আসা মেঘের দুধে আমার কষ্ট ভিজে তুলোর মতো হয়ে যেত, ব্যথা লাগত না। আবার মাঝে মাঝে মেঘ বিদায় নিলে মেঘালয়ের ঝকঝকে শিলঙ পাহাড়ের সারি লাবণ্যের আঁচলের মতো ভেসে উঠত উত্তর আকাশে। চারতলার ওপরে মেসের বারান্দা থেকে একেবারে ঝকঝক করত শিলং। আমি তখন অমিত রায়, আমার বারান্দা ‘শেষের কবিতা’- চোখের সামনে লাবণ্য হাঁটছে শিলঙের ঝকঝকে চুড়া বেয়ে। আকাশ বলছে, ‘For God's sake hold your tongue and let me love’. আমি যেন কাকে শোনাচ্ছি –
আমার দুধ দাঁতের বয়সে কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যাগুলোতে ঠাকুরমা পুকুরের কোণে চাটাইয়ে শুয়ে রূপকথা বুনতেন। রূপকথায় চরিত্র হয়ে নেমে আসত মাথার ওপরের সপ্তর্ষি, ধ্রুবতারা আর কালপুরুষরা। গল্পে ভেসে ভেসে এরা আমার খেলার সাথী হয়ে উঠত। কিছুদিন পরে কাহিনীতে সপ্তর্ষির বশিষ্ঠ, পুলস্ত্যদের জায়গায় বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথরা চলে এলেন। তখন সূর্য ডুবলেই আমার আকাশে সন্ধ্যাতারা হয়ে ভেসে উঠতেন বিদ্যাসাগর। নিজেকে ভাবতাম এক দরিদ্র-মাতৃভক্ত বালক বিদ্যাসাগর, যে কিনা অতি অল্প বয়সেই দুনিয়ার সকল বিদ্যা আয়ত্ত্বে এনে, অনেক টাকা পয়সা উপার্জন করে সমাজের জন্য, শিক্ষার জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দেবে। যাইহোক এমন খেলা করতে করতে দিনে দিনে আকাশ হয়ে উঠল ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’। ঠাকুরমা গল্প শেষে প্রায়ই বলতেন – আকাশের মতো বিশাল হতে হবে। বলতে বলতে তিনি নিজেই একদিন আকাশের শুকতারা হয়ে গেলেন, আর বিদ্যাসাগরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বর্গের বিধবাদের বিবাহ দিতে। আমার নিজের জন্য রইল শুধুই আকাশ - শৈশবের প্রত্যেকটা অভিযোগ জমা রাখার নিজস্ব ডেটাবেজ, প্রত্যেকটা আনন্দ শেয়ার করার সাতরঙা মনিটর। আসলে আকাশই ছিল আমার শৈশবের ফেইসবুক।
স্কুল পাশ করে যেদিন লঞ্চে করে ঢাকায় আসছিলাম, পদ্মায় ধুয়ে যাচ্ছিল আমার শৈশব – ভেসে যাচ্ছিল শৈশবকে ছুঁয়ে থাকা আকাশ। ঢাকায় এসে ওই আকাশটাকে আমি আর পাইনি। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে ওপরে তাকালে যা দেখতাম, তাকে আর নিজের মনে হতো না। নটরডেম কলেজ শেষ হলে গ্রাজুয়েশনের জন্য আমাকে টেনে নিল সিলেট। সেশন জ্যাম, ঝুলে থাকা ভবিষ্যত, চিঠিতে করে বাবার ফাঁকা পকেটে ইঁদুর চালান দেওয়া মিলিয়ে সময়টা ছিল বিবর্ণ - একেবারে বাংলাদেশের গতানুগতিক স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রের মতোই। সেই বিবর্ণ সময়ে মুচকি হেসে চোখ টিপে হাজির হয়েছিল আমার শৈশবের আকাশটা। সারাদিন ইলশে গুড়ি বৃষ্টি নিয়ে সিলেটের আকাশ কিছু না বলেই রঙ বদলায়। মেঘ খুবই ঘন ঘন দুগ্ধবতী হয়, আর আকাশও সারাদিনই একটু একটু করে নামতে থাকে প্যারাস্যুট বেয়ে। এই নেমে আসা মেঘের দুধে আমার কষ্ট ভিজে তুলোর মতো হয়ে যেত, ব্যথা লাগত না। আবার মাঝে মাঝে মেঘ বিদায় নিলে মেঘালয়ের ঝকঝকে শিলঙ পাহাড়ের সারি লাবণ্যের আঁচলের মতো ভেসে উঠত উত্তর আকাশে। চারতলার ওপরে মেসের বারান্দা থেকে একেবারে ঝকঝক করত শিলং। আমি তখন অমিত রায়, আমার বারান্দা ‘শেষের কবিতা’- চোখের সামনে লাবণ্য হাঁটছে শিলঙের ঝকঝকে চুড়া বেয়ে। আকাশ বলছে, ‘For God's sake hold your tongue and let me love’. আমি যেন কাকে শোনাচ্ছি –
‘ছাদের উপরে বহিয়ো নীরবে –
ওগো দক্ষিণ-হাওয়া
প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে
চারি চক্ষুতে চাওয়া’
আকাশের সাথে এমন প্রেম প্রেম খেলতে খেলতে একদিন সিলেট থেকে চলে আসলাম। ঢাকায় এসে ওপরের দিকে তাকালেই মনে হতো – ‘তুমি আর নেই সে তুমি!’ বেকারত্ব, চাকরি, সংসার কত কিছু মিলে আকাশের অভাবও আর বিশেষ মনে ছিল না। অনেক দিন পরে ক্যানবেরায় এসে আবার ফিরে পেলাম সেই অসীম গগনকে – আমার শৈশবের ফেইসবুককে। শৈশবের মতোইই রাতের আকাশে খুঁজতে শুরু করলাম সপ্তর্ষিমণ্ডলকে। অনেকদিন খুঁজে চলেছি – মনে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে এক রাতে অস্ট্রেলীয় ফিল্ম আর্কাইভের সামনে দিয়ে আকশের দিকে চেয়ে হাঁটছি। হঠাৎ এক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, কী খুঁজছি? শুনে বললেন, ‘আহা, বোকা ছেলে, অস্ট্রেলিয়া তো পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে, আর দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে সপ্তর্ষি দেখা যায় না।’ একেবারে পরিষ্কার বোল্ড। কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি তো বোকাই, বোকা না হলে এ যুগে কেউ কবিতা লেখে? কবিদের এত কিছু জানতে হয় না!
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা দূর করে হাসিমুখে বৃদ্ধাকে বললাম, তুমি সপ্তর্ষি দেখেছ?
- দেখেছি, প্রশ্নচিহ্নের মতো। শ্রীলংকা গিয়েছিলাম অনেকদিন আগে।
- এরকম সুন্দর একটা জিনিসকে তোমরা ইংরেজিতে ‘গ্রেট বেয়ার’ মানে ভল্লুক নাম দিলে?
-হুম, এখানেই তোমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দর্শন, সংস্কৃতির সাথে আমাদের পার্থক্য। আমি জানি, তোমরা ওই তারকামণ্ডলীকে সাতজন ঋষির নাম দিয়েছ, বিস্ময়কে সৌন্দর্যকে সম্মান করেছ। এই জায়গায় আমরা সেটা করতে পারিনি। কেন পারিনি, সেটা আকাশ বলতে পারবে। আকাশ সব জানে - আকাশের চেয়ে বিশাল তো আর কিছু নেই!
তাকিয়ে তাকিয়ে বৃদ্ধার চলে যাওয়া দেখছিলাম। শব্দটা তখনও ভাসছিল - ‘আকাশ সব জানে - আকাশের চেয়ে বিশাল তো আর কিছু নেই!’ একথা কিন্তু ভিক্টর হুগো মানবেন না - লা মিজারেবলে মানুষের আত্মাকে তিনি আকাশের থেকেও বড় করে তোলেন – ‘There is one spectacle grander than the sea, that is the sky; there is one spectacle grander than the sky, that is the interior of the soul’. আত্মা আকাশের চেয়েও মাহাত্ম্যপূর্ণ! কী জানি - আমি তো এমনিতেই মাইনাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করে বাইরেটা দেখি, আত্মার অন্তঃস্থলের মতো সূক্ষ্ম জিনিস দেখা আমার কাজ নয়। তারচেয়ে মাথার ওপর বিশাল আকাশ দেখতে দেখতে আমি বরং শৈশবের কোলে উঠে আবার নিজেই আকাশ হয়ে যাই। আর একবার না হয় শৈশবের মতো নিখাদ স্বার্থপর হই, সুন্দর কিছু দেখলেই মুগ্ধতা মাখা অকৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠি - ‘তুমি আমারই, তুমি আমারই - মম অসীম গগন বিহারী’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন