গল্পঃ বিকাশ সরকার (দেশ পত্রিকা, ১৭
অক্টোবর,২০০৯)
নাট্যরূপঃ
সুভাষ ঘোষ
[এ.এম.আর.আই
হাসপাতালে, আভ্যন্তরীণ চিকিৎসাকালীন, নেহাতই ব্যথা ভোলার জন্যে চোখ বোলাচ্ছিলাম পুরনো একটা ‘দেশ’
পত্রিকায়। শ্রীবিকাশ সরকার রচিত ‘আলোকবর্ষ দূর’
গল্পটি পড়েও ফেললাম। গল্পের মতোই গল্প এগোচ্ছিল, হঠাৎই গল্পের শেষটা মনের মধ্যে
একটা বিরাট জানালা খুলে দিল। মনে হলো, নেতা- অভিনেতা, দাতা-গ্রহীতা কিংবা জীবনের
বিভিন্ন সিঁড়িতে অবস্থান করতে থাকা মানুষগুলোর জীবন দর্শন যত বিভিন্নই হোক,
প্রত্যেকের মনের মণিকোঠায় একটা কুঠরি আছে, যেটা প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে ভরা। সেই কুঠরির দরজা যদি কোনোভাবে খুলে
যায়, সে প্রেমের বন্যায় ভেসে যায় তার
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কোনো কিছুই তাকে সেই বন্যা থেকে বাঁচাতে পারে না। অদম্য
এক ভালোবাসার ঘূর্ণায়মান আবর্ত তাকে অঙ্গুলি-নির্দেশ
করতে থাকে আলোকবর্ষ দূরের দিকে।
সেই গল্পকে
অবিকৃত রেখে সংক্ষিপ্ত নাটকে রূপান্তরিত করার আমার একটা প্রয়াস। কিছু চরিত্র বাদ
দিতে হয়েছে, হয়তো বা পরিবর্তিত হয়েছে ঘটনার পর্যায়ক্রম। লেখকের কাছে আমি এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।]
নাটকে গৃহীত
চরিত্র
তুষ্টুঃ
বর্দ্ধিষ্ণু চাষীর সন্তান বকুল মন্ডলঃ চাষা ও তুষ্টুর বাবা
নিত্যানন্দ চক্রবর্তী, জগ্ননাথ দেঃ বাবার
বন্ধু ভেলু অধিকারীঃ গুন্ডা
ডঃ প্রতুল বিশ্বাসঃ ফার্টিলিটি ক্লিনিকের ডাক্তার কমলাঃ
তুষ্টুর মা
স্বপ্নাঃ নিত্যানন্দ চক্রবর্তীর মেয়ে, তুষ্টুর প্রেমিকা, পরবর্তী কালে
স্ত্রী
(১)
বকুল মন্ডলের বাড়ি,
সময় – সকাল
বাবা- অ
তুষ্টু কি কত্তিছিস? যা না বাবা, নুতন দালান কোঠার পেলাষ্টারে ইট্টু জল দে আয়। সেই
রাত থাকতি উঠি শুরু করিছি এই সংসার ঠেলতি-আর পারতিছিনা। যা না বাবা ।
ছেলে- দাঁড়াও,
ব্রাশটা করে নি!
বাবা- দিনি দিনি কত যে দ্যাখফো। চাষার
ছ্যেলে, তার আবার বেরাশ করা চাই! তোর বাপ ঠাকুরদা কবে বেরাশ দিয়ে দাত মাজিছে রে?
ছেলে- ঠিক তাই, আমার বাপ-ঠাকুর্দার
দিন শেষ হয়ে গেছে। তুমি যে অত বড় দালান কোঠা বানালে, তোমার বাপ-ঠাকুর্দা কবে দালান
কোঠায় থেকেছে? তুমি যে ট্রাক্টার দিয়ে চাষ
করাচ্ছ, ধান ভানার মেশিন বসিয়েছ, তোমার
বাপ-ঠাকুর্দা কোনোদিন ভেবেছিল? তোমার বাবা, আমার ঠাকুর্দা গোলক মন্ডল দূরামারি
গ্রামে এসেছিল, জঙ্গলে। এখন কোল্ড ড্রিঙ্কস পাওয়া যায়, মেয়েরা জিন্স পরে, ভিডিও
ফিল্ম পাওয়া যায়, বিউটি পার্লার খুলেছে -- এগুলো পরিবর্তন না? দিন কাল সব সময়
পাল্টায় -- তোমারো পাল্টেছে, আমারো পাল্টেছে। বাপ-ঠাকুর্দা তুলে কথা বলবে না -- বুঝলে!
বাবা- ঠিক
আছে, ঠিক আছে, কোনোমতে তো ঠেলেঠুলে ইসকুলের গন্ডী পেরাইছিস, কতা তো কোস এক্কারে
দুঁদে উকিলির মতোন। কোথাও
বার্যেচ্ছিস
নাকি? বাইক ব্যের করতিছিস?
ছেলে- না,
বিকেলে বেরোব, কাল বৃষ্টিতে ভিজেছিল, একটু মিছে রাখবো।
বাবা- তালি
ভালো। তোর
নিতাইকাকু তোর সঙ্গে এট্টু দেখা করতি আসতি পারে সকালের দিকে।
ছেলে- নিতাই
কাকু? আমার সঙ্গে?
বাবা- সে
রমই তো বলিছিল।
ছেলে- ওই তো
আসছে। সঙ্গে
জগন্নাথকাকু। (মুচকি হাসে)
বাবা- হাসতিছিস
যে! কী হলো?
ছেলে- তোমার
বন্ধু জগন্নাথকাকু, ওই গিয়ে রঙের চাদর আর বাদামী মাঙ্কিক্যাপটা পরলে কেমন যেন
বাঁদর বাঁদর লাগে।
বাবা- চুব্বো হতচ্ছাড়া, মুখির কোনো
লাগাম নেই। শুনতি পাবেনে! কোনোদিন আমারেও
ওমনি করে কবি নাকি-অ্যাঁ? তা ছাড়া জগন্নাথ, পঞ্চায়েত প্রধান নিতাই চক্কোত্তির ডান
হাত। তিন তিন বার জেতা পঞ্চায়েত প্রধান। বুঝলি? সাবধানে থাকতি হয়।
ছেলে- তুমি থাকো সাবধানে। তা
আমার সঙ্গে নিতাইকাকুর কী কাজ?
বাবা- তা সেই কবে নে। আসুক।
তুই বরং এক কাজ কর, তোর মা রে বলি আয় দু কাপ চা বসায়ে দিক। হাজার হলিউ, গণ্যমান্য
অতিথি।
ছেলে- তোমার কাছেই আসছে। চান্দা-মান্দার
ব্যাপার মনে হয়।
বাবা- না না, তোর সাথেই কী দরকার,
আমাকে আগেই বলিছিল... আরে আসেন, আসেন।! তুষ্টু, বাবা, চেয়ারখান
আগোয়ে দে। জগন্নাথ,
তুমি ভাই এই মোড়ায় বস, আমার সাথে।
ছেলে- বসেন নিতাইকাকু। বাবা
বলছিল, আমার সাথে আপনার নাকি কী দরকার আছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কমলা- (চা
হাতে করে এসে দাঁড়ায়) আপনাদের চা।
নিতাই- আরে
বাবা, চা একেবারে রেডি? ভালো আছেন তো? আপনার সাথে তো দেখা সাক্ষাৎ হয় না, সুযোগই হয় না। এত ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন
যে কী বলব!
কমলা- হ্যাঁ ভালো আছি। আপনারা চা খান,
আমি যাই।
জগন্নাথ- ন্যাও মোড়ল, তাড়াতাড়ি তোমার
কাজের কথা সারো, আমার অনেক কাজ আছে।
বাবা- তালি চল, তোমারে আমি আমার নূতন
শশার মাচাটা দেখায়ে আনি। অরা কাজের কথা কউক।
নিতাই- সেই
ভালো, আমরা কাজের কথাটা চটপট সেরে ফেলি। তুষ্টু তুমি মোড়াটা নিয়ে এগিয়ে এসে আমার কাছে বস।
ছেলে- বলুন
কাকু।
নিতাই- শোনো
তুষ্টু, আমার খুব ইচ্ছে ছিল, তোমাকে এবার গ্রাম পঞ্চায়েতে সভ্য করে নেব।
ইয়াং ব্লাড আমাদের পার্টীতে দরকার। আমি থাকব, তুমি থাকবে, জানাশুনা কয়েক জন থাকলে
কাজকর্মের কত সুবিধা হয়!
ছেলে- আমি! আমি রাজনীতির কিছুই বুঝি না।
কী যে বলেন!
নিতাই- আরে,
বোঝো না আবার কী, আজকালকার ছেলে, সবই বোঝ। আর তা ছাড়া
পরিস্থিতি অনেক পালটে গেছে। আবার আমিও আর দাঁড়াতে পারছি না পঞ্চায়তে। এবার এই সিট
সংরক্ষিত বলে ঘোষণা হয়েছে। আমার একেবারে ভরাডুবি। এখন তুমিই আমাকে বাঁচাতে পারো। যা বলছি, না বোলো না। তোমাকে আমরা
পঞ্চায়েত সভাপতি পদে দাঁড় করাবো। তুমি চটপটে, বলিয়ে কইয়ে আছ, সংরক্ষণেও আটকাবে না,
খবর রাখি বন্ধুবান্ধবও তোমার সর্বস্তরে। তারপর যেটুক বাকি থাকে, আমরা তো আছি!
ছেলে- কাকু,
আপনারাই তো বলেন, বকুলের ছেলেটা খুব সভ্য, তাই না? তা হলে আমার আর নতুন করে সভ্য
হওয়ার দরকার নেই, সভাপতি হওয়ারও দরকার নেই। ওইসব আপনাদের জন্য থাক।
নিতাই- শোনো,
অবুঝ হয়ো না। তোমার দরকার নেই, আমার দরকার নেই, কিন্তু দেশের দরকার আছে। না
কি? এই যে সারাদিন খেটে মরি, সেকি নিজের জন্য? কাজ তো আমি মানে আমরা করবই। তুমি
শুধু আমাদের সঙ্গে থাকবে, তোমার নামটা
থাকবে। তোমার বাবা আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ, এই বিপদে তোমাকে
ছাড়া আর কাকে সাহায্য করতে বলব? আর তুমিই বল, এ তল্লাটে তুমি ছাড়া, তোমাদের সমাজে
লেখাপড়া জানা আর কেই বা আছে? আর তা ছাড়া লোকে তো দর্শনধারী চায়, তোমার চেহারা, ছবি
তোমার বাবার মতো নয়, মায়ের মতো, দেখতে
শুনতে ভালোই – সেটা তো মিথ্যে নয়!
ছেলে- বাবা জানে?
নিতাই- ওই প্রথমটা একটু একটু জানে, সভাপতির কথা জানে না। আর ও তো সরল সিধে মানুষ, অতশত বোঝেও না।
ছেলে- তা হোক, বাবার সাথে কথা না বলে
আমি হ্যাঁ বা না, কিছুই বলতে পারব না। দূ্র মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!
নিতাই-
আরে আরে সে তো বটেই, সে তো বটেই। বাবার সাথে কথা বল, কিন্তু বাবা, সময় তো আর একদম নেই, দেরী হলে পাখি উড়ে যাবে। পার্টি তো আর বসে থাকবে না। আজকের মধ্যে নাম পাঠাতে হবে। আমরা বসছি। তুমি কথা বল।
জগন্নাথ- এই যে, তোমাদের কথাবার্তা শেষ হলো? আমার একটু তাড়া আছে। চল।
ছেলে- না, না, আপনারা যান, আমি পরে
পার্টি অফিসে গিয়ে আমার মতামত জানিয়ে আসব।
বাবা- তা, নিতাইবাবু সেই ভালো হবেনে, ও তো বার্যোবেই এট্টু পরে, তখন যায়ে
আপনার
সাথে দেখা করে আসফেনে।
জগন্নাথ- তা হলে চল, আমরা যাই। আমার আবার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বেলা চড়তে শুরু করেছে।
নিতাই- আঃ তুমি বড় ব্যস্তবাগীশ লোক তো? চল, চল। তা বাবা তুষ্টু,
সেই কথাই থাকলো, তাড়াতাড়ি
এসে ফর্মটা ভর্তি করে দিয়ে যেও। আমরা তাহলে চলি।
(কিছু সময় নীরবতা)
ছেলে- বাবা, নিতাইকাকু আমাকে পঞ্চায়েত সভাপতি হবার
জন্য দাঁড়াতে বলছেন। এই সিটটা নাকি সংরক্ষিত সিট হয়ে গেছে।
বাবা- সে কিরে, আমারে তো গেরাম পঞ্চায়েতে সভ্য হবার কথা বলিছিল।
ছেলে- আমিও তো সেই কথাই ভাবছি। সভ্য হওয়া এক কথা আর সভাপতি হওয়া আর এক। সভাপতি হতে গেলে বড় বড় সভায় গিয়ে কথা বলতে হবে।
বড় বড়
সাহেব সুবোর সঙ্গে ওঠা বসা করতে হবে,
হ্যাপা অনেক। তুমি কী বল?
বাবা- আমি, আমি, ...আমি বলি কি তুই রাজী হয়ে যা।
ছেলে- বল কী বাবা! শেষে ল্যাজে গোবরে হয়ে গেলে তোমারই বদনাম কিন্তু।
বাবা- ল্যাজে গোবরে হবি কেন? কথাবার্তা তো ভালোই কতি পারিস। ইংরাজীও এট্টু এট্টু। আর
কাজকম্ম তো নিতাই নিজির গরজে নিজিই করবে-করে নেবে। পার্টি বলে কথা।
ছেলে- তুমি ভেবে চিনতে বলছো? এই ব্যাগার ঠেলার কোনো মানে হয়?
বাবা- ব্যাগার ঠেলা কতিছিস কেন? নিতাই রে দ্যাখ আমারি বয়সী। বিধান রায় যখন আমদের আনে এ জায়গায় বস্যালেন, অগো অবস্থা আমাদের চ্যে এট্টুও ভালো
ছিল না। আমরা চাষ করে খাতাম, অরা পুরুত গিরি কর্যে। তিন
দফা পঞ্চায়েত হয়ে কোথাত্তে কোথায় উঠে গেছে। আজ
অর নেই কী? জমি করিছে, বিল্ডিং করিছে, লাইন বাস করিছে, ছাওয়াল
পাওয়ালগুলোরে ভালো শিক্ষা দেছে- আজকাল ব্যাটা নাস্তিক হতি চেষ্টা করতিছে।
অরে, যুগটাই হলো রাজনীতির। অ তো প্রায় জমিদার, ব্যাগার ঠেলা বলতিছিস ক্যেন
র্যা? রাজী হয়ে যা। ভাবাভাবির দরকার নেই, তুই যা এখুনি পার্টি অফিসে যায়ে ফরম ভরি
দিয়ে আয়। কিছু লাভ তো হবেই।
নিতাই তোরে না দিয়ে নিজি খাতি
পারবে না নে। আর সুদু সুদু বন্ধুক তুইই বা কান্ধে নিবি ক্যানো? রাজি হয়ে যা, রাজি
হয়ে যা।
মা- না, না, রাজী হোস নে বাবা, রাজী হোস নে!
বাবা- তুমি আবার এর মদ্দ্যি ক্যানো? অ্যাঁ? মায়েমানুষ,
মায়েমানুষির মতো থাক। যাও এহানতে যাও।
মা- আমি আড়ালের তে সব শুনিছি। তুষ্টু মাণিক আমার,
তুই রাজী হোস নে বাপ। তুই ছোট ছিলি, তোর মনে ন্যাই, আমার দাদা ভোটে দাঁড়ায়েছিল,
তারে টুকরো টুকরো করি ক্যাটে মাইরে
ফেলাইছিল। (কান্না) তুই ভোটাভুটির মদ্দ্যি যাস নে বাবা!
ছেলে- সে তুমি ভেবো না মা, এ তল্লাটে এমন কেউ
নেই, যে আমার গায়ে হাত ওঠাবে।
বাবা- তুই মাইয়ে মানুষির কতার মদ্দ্যি যাস নে
তো, মরদের বাচ্চার মতো নাম লেখায়ে সই ক্যরে দে আয়।
ছেলে- তারপরে নিতাই চক্কোত্তিকে সামলানোর ভার
কিন্তু তোমার। আমার সঙ্গে লাগলে, আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বোলব না।
বাবা- আঃ, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এট্টা এট্টা
করি কাজ শ্যাষ কর তো।
ছেলে- ঠিক আছে, আমি চল্লাম। তুমি
ভেবো না মা, আমি সব সামলে নেব।
মা-
জয় নিতাই গৌর, জয় রাধেশ্যাম। রোক্ষে কোরো,
রোক্ষে কোরো আমার তুষ্টু রে।
(মোটরবাইক
স্টার্ট ও বেরিয়ে যাবার শব্দ)
(দৃশ্যান্তর)
(২)
(দূর থেকে মিছিলের আওয়াজ - মিছিলের সুরে
তুষ্টুর জেতার জয়গান)
নিতাই- শুনতে পাচ্ছো? তোমারই জয়গানে মেতেছে ছেলের
দল। ও পক্ষের ক্যান্ডিডেট তপন ঢালি।
কোনোমতে জামানত বাঁচাতে পেরেছে। ইজ্জত
একেবারে ঘোলাটে হয়ে গেছে।
তুষ্টু- সবই আপনার কৃতিত্ব। আমি তো নিমিত্ত
মাত্র। এখন ছেলেগুলোকে সামলাতে হবে তো! দাঁড়া্ন, বাবা কোথায় গেল দেখি। কিছু টাকা
তো চাই সামলাতে।
নিতাই- সে তুমি ভেব না। ব্যবস্থা করা আছে, ধেনো নয় একেবারে
বিলিতি। সঙ্গে আনুষসঙ্গিক তো আছেই। হাজার হলেও এ হলো তুষ্টুদার জেতার আনন্দ,
তাই না?
তুষ্টু- আচ্ছা নিতাইকাকু, সবাই আনন্দ করছে, সবাই পুরস্কার
পাচ্ছে, আমি কী দোষ করলাম? আপনার কথা মতো আমি ভোটে দাঁড়ালাম, খাটলাম, জিতলাম, আমার
কো্নো পুরস্কার নেই?
নিতাই-
আরে, এখন তো তুমিই সকলকে
পুরস্কার দেবে! আমরা তো তোমারই লোক।
তুষ্টু-
না নিতাইকাকু, আপনার কথায় আমি
ভোটে দাঁড়িয়েছি, সবাইকে আমি পুরস্কার দিলেও, আপনি আমাকে পুরস্কার দেবেন।
নিতাই-
তাই! বেশ, বল কী পুরস্কার তুমি
চাও!
তুষ্টু- আমি স্বপ্নাকে বিয়ে করতে চাই। আপনার সম্মতি চাই।
নিতাই- তুমি যে এতদুর এগিয়েছ, আমি আন্দাজ করতে
পারিনি। তুমি ঘন ঘন আমার বাড়িতে যাতায়াত করতে, লক্ষ্য করেছি, ভেবেছিলাম ভোটের কাজ।
কিন্তু... যাকগে, একটা কথা বলি তুষ্টু, তুমি তো জান, আমরা ব্রাহ্মণ, তোমাদের সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক সম্ভব নয়। এ সব
কথা তুলে এখন এই সময়ে মনের ওপর চাপ সৃষ্টি
কোরো না। মন দিয়ে কাজ কর, নিজের উন্নতি করার চেষ্টা কর।
তুষ্টু-
কিন্তু নিতাইকাকু, আমি
স্বপ্নাকে ভালোবাসি। আমি-
নিতাই-
আরে ও সব ছেলেমানুষি আবেগ
জীবনে আসে। ও সময়েই কেটে যাবে। আর এখন ওসব
প্রেম ভালোবাসার বিলাস করবার তোমার সময় কোথায়? তুমি এখন পঞ্চায়েতের সভাপতি, সেদিকে মন দাও। মনে
রেখো, তুমি এ পর্যন্ত সবচেয়ে অল্পবয়সী সভাপতি। বিরাট গৌরবের অধিকারী।
তুষ্টু-
কিন্তু নিতাইকাকু, স্বপ্নাও
আমাকে ভালোবাসে, আমাকে চায়। আমরা বিয়ে করতে
চাই। এটা আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন।
নিতাই- স্বপ্না আমার মেয়ে। ওকে আমি সামলে নেব এখন।
তুমি নিজেকে সরিয়ে নাও, ব্যস।
তুষ্টু-
কিন্তু নিতাইকাকু... আপনি...
নিতাই-
আঃ, কী ঘ্যানর ঘ্যানর করছ তখন
থেকে-! বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার চেষ্টা করছ তুমি। যা হয় না, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে
সময় নষ্ট কোরো না। তোমাকে আমি ভোটে
দাঁড়াতে বলেছি কি আমার জাত–ধর্ম
বিসর্জন দেবার জন্য?
তুষ্টু-
আপনি বলেন, আপনি মানুষের সেবা
করে বেড়ান, এখনো আপনি জাত-ধর্মের বেড়া পার হতে পারেন নি?
নিতাই- তুমি এখনো ছেলেমানুষ — এ সব বুঝবে না। যা
বলছি শোন, তুমি...
তুষ্টু-
না, আর শুনব না। অনেক শুনেছি,
এবার আপনি শুনুন। আমি স্বপ্নাকে বিয়ে করব করবই। আমরা দুজনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর শুনুন, যে ছেলেগুলি আমার জয়গান করে মিছিল করছে দেখলেন, প্রয়োজনে ওরাই কাল
আপনার বাড়ির সামনে স্লোগান দেবে। আপনি বোধহয় বুঝতে পারেননি ওরাই এখন আমার ডান হাত,
বাঁ হাত, আমার যুবশক্তি। আপনিই তো চেয়েছিলেন যুবশক্তিতে পার্টি বলীয়ান হয়ে উঠুক! আপনি শুধু দেখুন, কেমন করে আমি এগিয়ে যাই।
নিতাই-
যা করেছি তা ফিরিয়ে নেবার
ক্ষমতা আমার নেই। ঠিক আছে, তুমি যখন এতদুর এগিয়ে গেছ, আমি
তোমার কাছে নতি স্বীকার করছি। তবে, এ কথাও
তো তুমি অস্বীকার করতে পারবে না,
আমি তোমাকে ভালোবাসি। বন্ধুর ছেলে হিসেবে
স্নেহের অধিকারী বলে মনে করি। এ ভাবে তুমি আমার সমাজ-সংস্কার-জাত-ধর্ম, আমার
প্রতিষ্ঠা সব কিছু চুরমার করে দিও না। এ বিয়েতে আমি মত দিতে পারি না, কোনো মতেই
পারব না। তুমি আমাকে দয়া কর, ক্ষমা কর।
তুষ্টু-
এ সব আপনি কী বলছেন? বেশ আপনার
সম্মতি আমি চাইব না, কিন্তু অনুরোধ,
প্রতিবন্ধকতা করবেন না। বিয়ে যখন আমারা করব ঠিক করেছি, করবই। আমি আর স্বপ্না
রেজিষ্ট্রী ম্যারেজ করব। আপনি দূরে থাকতে চান, তাই থাকবেন। আসবেন না, যোগ দেবেন
না। তাই হবে। আমাকে আমার মতো এগিয়ে যেতে দিন। আমরা জলপাইগুড়িতে গিয়ে রেজিস্ট্রি
করব।
নিতাই- তোমার বাবা মা!
তুষ্টু- সে সব আমি সামলে নেব। ওটা আমার ব্যাপার।
নিতাই-
তুষ্টু, তোমার ওপর আমার অনেক
ভরসা, দেখো বাবা, আমাকে ভুল বুঝো না। সব
দিক একটু সামলে সুমলে নিও বাবা। অনুষ্ঠান করে বিয়ে দিলে আত্মীয় স্বজন আমাকে বয়কট
করবে। সমাজটা কে তো চেন বাবা!
তুষ্টু-
ঠিক আছে। এ ব্যপারে আর কোনো কথা বলতে আমি আগ্রহী
নই। পার্টি অফিসে কাজের কথাই হবে। আমি
বরং ছেলেগুলোকে দেখে আসি।
(মোটরবাইক
বেরিয়ে যাবার শব্দ)
(দৃশ্যান্তর)
(৩)
(সানাই-এর সুর ভেসে আসে, মিলিয়ে যায়)
মা-
হ্যাঁরে তুষ্টু, দেখতি দেখতি
তো বিয়ের তিন বছর কাটি গেল, এবার তোর
বাবারে ফিরিয়ে আন! তিনিও তো গেছেন আজ দু’বছরের উপর হতি চল্লো। ফ্যাল ফ্যাল করি তাকাস ক্যানো, ভাত
খাতিছিস খা। যেটা বলি, মন দে শোন।
তুষ্টু-
বাবাকে ফিরিয়ে আনব? মরা মানুষকে
আবার ফিরিয়ে আনা যায় নাকি? অ্যাঁ!
মা-
তুই অপগন্ড, অপগন্ডই রয়ি গেলি।
ওরে এবারে আমারে একটা সাথী উপহার দে। আমি যে বড় একা। আমি স্বপ্নে দেখিছি, তোর বাবা
আসতি চায়। তুই না আনলি সে আসবে ক্যামনে!
তুষ্টু- একি বাজারের খেলনা নাকি, যে কিনে আনলেই হলো?
ও সব কথাবার্তা থাক।
মা-
বাজারের খ্যালনা হলি তো আমিই
যায়ে কিনি আনতাম। তোর গো ইচ্ছে না হলি আমি যে নিরুপায়। তোরে বলতিছি, বউমারেও বলব,
তবে সত্যি কথা, বলতি সাহস হয় না। দেখি আমিও কি করতি পারি!
তুষ্টু-
আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে
যাব, তিন চার দিন পরে ফিরব। সাবধানে থেকো। টাকা পয়সা স্বপ্নার
কাছে আছে। দরকারে চেয়ে নিও। একটু জল দাও তো।
(মা বেরিয়ে যায় , স্বপ্না ঢোকে)
স্বপ্না-
শোন, তোমার সংগে কথা আছে।
তুষ্টু- বসে আছি পথ চেয়ে শুধু তোমার গান গেয়ে...
স্বপ্না- থাক থাক রক্ষা করো, তা মা তোমাকে কী বলছিল
গো?
তুষ্টু- যে কথা বিয়ের আগে তুমি আমাকে বলেছ। যে কথা আমার বিরাট স্বপ্নের জগতের
মধ্যে বার বার আনাগোনা করত, আজ মাও সে
কথাই বলল। সেই তোমার তরস্বী আর আমার লেলিন।
স্বপ্না- (উচ্চস্বরে হাসি) এখনো লেলিন! এত বড় নেতা! এত বক্তৃতা। এতদিন বাদে সেই লেলিনই রয়ে গেলে? তুমি দেখছি তোমার শ্বশুরের নাম ডোবাবে। লেলিন নয়,
লেনিন-লেনিন -- বুঝলে ? ভালো করে মুখস্ত কর।
তুষ্টু- তোমার তরস্বী তো আরো উদ্ভট।
স্বপ্না- তরস্বী উদ্ভট! অতি সহজ। তোমার নামের ‘ত’ দিয়ে শুরু, আর আমার নামের
‘স্ব’ দিয়ে শেষ।
তুষ্টু- এই উদ্ভট নামের মাথামুন্ডু মানে টানে কিছু
আছে?
স্বপ্না- মানে টানে তুমি বুঝবে না, তার জন্য লেখাপড়া
শিখতে হয়। কিন্তু আমার চাওয়াটা তো মিথ্যে নয়!
তুষ্টু- আমি আর কী করব বল? ডাক্তার তো দেখালাম। বেদব্রত বসুর চিকিৎসায় তো কোনো কাজ হলো না। আর কী করতে পারি! জড়ি-বুটি করব?
তোমার পছন্দ হবে?
স্বপ্না- অশিক্ষার ছাপ সব কিছুতে। চাষার ব্যাটা তো চাষার ব্যাটাই। এক ডাক্তার পারেনি তো আর ডাক্তার নেই দুনিয়ায়? শোন, আমি ইতিমধ্যে জলপাইগুড়িতে ফার্টিলিটি ক্লিনিকে
গিয়েছিলাম। ডাক্তার প্রতুল বিশ্বাস বললেন, কেসটা মেজর এন্ডোমেট্রিওসিস। এইজন্য
তলপেটে এত ব্যথা হয়। কিছুদিন ওষুধ দিয়ে দেখবেন, না হলে কলকাতায় গিয়ে অপারেশন করাতে হবে। আরো বলেছেন, বাচ্চা আমাদের হবেই।
তুষ্টু- কী অসুখ বললে?
স্বপ্না-
এন্ডোমেট্রিওসিস।
তুষ্টু- ও, তা অপারেশনে কত টাকা লাগবে?
স্বপ্না- এত
টাকা টাকা কর কেন বল
তো? বাড়ি-ঘর, জমি-জমা বেচেও যদি একটা বাচ্চা পাই, তুমি কি তাতে খুশী হবে না? বংশে
বাতি দেবার যদি কেউ না থাকে, তবে তোমার টাকাকড়ি খাবে কে?
তুষ্টু- তোমার পিছনে আর কত ঢালব বল তো? বামুনের মেয়ে বিয়ে করার জ্বালা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
স্বপ্না- ঐ জন্যই বলি, তোমরা পারফেক্ট ছোটলোক। শোন, চিকিৎসা আমি করাবই, আর টাকাও তোমাকে ঢালতে হবে। আমি এখনো তোমার মোটর
সাইকেলের পিছনে বসানো বার্বি ডল।
আমি তোমার খেলার পুতুল নই। শরীর ছাড়াও, মন বলে একটা পদার্থ আমার আছে। (কেঁদে ফেলে) তোমার পায়ে ধরছি, আমার তরস্বীকে তুমি এনে
দাও।
তুষ্টু- ঠিক আছে, ঠিক আছে, ফিরে আসি, তখন ভাবা যাবে। আমি চললাম।
(দৃশ্যান্তর)
(৪)
(তুষ্টুর অফিসে তুষ্টু টেলিফোনে ব্যস্ত)
তুষ্টু-
হ্যাঁ, পরিস্থিতি এবার একটু জটিল, বুঝতেই পারছি। তবে, না না আমার আর কী
আছে, আপনারা চাইলে আমি ভোটে দাঁড়াব না,
বলতে পারব না... হ্যাঁ সেটাও সত্যি, আমি থাকলে কায়েত পাড়া তলে তলে
আমার হয়েই কাজ করবে। কম তো করিনি ওদের জন্যে! ওরা ভাবে আমি থাকলে ডেভেলাপমেন্ট-এর কাজ মার খাবে না। (ঊচ্চ হাসি)হাঃ হাঃ হাঃ... আমি জানি, আমি জানি... গতবার সংরক্ষিত আসনে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তপন
ঢালি হেরেছিল। মারামারির পর আমিই ওকে থানা থেকে ছাড়িয়ে
এনেছিলাম। পরে ক’টা ঠিকা কাজও পাইয়ে দিয়েছিলাম। তখন পার্টির লোকেরা হৈ হৈ করে উঠেছিল। কাল ও এসেছিল, বলল এবার ও আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
না। হ্যাঁ, আশা তো রাখি, তবে ঘরে
বাইরে ঝামেলা, সবই তো জানেন। আচ্ছা, রাখি এবার। একটা মিটিং শুরু হবে এখনি। আচ্ছাআআআআআ!
(চাপা স্বরে) ভেলু, ভেতরে আয়। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বোস।
ভেলু- কী ব্যাপার তুষ্টুদা, ভোটের প্রস্তুতি?
তুষ্টু- হ্যাঁ, সে তো আছেই, তার জন্য তো তোরা কাজ
শুরু করেই দিয়েছিস।
ভেলু- ও বাবা, এ তো স্পেশাল জিনিস দেখছি। আবার
দু’বোতল! তুমি কি আজকাল অফিসে বসেই...
তুষ্টু- পাগল নাকি! একটা তোর, আর একটা কানুর। কানু
এখনো তোর সাথে আছে তো?
ভেলু- হ্যাঁ, আছে। কেন, কোনো গন্ডগোল হবে নাকি?
তুষ্টু-
না, সে রকম কিছু না। বরং গণ্ডগোল না হওয়ার সম্ভাবনাই
বেশি। শুনেছি তপন ঢালি এবার দাঁড়াবে
না। তা, তোদের বোমা ফাটানোর
বিদ্যেটা এখনো রপ্ত আছে তো? নাকি ঠিকাদারি পেয়ে ভুলে মেরেছিস?
ভেলু-
কী যে বল তুষ্টুদা, (হাসি) এ
কি আর ভোলার জিনিস! এ হলো সাইকেল চালানো বিদ্যার মতো। দশ বছর পরেও যদি সাইকেলে ওঠো,
দিব্যি চালাতে পারবে। কী ব্যাপার বল তো?
তুষ্টু- গত ইলেকশনে যে বোমা ফাটিয়েছিলি, সে রকম
পটকায় হবে না। জোরদার মাল আছে?
ভেলু- তা তো আছে। কিন্তু...
তুষ্টু- আমার গাড়িটা উড়িয়ে দিতে পারবি?
ভেলু- কী যে বল তুষ্টুদা, তোমার গাড়ি, আমরা
ওড়াবো? না না, তোমার গাড়ির কোনো ক্ষতি করতে পারব না।
তুষ্টু- আরে বুদ্ধু, আমিই তো আমার ক্ষতি চাই।
ভেলু- মানে?
তুষ্টু-
এবারের ইলেকশনে একটু বেকায়দায়
আছি। জানি না কী ফল হবে। কিন্তু গাড়িটা উড়িয়ে দিলে
সবাই আমায় সিমপ্যাথি ভোট দেবে। বাড়তি শ-দুই ভোট পেলেও তো অনেক! আর তা ছাড়া গাড়ির ইন্সিওরেন্সের
টাকারও একটা ব্যাপার আছে। আমার তো লোকসান নেই। গাড়িটাও তো পুরনো। তুই কানুকে বল। পঁচিশ-পঁচিশ দেব। এই নে পঁচিশ
এডভান্স। কী রে কম হলো?
ভেলু- কী যে বল তুষ্টুদা!
তুষ্টু- গুনে নে, গুনে নে, টাকা পয়সার ব্যাপার।
ভেলু- ভেলু কানু লোক চেনে। তুমি নিশ্চিন্তে থাক।
তুষ্টু-
শোন, ওরকম আগের মতো
লঙ্কাবাজীতে চলবে না্ - জোরদার ব্লাষ্ট চাই। আমি পরশু জলপাইগুড়ি যাব। ফার্টিলিটি ক্লিনিকের খানিক দূরে, ফাঁকা জায়গায়
গাড়িটা রাখব। আমি নেমে গেলেই উড়িয়ে দিবি।
ভেলু- ড্রাইভার!
তুষ্টু-
না না, ওকে নেব না; আমি নিজেই
ড্রাইভ করব। যেখানে দাঁড় করাব,
জায়গাটা ফাঁকাই থাকে, লোকজন জখম বা মারা যাবার কোনো চান্স নেই। তুই সন্ধ্যেবেলা গাড়িটা নিয়ে যাস। কীভাবে মালপত্র রাখবি, গুছিয়ে
নিস। কেমন করে জিততে হয়, আমি জানি।
ভেলু- আরে তোমার চিন্তা কী?
তুষ্টু- সে তো বটেই, তোরা তো আছিসই! পরশু সকালে গাড়িটা
দিয়ে যাস।
ভেলু- ঠিক আছে। আমি এখন আসি। (বেরিয়ে যায়)
তুষ্টু- (স্বগতোক্তি) সবাই জানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কথা --
আমি মারব তিন পাখি। একটা পাখির গল্প শুধু আমি
জানব, পৃথিবীতে আর কেউ না।
(দৃশ্যান্তর)
(৫)
তুষ্টু-স্বপ্নার
বাড়ি, সময় – সকাল
স্বপ্না- কী ব্যাপার? আজ নেতবাবুর বেরোনো নেই নাকি? এখনো বাড়িতে বসে?
তুষ্টু- আজ কি বার মনে নেই, আমাদের যেতে হবে না? তাই আর বেরোবার প্ল্যান নেই। আর তা
ছাড়া ভোট ভোট করে মাথা একেবারে জ্যাম হয়ে
গেছে।
স্বপ্না- কী মনে হচ্ছে তোমার? হাওয়া কোন দিকে?
জিততে পারবে তো?
তুষ্টু- কী যে বল, তোমাকে জিতে আনতে পেরেছিলাম- আর ভোটে জিততে পারবো না! গতবার কত ভোটে জিতেছিলাম মনে আছে?
স্বপ্না- সেবার, ভুলে যেও না, সঙ্গে তোমার নিতাইকাকু
ছিল। এবার? একা...
তুষ্টু- একা কেন? এবার তুমি আছ। দেখো না, এবার আগের বারের চেয়েও বেশি ভোটে জিতব। তুষ্টু কখনো হারতে জানে না।
স্বপ্না- আজকের ব্যাপারটাও ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে হয়। ঈশ্বর কে ডাকো, এবার যেন রেজাল্ট পজিটিভ হয়।
তুষ্টু- ভালো লোককেই ঈশ্বর সাধনা করতে বললে! আমার ঈশ্বর, ধ্যান, জ্ঞান এখন ভোট। কী যেন হয়েছে তোমার, কী যেন কঠিন নাম ওই
রোগটার--
স্বপ্না- এন্ডোমেট্রিওসিস।
তুষ্টু- বাপ রে! এত কঠিন নাম মনে রাখো কী করে?
স্বপ্না- তুমি তো তরস্বী নামটাও ভুলে যাও। আমি কিন্তু ছেলের নাম তরস্বীই রাখবো-- বলে
রাখলাম।
তুষ্টু- আরে ছেলে হতে দাও, ছেলে তো তুমি অনেক বারই হওয়ালে...
স্বপ্না- ওমনি কোরে বোলো না, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে। আমি তো আশা নিয়েই বাসা বেঁধেছি।
ভেলু- (বাইরে থেকে) তুষ্টূদা-
তুষ্টু- আমি আসছি একটু (বেরিয়ে যায়) কী রে
ভেলু, গাড়ি রেডি? সব ঠিক আছে তো?
ভেলু-
সব ঠিক আছে, কিন্তু...
তুষ্টু- কিন্তু! আবার কিন্তু কিসের রে?
ভেলু-
কানু পঁচিশে রাজি হচ্ছে না
তুষ্টুদা।
তুষ্টু- ব্যাটার তেল বেড়েছে। কত চায় রে?
ভেলু-
চল্লিশ।
তুষ্টু- চোওল্লিশ... বেশ, কাজ ঠিক মতো হবে তো?
ভেলু-
সে ব্যাপারে তুমি
নিশ্চিন্ত থাক। গাড়িতে প্যাক হয়ে গেছে, শুধু একটা বোতাম টেপার অপেক্ষা।
তুষ্টু- ঠিক আছে নে, আরো পনেরো, তোরটা পরে দেবো। তোরা এখনি চলে যা জায়গায়, আমি
ঘন্টা দুয়েক পরে যাচ্ছি। (ঘরে ফিরে যায়) স্বপ্না, স্বপ্না গেট রেডি, চল আজ
একটু তাড়াতাড়ি বেরোই।
স্বপ্না- আজকে যখন রিপোর্ট আনতে যাবেই ঠিক করেছ, তো
পাশাংকে ছুটি দিলে কেন? এতখানি রাস্তা নিজে ড্রাইভ করা! টায়ার্ড হয়ে যাবে।
তুষ্টু- আসলে পাশাং অনেকদিন ধরেই ছুটি ছুটি করছিল, সামনে
ইলেকশন, ছাড়তে পারি কি না পারি, প্রচার শুরু হয়ে গেলে ফুরসৎই পাবে না। ঠিক আছে ...কিছু হবে না, আজ শুধু তুমি আর আমি। আগের মতো। এদিক ওদিক পাগলের মতো ঘুরে, তারপর শহরে যাব।
স্বপ্না- কোথায় আবার পাগলের মতো ঘুরবে?
তুষ্টু- সেই আগের মতো, গোঁসাই গাঁওয়ের জংগলে, সেখান থেকে রাভা বস্তির সেই সরকারি রিসোর্টে। সেখানে সেই
আগের মতো...
স্বপ্না- বাজে কথার মাষ্টার, থামো তো! খালি নষ্টামি!
তুষ্টু- বেশ, তাহলে ঝিলে
বোটিং করব, পাখি দেখব। হরিণ, বাইসন যদি দেখতে পাই তো আউর ভী আচ্ছা। তারপর রেষ্টুরেন্টে খাব, তারপর শহরে যাব।
স্বপ্না- না, আমি কোথাও
যাব না। আমার মন পড়ে রয়েছে রিপোর্টের জন্য। তাড়াতাড়ি চল, কিন্তু সোজা শহরে।
তুষ্টু- যো হুকুম! তোমার
ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। চল, বেরিয়ে পড়ি। তবে খাওয়াটা কিন্তু আজ বাইরেই।
স্বপ্না- বেশ, তাই সই। আমিও বা রাজ-রোষে পড়ি কেন?
(গাড়ি বেরিয়ে যাবার শব্দ)
(সময়ের
ব্যবধান বোঝাতে আবহ)
স্বপ্না- এখানে থামলে কেন?
তুষ্টু- এখানেই গাড়িটা থাক, জায়গাটা ফাঁকা আছে। ভিড়ভাট্টা কম। পার্কিংএ কারো অসুবিধা হবে না।
স্বপ্না- না, আমার এতটা হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
তুষ্টু- তুমি গাড়িতেই বোসো না, আমি চট করে গিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে আসছি।
স্বপ্না- এতদূর এলাম, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাব? খারাপ লাগছে।
তুষ্টু- আরে, ডাক্তার
থাকলে তবে না দেখা করবে? আমি সকালেই খবর নিয়েছিলাম, উনি আজ আসবেন না। আমি রিপোর্টটা নিয়েই চলে আসছি। তারপর খেতে যাব।
তুমি একটু চুপ করে বোসো তো, ছটফট কোরো না। আমি যাব আর আসব।
স্বপ্না- ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার বক্তৃতা আর আমায় শোনাতে হবে না। আগে জানলে আমি আসতামই না । তাড়াতাড়ি আসবে।
তুষ্টু- এই গেলুম আর
এলুম। দেখ কেমন শিক্ষিত লোকের মতো কথা বললাম। আর আমাকে অশিক্ষিত চাষার ব্যাটা
বলতে পারবে না!
স্বপ্না- আঃ যাও না, রিপোর্টটা আনো না!
তুষ্টু- হ্যাঁ যাই।
(চলে যায়)
তুষ্টু- যাক, ডাক্তারের ব্যাপারটা ভালোয় ভা্লোয় ম্যানেজ করা গেছে। মিথ্যে কথা
বলতে আজকাল আর বুক কাঁপে না। রিপোর্! রিপোর্ট তো
আমার জানাই আছে। অনেক বারই তো রিপোর্ট দেখলাম, ফল তো সেই একই।
তুমি ব্রাহ্মণ কন্যা, উচ্চ বংশ, কিন্তু ফসল ফলাতে পারলে না। আর আমি অশিক্ষিত, চাষার
ব্যাটা, কালচার বিহীন পারফেক্ট ছোটলোক! মা আমার ডাইনি,
খালি খবরদারি আর নজরদারি করে—! ওঃ অসহ্য! বাক্যবাণ
শ্লেষ-বিদ্ধ হয়ে আমি জর্জরিত। অসহ এক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছে আমাদের। আজ সেই যন্ত্রণার শেষ হবে। শান্তি। এখন সব নির্ভর করছে ভেলু আর কানুর ওপর। ওরাও জানে না, স্বপ্না বসে আছে গাড়ির ভেতরে। একটা বাঁজা মহিলা, দজ্জাল
মেয়েছেলে, যে আমার মায়ের জীবনটা বিষিয়ে
তুলেছে, ঘরটাকে বানিয়ে তুলেছে নরক, যে ভাবে হোক যে কোনো মূল্যে আমি তার থেকে মুক্তি চাই। ভেলু কানু চাইলে আমি আরো টাকা ওদের দেব।
এখান থেকে কোনো শব্দ আমার কানে আসবে না। না আসুক, না আসাই তো ভালো। ফিরে গিয়ে দেখব খাঁচা নেই, পাখিও নেই। থাকবে শুধু মুক্তির আস্বাদ, জেতার আনন্দ। না কি, শব্দ শোনা গেলেই ভালো হতো! নিশ্চিন্ততার প্রমাণ!
এই তো ফার্টিলিটি ক্লিনিক, ডাক্তার প্রতুল বিশ্বাস, আপনাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আর কোনো প্রশ্নই থাকবে না।... কিন্তু উনি
রিশেপসনে দাঁড়িয়ে কী করছেন? আমায় দেখে হাসছেন কেন?
ডাক্তার- আসুন, আসুন মিঃ
মন্ডল, কনগ্রাচুলেশনস, কনগ্রাচুলেশনস। ইটস আ মিরাকল, মেজর এন্ডোমেট্রিওসিস, অপারেশন ছাড়াই ভালো হয়ে গেছে। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে। বিরল। আপনার স্ত্রী সেই বিরল ভাগ্যবতীদের
একজন। ওষুধেই আপনার স্ত্রীর সেই সমস্যাটা মিটে গেছে। শুধু তাই নয়— আনন্দের কথা— শী ইজ প্রেগন্যান্ট। কনগ্রাচুলেশনস, আপনি বাবা হতে চলেছেন— বাবা-আ-আ। ইউ মাষ্ট গিভ আস এ
ট্রিট। খাওয়াতে হবে মশাই, খাওয়াতে হবে। ম্যাডামকে নিয়ে একবার আসুন। এই নিন আপনার
রিপোর্ট। এতক্ষণ আমি এটাই দেখছিলাম।
তুষ্টু- থ্যাঙ্ক ইউ ডাক্তার,
আমার আমার একটু তাড়া আছে। আমি, আমি... ওঃ না... হে ভগবান... এ কি আমি ভগবানকে ডাকছি...! না ভেলু না, রিমোর্টের বাটন
টিপিস না ভেলু, ভেলুর ফোন নম্বরটা যেন কত, ও, ও তো তোলাই আছে। ওঃ সুইচ অফ। কানুরটা...
ওঃ এটাও অফ! শূয়োরের বাচ্চারা ঠিক দরকারের সময় বন্ধ করে রেখেছে। কোথায় আছে ওরা, নিশ্চয় ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। শুধু রিমোটের সুইচ টেপার অপেক্ষা। এখনি স্বপ্নাকে বলতে
হবে-- স্ব...প...না... তুমি বেরিয়ে এসো,
প্লীজ স্ব...প্না তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো... নইলে তোমার মাখনের মতো নরম শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বে গাড়ির লোহা লক্কড়ের সঙ্গে। স্বপ্না, তরস্বী আসছে স্বপ্না, তুমি চলে যেও না। আমি ভুল করেছি। আমি
ভুল করেছি... হা হা হা!
(ডাক্তারের
প্রতিধ্বনিত গলায় )
ডাক্তার- কনগ্রাচুলেশনস, আপনি বাবা হতে চলেছেন—বাবা-আ-আ
তুষ্টু- আঃ তেমাথা আর কত দূর? তুমি কি বেরিয়ে এসেছো? আমি আসছি, আমি আসছি।
ডাক্তার- আনন্দের
কথা, শী ইজ প্রেগন্যান্ট; আনন্দের কথা,
শী ইজ প্রেগন্যান্ট--
তুষ্টু- ভেলু, ভেলু, ভাই আমার, একটু অপেক্ষা কর ভাই।
ডাক্তার- আপনার
স্ত্রী সেই বিরল ভাগ্যবতীদের একজন--
তুষ্টু- স্বপ্না তরস্বীকে আগলে রাখো, আমি আসছি...
ডাক্তার- আপনি বাবা হতে চলেছেন— বাবা-আ-আ
তুষ্টু- হ্যাঁ, বাবা, আমি বাবা, আমি তরস্বীর বাবা! আমি আসছি তরস্বী, আমি আসছি।
ডাক্তার- আনন্দের কথা, শী ইজ প্রেগন্যান্ট--
তুষ্টু- ইয়েস, স্বপ্না
মা, আমি বাবা, তরস্বী আমাদের সন্তান। আমি জানি, আমি
জানি, আমি তোর বাবা। আমি আসছ। ওঃ আর কত দূর— এত দীর্ঘ কেন তোর কাছে যাবার পথ! তরস্বী আমি
আসছি, তরস্বী আমি আসছি, তরস্বী আমি আসছি (কান্নায় ভেঙে পড়ে)...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন